শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

আল্লাহর অনুগ্রহ যার প্রাপ্য

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২০ নভেম্বর ২০২২, ০৪:৩৫ পিএম

শেয়ার করুন:

আল্লাহর অনুগ্রহ যার প্রাপ্য

জন্মসূত্রে মুসলিম হলেই প্রকৃত মুমিন হওয়া যায় না। মুমিন নামাজ-রোজাসহ যাবতীয় ফরজ, মোস্তাহাব আমলের যথাযথ সংরক্ষণ ছাড়াও সত্যবাদিতা, দানশীলতা, ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা, আল্লাহর নাম শুনলে অন্তর কেঁপে ওঠাসহ নানা গুণে গুণান্বিত থাকেন। এসব গুণের মধ্যে বিশেষ এক বৈশিষ্ট্য হলো- সৃষ্টিকুলের প্রতি দয়াশীল ও হিতাকাঙ্ক্ষী হওয়া।

তার হৃদয়ে অবচেতনভাবেই মানুষ ও সৃষ্টিকুলের প্রতি দয়ার্দ্র, নিষ্ঠা ও ন্যায় মনোভাব তৈরি হবে। মহান আল্লাহ সেসব বান্দাদের দয়া না করে পারেন না, যারা অপরের প্রতি দয়াশীল ও হিতাকাঙ্ক্ষী। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা দয়ালুদের প্রতি দয়া করেন। তোমরা জমিনে যারা বসবাস করছে তাদের প্রতি দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (সুনানে আবি দাউদ: ৪৯৪১)


বিজ্ঞাপন


মুহাদ্দিসরা বলেন, আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের সহজ উপায় হলো সৃষ্টি জগতের প্রতি দয়ার্দ্র আচরণ করা এবং তাদের প্রতি অনুগ্রহ করা। সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা ও অনুগ্রহ মহান স্রষ্টা আল্লাহর ভালোবাসা ও অনুগ্রহকে ত্বরান্বিত করে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত ইহসানকারীদের (অনুগ্রহশীল) নিকটবর্তী।’ (সুরা আরাফ: ৫৬)

আরও পড়ুন: নবীজির প্রিয় আমল

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) একবার হাসান (রা.)-কে চুমু খেলেন। সেখানে উপস্থিত সাহাবি আকরা বিন হাবিস বললেন, ‘আমার ১০জন সন্তান আছে। তাদের কাউকে আমি কখনও চুমু খাইনি।’ তখন রাসুল (স.) তার দিকে তাকালেন এবং বললেন, ‘যে স্নেহ করে না, সে স্নেহ পায় না।’ (বুখারি: ৫৯৯৭)

একজন ঈমানদার পশুপাখির প্রতিও দয়ার্দ্র হয়ে থাকেন। রাসুল (স.) সাহাবিদের শুধু মানুষের প্রতি দয়া, মমতার শিক্ষা দেননি, বরং সব প্রাণীকেই করুণা করার শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি শিখিয়েছেন, আল্লাহর দয়া সব জিনিসের ওপর পরিব্যাপ্ত। আর মুমিনদের আল্লাহর মহৎ গুণাবলি অর্জন করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। মানুষ তার মনুষ্যত্বকে কেবল তখনই পূর্ণতার স্তরে উন্নীত করতে পারবে, যখন সে মহান আল্লাহর অনুকরণে প্রত্যেক প্রাণীকে দয়া করবে।


বিজ্ঞাপন


আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (স.) বলেছেন,  ‘(একবার) এক পতিতা মহিলাকে মাফ করে দেওয়া হলো। (কারণ) মহিলাটি একবার একটি কুকুরের কাছ দিয়ে যাবার সময় দেখল সে পিপাসায় কাতর হয়ে একটি কূপের পাশে দাঁড়িয়ে জিহ্বা বের করে হাঁপাচ্ছে। পিপাসায় সে মরার উপক্রম। মহিলাটি (এ করুণ অবস্থা দেখে) নিজের মোজা খুলে ওড়নার সাথে বেঁধে (কূপ হতে) পানি উঠিয়ে কুকুরটিকে পান করাল। এ কাজের জন্য তাকে মাফ করে দেওয়া হলো। (এ কথা শুনে) সাহাবিরা আরজ করলেন, পশু-পাখির সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার মধ্যেও কি আমাদের জন্য সওয়াব আছে? রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, হ্যাঁ। প্রত্যেকটা প্রাণীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার মধ্যেও সওয়াব আছে। (মেশকাত: ১৯০২)

আরও পড়ুন: নিয়মিত আমলে আল্লাহর সন্তুষ্টি

আল্লাহর প্রত্যেক সৃষ্টির প্রতি নবীজির ছিল অগাধ প্রেম ও ভালোবাসা। একদিন প্রিয়নবী (স.) তাঁর সাহাবাদের নিয়ে বসে ইসলামকে মানবতার দুয়ারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য পরামর্শ করছিলেন। এমন সময় এক সাহাবি একটি পাখির কয়েকটি বাচ্চা নিয়ে উপস্থিত হলেন। আর সেই সাহাবির মাথার ওপর দিয়ে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে মা পাখিটি কিচিরমিচির করতে করতে উড়ে আসছিল। নির্মম দৃশ্যটি সৃষ্টিকুলের মহান বন্ধু আল্লাহর নবী (স.)-এর দৃষ্টিগোচর হতেই তাঁর অন্তর যেন অজানা ব্যথায় ব্যথিত হলো। সন্তানহারা মা পাখিটির আহাজারি যেন নবীজীর কোমল হৃদয়ে বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধল। নবী (স.) সাহাবিকে পাখিটি রেখে আসার কথা বলতেই সাহাবি দ্রুত হেঁটে স্বস্থানে পাখির বাচ্চাগুলো রেখে আসেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি নবী কারিম (স.)-কে বলতে শুনেছি, ‘হতভাগ্য খারাপ প্রকৃতির লোকের দিল থেকে দয়া-করুণা কেড়ে নেওয়া হয়।’

হাদিসে এসেছে, ‘একজন মহিলা একটি বিড়ালকে বেঁধে রেখেছিল। সে তাকে খাবার দিত না আবার ভূখণ্ডে বিচরণ করে খাবার সংগ্রহের সুযোগও দিত না। এ কারণে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়েছে’ (বুখারি: ৩৩১৮)। 

পশু-পাখির যেহেতু বোধশক্তি নেই, ভালো-মন্দ পার্থক্য করার ক্ষমতা নেই, তাই পশু-পাখির মাধ্যমে মানুষ বা সম্পদের কোনো ক্ষতি হলে এর ক্ষতিপূরণ দিতে হয় না। তবে এগুলোর সঙ্গে মালিক বা রাখাল থাকলে জরিমানা দিতে হবে। ‘রাসুলুল্লাহ (স.) ওই ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে প্রাণীদের অঙ্গচ্ছেদ করে’ (বুখারি : ৫১৯৫)। পশু-পাখিকে অহেতুক নিশানা বানানো ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহর জমিনে তাদের অবাধ বিচরণের সুযোগ দিতে হবে। হাদিসে এসেছে, 'যে ব্যক্তি অহেতুক কোনো চড়ুই পাখি মেরে ফেলল, কেয়ামতের দিন পাখিটি আল্লাহর কাছে এই বলে নালিশ করবে যে, হে আল্লাহ, অমুক ব্যক্তি আমাকে অহেতুক হত্যা করেছে।’ (নাসায়ি, ইবনে হিব্বান)

যেসব প্রাণী প্রতিপালন করা হয়, সেগুলোর সুস্থতা ও খাবারদাবারের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা ওয়াজিব। মহানবী (স.) বলেছেন, 'এসব বাকশক্তিহীন প্রাণীর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। সুস্থ অবস্থায় এগুলোতে আরোহণ করো, সুস্থ অবস্থায় আহার করো।’ (আবু দাউদ: ২৫৪৮)

এক নবীকে একটা পিঁপড়ে কামড়ে দিয়েছিল। তিনি ওই পিঁপড়ের গর্তটাকেই জ্বালিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন এবং তা জ্বালানো হলো। এই কাজের নিন্দা জানিয়ে আল্লাহ তাআলা তাঁকে ওহি পাঠিয়েছিলেন। কারণ পিপড়ারা আল্লাহর গুণগান গেয়ে তাসবিহ পাঠ করে। হাদিসটির বর্ণনা বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য গ্রন্থে পাওয়া যায়। নাসায়িতে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন, কোনো এক নবীকে একটি পিঁপড়া দংশন করলে তিনি সে পিঁপড়ার বস্তি জ্বালিয়ে দেওয়ার আদেশ দেন এবং তা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তখন আল্লাহ তাআলা তার প্রতি ওহি প্রেরণ করে বলেন, ‘তোমাকে তো একটা পিঁপড়া দংশন করেছে। আর তুমি এমন এক জাতিকে ধ্বংস করলে, যারা আল্লাহর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করত।’ (নাসায়ি: ৪৩৫৮)

আরও পড়ুন: চার তাসবিহ ১০০ বার করে পড়ার বিস্ময়কর ফজিলত

আরবদের কাছে নানা রকম উট ও গাধা থাকত। হজরত রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছেও সদকার উট আসতো। এগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য আরবরা লোহা গরম করে প্রাণীর মুখে দাগ লাগাতো। এতে পশুগুলোর কষ্ট হতো। তাই রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, তোমরা গাধা কিংবা উটের মুখে দাগ লাগিও না। যদি লাগাতেই হয়, তবে নিতম্বের ওপর দাগ লাগাও।’ (সহিহ মুসলিম: ৫৩৭০)

তবে, স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে সৃষ্টির প্রতি দয়া করার মধ্যে উপকার নেই। আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করতে বলেছেন ঠিক, কিন্তু তা অবশ্যই তাঁর আনুগত্যের শর্তে। আল্লাহর অবাধ্য হয়ে কারো প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা যাবে না। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘চোখ অশ্রু ঝরায়, হৃদয় শোকার্ত হয়, তবে আমরা শুধু তা-ই বলব যাতে আমাদের প্রতিপালক সন্তুষ্ট হয়। হে ইবরাহিম! তোমার বিচ্ছেদে আমরা শোকাহত।’ (সহিহ বুখারি: ১৩০৩)

অতএব, আল্লাহর সৃষ্টিকুলের প্রতি নবীজির শেখানো ভালোবাসা ও দয়ার শিক্ষা মেনে চলা মুমিন মুসলমানের জন্য বাঞ্ছনীয়। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে সৃষ্টিকুলের প্রতি দয়া ও অন্তরে ভালোবাসা পোষণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর