সাহাবা, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈন হচ্ছেন মুসলিম উম্মাহর আদর্শ। বিশেষ করে সাহাবায়ে কেরামগণ দ্বীনের সকল ক্ষেত্রে সর্বোত্তম নমুনা। তাঁদের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণেই আল্লাহ তাআলার প্রিয়পাত্র হওয়া সম্ভব। সাহাবাদের একটি বড় গুণ ছিল দ্বীনের যেকোনো কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমল শুরু করা। তাদের ইলম শেখার উদ্দেশ্যই ছিল আমল করার জন্য। আর সেই ইলমের নাম হচ্ছে ‘ইলমে নাফে’ বা উপকারী ইলম। আর উপকারহীন ইলম থেকে পানাহ চাইতে বলা হয়েছে হাদিসে।
পূর্বসূরীরা আমলে ছিলেন অবিচল
বিজ্ঞাপন
বিশুদ্ধ সনদে এক হাদিসে এসেছে, উম্মুল মুমিনিন হজরত উম্মে হাবিবা (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি প্রতিদিন ১২ রাকাত সুন্নত নামাজ পড়বে, এর প্রতিদান হিসেবে জান্নাতে তার জন্য একটি ঘর বানানো হবে।’ (সহিহ মুসলিম: ৭২৮)
এটি মূল হাদিস। কিন্তু এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, পরের অংশটি। পরের অংশে বলা হয়েছে-
قَالَتْ أُمُّ حَبِيبَةَ : فَمَا تَرَكْتُهُنَّ مُنْذُ سَمِعْتُهُنَّ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. وَقَالَ عَنْبَسَةُ : فَمَا تَرَكْتُهُنَّ مُنْذُ سَمِعْتُهُنَّ مِنْ أُمِّ حَبِيبَةَ. وَقَالَ عَمْرُو بْنُ أَوْسٍ : مَا تَرَكْتُهُنَّ مُنْذُ سَمِعْتُهُنَّ مِنْ عَنْبَسَةَ. وَقَالَ النُّعْمَانُ بْنُ سَالِمٍ : مَا تَرَكْتُهُنَّ مُنْذُ سَمِعْتُهُنَّ مِنْ عَمْرِو بْنِ أَوْسٍ.
উম্মুল মুমিনিন উম্মে হাবীবা (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে হাদিসটি শোনার পর থেকে এ নামাজগুলো কখনও ছাড়িনি। তার মানে, শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমল। হাদিসটি হজরত উম্মে হাবিবা (রা.) থেকে শুনেছেন তাঁর ভাই আমবাসা বিন আবু সুফিয়ান (রহ)। আমবাসা (রহ) বলেন, উম্মে হাবিবা (রা.)-এর কাছে হাদিসটি শোনার পর থেকে এ নামাজগুলো আমি কখনও ছাড়িনি। আমবাসা থেকে শুনেছেন আমর বিন আউস (রহ)। আমর বিন আউস (রহ) বলেন, আমবাসা (রহ)-এর কাছে হাদিসটি শোনার পর থেকে এ নামাজগুলো আমি কখনও ছাড়িনি। আমর বিন আউস থেকে শুনেছেন নুমান বিন সালেম (রহ)। নুমান বিন সালেম (রহ) বলেন, আমর বিন আউস (রহ)-এর কাছে হাদিসটি শোনার পর থেকে এ নামাজগুলো আমি কখনও ছাড়িনি।
এ তো গেলো দিনে ১২ রাকাত সুন্নত নিয়ে। এবার এমন একটি হাদিস দেখবো, যেখানে জোহরের ৮ রাকাত সুন্নত আদায়কারীর দেহ জাহান্নামের জন্য হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। হাদিসটি সহিহ সনদে এসেছে মুসনাদে আহমদে।
বিজ্ঞাপন
আমবাসা বিন আবু সুফিয়ান (রহ) বলেন, আমি উম্মে হাবিবা (রা.)-কে বলতে শুনেছি, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি জোহরের আগে চার রাকাত এবং পরে চার রাকাত (সুন্নত) পড়বে, আল্লাহ তাআলা তার দেহ জাহান্নামের জন্য হারাম করে দেবেন। (মুসনাদে আহমদ: ২৬৭৬৪; সুনানে নাসায়ি: ১৮১২)
এখানেও লক্ষণীয়, হাদিসের পরের অংশটি। হাদিসটি বলার পর আমবাসা বিন আবু সুফিয়ান (রহ) বলেন, উম্মে হাবিবা (রা.)-এর কাছে এটি শোনার পর থেকে এ নামাজগুলো আমি কখনও ছাড়িনি।
সহিব বুখারি ও মুসলিমের এক হাদিসে এসেছে, হজরত আলী (রা.) বলেন, ফাতেমা (রা.) একবার একজন খাদেম চাওয়ার জন্য রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে যায়। তখন রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁকে বললেন, আমি কি তোমাকে এর চেয়েও উত্তম এক জিনিসের কথা বলে দেবো? (এ কথা বলে তিনি বলেন) তুমি ঘুমানোর সময় ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবর বলবে। (অর্থাৎ এটি তোমার জন্য খাদেমের চেয়েও উত্তম হবে) (সহিহ বুখারি: ৫৩৬২)
সহিহ মুসলিমের বর্ণনায় (হাদিস: ২৭২৭) এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁদের বাড়িতে গিয়ে তাঁদের দুজনকে লক্ষ্য করেও এ আমলটির কথা বলেছেন।
এখানেও হাদিসের পরের অংশটি দেখার বিষয়। সহিহ মুসলিমের বর্ণনায় পরিষ্কারভাবে এসেছে যে,
قَالَ عَلِيٌّ : مَا تَرَكْتُهُ مُنْذُ سَمِعْتُهُ مِنَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. قِيلَ لَهُ : وَلَا لَيْلَةَ صِفِّينَ ؟ قَالَ : وَلَا لَيْلَةَ صِفِّينَ.
হজরত আলী (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে শোনার পর থেকে আমলটি আমার কখনও ছুটেনি। তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, وَلَا لَيْلَةَ صِفِّينَ ؟ সিফফিনের রাতেও কি ছুটেনি? উত্তর দেন, وَلَا لَيْلَةَ صِفِّينَ না, সিফফিনের রাতেও ছুটেনি।
হজরত সালেম বিন আব্দুল্লাহ (রহ) তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ বিন ওমর থেকে বর্ণনা করেন, একবার রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁর ব্যাপারে বলেছেন, আব্দুল্লাহ বেশ ভালো ছেলে, যদি সে রাতের নামাজ পড়ত! হজরত সালেম (রহ) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.)-এর এ কথা বলার পর থেকে আমার আব্বা আব্দুল্লাহ রাতে খুব কমই ঘুমাতেন। (সহিহ বুখারি: ৩৭৩৯; সহিহ মুসলিম: ২৪৭৯)
কথাটি রাসুলুল্লাহ (স.) যখন বলেছিলেন, তখন আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রা.) ছিলেন যুবক। আর তাঁর ছেলে সালেম (রহ) যখন এ কথাটি বলছেন, তখন তাঁর ছেলে হয়ে গেছেন যুবক। সময়টা খেয়াল করুন। কত দীর্ঘ সময়। এই দীর্ঘ সময়ে কখনও আমলটি ছুটেনি।
ইমাম বুখারি (রহ) বলতেন,
ما اغتبت أحداً قطّ منذ علمتُ أن الغيبة تضر أهلها
আমি যখন থেকে জেনেছি, গীবত করার কারণে নিজেরই ক্ষতি হয়, তখন থেকে কখনো কারো গীবত করিনি। (আততাবাকাত লিস সুবকী ৯/২০)
দেখুন, তিনি বলছেন, যখন থেকে জেনেছি …
এটি বুঝার জন্য আগে তাঁর আরেকটি কথা শুনুন, তিনি বলতেন,
أرجو أن ألقَى الله ولا يحاسبني أني اغتبت أحداً .
আমি আশা রাখি, আমি যখন আল্লাহর সামনে হাজির হবো, তখন তিনি এ ব্যাপারে আমার থেকে কোন হিসাব নেবেন না যে, আমি কারো গীবত করেছি।
এর মানে, গীবত করা যে হারাম, বিষয়টি জানার পর থেকে সারাজীবন তিনি এর ওপর আমল করেছেন। ইলম অনুযায়ী আমল করার ব্যাপারে কেমন অবিচলতা ছিল আমাদের পূর্ববর্তীদের। যা কল্পনাকেও হার মানায়। আর আমরা কী করছি? প্রতিদিন আমরা কত আয়াত পড়ি, কত হাদিস, কত নসিহা শুনি, কিন্তু আমাদের পরিবর্তন হয় না। এক দুদিন যেতে না যেতেই সব ভুলে যাই। অথচ, কত মূল্যবান কথা পড়েছিলাম, শুনেছিলাম! যদি তাঁদের মতো ওগুলোকে অন্তরে গেঁথে নিতাম, সারা শরীরে মাখিয়ে নিতাম, তাহলে যা-ই শুনতাম, যা-ই বলতাম, যা-ই পড়তাম সবই থাকত, কিছুই ঝরে পড়ত না।
“হে আল্লাহ! তোমার নিকট আশ্রয় চাই এমন ইলম থেকে যে ইলম কোনো উপকার দেয় না, এমন হৃদয় থেকে যে হৃদয় বিনম্র হয় না, এমন আত্মা থেকে যে আত্মা পরিতৃপ্ত হয় না এবং এমন দোয়া থেকে, যে দোয়া কবুল হয় না’ (মুসলিম: ২৭২২)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে ইলম অর্জনের পর সেগুলোর ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

