কেয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে ‘দাব্বাতুল আরদ’ নামে এক অদ্ভুত জন্তু জমিন থেকে বের হবে। মানুষের সঙ্গে কথা বলবে জন্তুটি। এটি কেয়ামতের শেষ নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম।
আরবিতে ‘দাব্বাতুন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে জন্তু বা প্রাণী, যা জমিনে পা ফেলে চলাচল করে। আর ‘আরদ’ অর্থ হচ্ছে ভূপৃষ্ঠ বা ভূগর্ভ। কেয়ামতের আগে জমিন থেকে বের হয়ে পুরো পৃথিবীতে বিচরণ করবে জন্তুটি। মূলত ‘দাব্বাতুল আরদ’ তার নাম নয় বরং অদ্ভুত প্রাণী প্রসঙ্গে কোরআনে ব্যবহৃত শব্দ, যার অর্থ ‘ভূগর্ভস্থ প্রাণী’। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন—
বিজ্ঞাপন
‘ওই সময় আসার আগ পর্যন্ত কেয়ামত সংগঠিত হবে না, যতদিন না পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় হবে। পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়ের ঘটনার পর মানুষ দাব্বাতুল আরদ দেখতে পাবে।’ (বুখারি: ৪৬৩৬; মুসলিম: ১৫৭)
সহিহ হাদিস অনুযায়ী, পশ্চিম আকাশে সূর্য উঠার কিছুক্ষণ পরই এই জানোয়ারটি বের হয়ে আসবে। তাওবার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে—এ কথাটিকে প্রমাণ করার জন্য সে নির্দিষ্ট চিহ্নের মাধ্যমে মুমিনদেরকে কাফের থেকে আলাদা করে ফেলবে। মুমিনের কপালে লিখে দেবে ‘মুমিন’, আর কাফেরের কপালে লিখে দেবে ‘কাফের’। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে—
وَإِذَا وَقَعَ الْقَوْلُ عَلَيْهِمْ أَخْرَجْنَا لَهُمْ دَابَّةً مِّنَ الْأَرْضِ تُكَلِّمُهُمْ أَنَّ النَّاسَ كَانُوا بِآيَاتِنَا لَا يُوقِنُونَ
‘যখন প্রতিশ্রুতি (কেয়ামত) সমাগত হবে, তখন আমি তাদের সামনে ভূগর্ভ থেকে একটি জীব নির্গত করব। সে মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। এ কারণে যে মানুষ আমার নিদর্শনসমূহে বিশ্বাস করত না।’ (সূরা নামল: ৮২)
প্রাণীটির কাজ কী হবে এবং কী বিষয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলবে— এ ব্যাপারে আল্লামা আলূসি (রহ) বলেন, আয়াতে উল্লেখিত কোরআনের বাণীটিই হবে তার কথা। ‘ইন্নান নাসা কানু বি আয়াতিনা লা ইউক্বিনুন’ এই বাক্যটি সে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে শোনাবে। এর মর্ম- আজকের আগে অনেক মানুষই মহান আল্লাহর আয়াত ও নিদর্শনসমূহে বিশ্বাস করেনি। বিশেষ করে কেয়ামতের আলামত ও তা সংঘটিত হওয়ার বিষয়ে এমনকি আমার আগমনের বিষয়েও অনেক মানুষ বিশ্বাস করত না। এখন সে সময় এস গেছে এবং আমিও বের হয়ে এসেছি।
বিজ্ঞাপন
দাব্বাতুল আরদ সম্পর্কে হাদিস থেকে আরও তথ্য
(১) সহিহ মুসলিমে হুজাইফা (রা.) বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (স.) বললেন, ‘কেয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না দশটি নিদর্শন তোমরা দেখতে পাবে, (যথা) পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়া, ধোঁয়া বের হওয়া, দাজ্জালের আবির্ভাব, মরিয়ম তনয় ঈসার আগমন, ভূগর্ভ থেকে জন্তু বের হওয়া..।’ (মুসলিম: ২৮৯৯; মুসনাদে আহমদ: ৩৬৪৩)।
(২) হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেন, ‘দাব্বাতুল আরদ বের হবে এবং মানুষের নাকে চিহ্ন দেবে। তারপরও মানুষ পৃথিবীতে জীবনযাপন করবে। প্রাণীটি সব মানুষের নাকেই দাগ লাগিয়ে দেবে। এমনকি উট ক্রয়কারীকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তুমি এটি কার কাছ থেকে ক্রয় করেছ? সে বলবে, ‘আমি এটি নাকে দাগ লাগানো অমুক ব্যক্তির কাছ থেকে ক্রয় করেছি।’ (মুসনাদে আহমদ: ৩২২)
(৩) নবী (স.) আরো বলেন, ‘দাব্বাতুল আরদ বের হবে। তার সঙ্গে থাকবে মুসা (আ.) এর লাঠি এবং সুলায়মান (আ.)-এর আংটি। কাফিরের নাকে সুলায়মান (আ.)-এর আংটি দিয়ে দাগ লাগাবে এবং মুসা (আ.)-এর লাঠি দিয়ে মুমিনের চেহারাকে উজ্জ্বল করে দেবে। লোকেরা খাওয়ার টেবিল ও দস্তরখানায় বসেও একে অপরকে বলবে, হে মুমিন! হে কাফির! (আহমদ-আহমদ শাকের সহিহ বলেছেন, হা: ৭৯২৪)
(৪) ‘আকাশে আলো ফোটার পর মানুষ যখন বাইরে বের হবে তখন দুপুরের দিকে কাবাগৃহের পূর্বদিকে অবস্থিত সাফা পাহাড় ভূমিকম্পে ফেটে যাবে। তখন সেখানকার জমিনের ভেতর থেকে দাব্বাতুল আরদ বের হবে। (মুসলিম: ২৯৪১)
দাব্বাতুল আরদ বের হওয়ার সময়কাল
বিশ্ববিখ্যাত মুফাসসির ইবনে কাসির বলেন, শেষ জামানায় মানুষ যখন নানা পাপাচারে লিপ্ত হবে, মহান আল্লাহর আদেশ পালন বর্জন করবে এবং দ্বীনকে পরিবর্তন করবে, তখন আল্লাহ তাআলা তাদের সামনে এই জন্তুটি বের করবেন।’ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘জন্তুটি মানুষের মতোই কথা বলবে’। (তাফসিরে ইবনে কাসির: ৩/৩৫১)
কেয়ামতের বড় কয়েকটি আলামত ঘটে যাওয়ার পর এক বছর জিলহজ মাসের কোরবানির ঈদের দিবাগত রাত এত দীর্ঘ হতে থাকবে যে, সফররত ব্যক্তিরা উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়বে, শিশুরা ঘুমাতে ঘুমাতে ক্লান্ত হয়ে জেগে উঠবে, গবাদি পশুরা চারণভূমিতে বের হতে ছটফট শুরু করবে, লোকেরা ভয়ে ও আতঙ্কে চিৎকার করে কান্নাকাটি ও দোয়া-তওবা করতে থাকবে। এভাবে তিন-চার দিন সময় পরিমাণ দীর্ঘ রাতের অবসান ঘটিয়ে চন্দ্রগ্রহণের মতো টিমটিমে আলো নিয়ে পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হবে। এই নিদর্শন প্রকাশ পাওয়ার পর পৃথিবীর সব মানুষ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করবে এবং তাওবা করবে। কিন্তু তখন ঈমান ও তওবা আর কবুল করা হবে না। (ফাতহুল বারি: ১১/৩৫৩)
প্রাণীটির ধরণ?
‘দাব্বাতুল আরদ’ বা অদ্ভুত প্রাণীটির আকৃতি প্রসঙ্গে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন হাদিস পর্যালোচনায় দেখা যায়, এর ভেতর অনেক প্রাণীর বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকবে। অদ্ভুত এই প্রাণী কিছুটা উটের মতো হবে। পা হবে চারটি। মাথা হবে ষাঁড়ের মতো। চোখ হবে শূকরের মতো। কান হবে হাতির মতো। নাক হবে উটপাখির মতো। বুক হবে সিংহের মতো। রং হবে নেকড়ের মতো। কপাল হবে ভেড়ার মতো। ঘন পশমবিশিষ্ট হবে। মানুষের মতো চেহারা হবে। (ফাতহুল কাদির: ৪/১৫২; আদ-দুররুল মানসুর: ৬/৩৭৮)।
প্রাণীটি কোন শ্রেণির
এ নিয়ে আলেমরা মতভেদ করেছেন। ১) ইমাম কুরতুবী বলেন, এটি হবে সালেহ (আ.) এর উটনীর বাছুর। যখন কাফেররা উটনীকে হত্যা করে ফেলল, তখন বাছুরটি পাথরের মাঝে ঢুকে পড়েছিল। এটি আল্লহ তাআলার অনুমতিক্রমে কেয়ামতের পূর্বে বের হয়ে আসবে। ইমাম কুরতুবী বলেন, এটিই বিশুদ্ধ মত। তার একথা গ্রহণযোগ্য নয় বলেছেন অনেক মুফাসসির। কারণ তিনি যে হাদিস দিয়ে দলিল গ্রহণ করেছেন, তার সনদে এমন একজন রাবি (বর্ণনাকারী) আছেন, যার বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়।
(২) কেউ কেউ বলেছেন, এটি হবে দাজ্জালের হাদিসে বর্ণিত জাস্সাসা (গোয়েন্দা)। এ মতটিও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ দাজ্জালের হাদিসে যে প্রাণীর কথা এসেছে, তার নাম জাস্সাসা। আর কেয়ামতের পূর্বে যে প্রাণীটি বের হবে তার নাম দাব্বাতুল আরদ, যা কোরআনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, শায়খ আহমদ শাকের (রহ) মুসনাদে আহমদের ব্যাখ্যায় বলেন, কোরআনের আয়াতে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায় বলা আছে- এটি হলো দাব্বাতুল আরদ। দাব্বা অর্থ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কোনো প্রকার ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই; বরং আমরা বিশ্বাস করি আখেরি জামানায় একটি অদ্ভুত ধরণের জন্তু বের হবে। সে মানুষের সাঙ্গে কথা বলবে। কোরআন ও সহিহ হাদিসে তার গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। আমরা তাতে বিশ্বাস করি।
(৩) কেউ কেউ বলেছেন, এটি হলো সেই সাপ, যা পবিত্র কাবার দেয়ালে ছিল। কুরাইশরা যখন কাবাঘর নির্মাণ করার ইচ্ছা পোষণ করল, তখন সাপটিই তাদের নির্মাণ কাজ শুরু করতে মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেল। একটি পাখি এসে সাপটিকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেলে নির্মাণ কাজের বাধা দূর হয়ে যায়। কিন্তু এ কথার পক্ষেও কোনো দলিল নেই। এমনি আরো অনেক কথা বর্ণিত আছে। এগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ কোনো একটি মতের স্বপক্ষে সহিহ কোনো দলিল পাওয়া যায় না।
পৃথিবীর কোথা থেকে বের হবে?
(১) এটি বের হবে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে সম্মানিত মসজিদ থেকে। ইবনে উমর (রা.) বলেন, সাফা পাহাড় ফেটে প্রাণীটি বের হবে। তিনি বলেন, আমি যদি চাইতাম তাহলে যে স্থানটি থেকে বের হবে, তাতে পা রেখে দেখাতে পারতাম।’ (তাফসীরে কুরতুবী-১৩/২৬৩, তাবারানী ফিল আওসাত-২/১৭৬)
(২) জন্তুটি তিনবার বের হবে। প্রথমে বের হবে কাবাঘর হতে দূরবর্তী একটি গ্রাম থেকে। অতঃপর কিছু দিন লুকিয়ে থাকার পর আবার বের হবে। পরিশেষে কাবা ঘর থেকে বের হবে।
এ ব্যাপারে আরো কথা বর্ণিত আছে। সব মিলিয়ে আমরা বলা যায়, মক্কা থেকে দাব্বাতুল আরদ বের হবে। অতঃপর সমগ্র পৃথিবীতে ভ্রমণ করবে।
পরবর্তী পৃথিবীর অবস্থা
দাব্বাতুল আরদ তার কাজ শেষ হওয়ার পর অদৃশ্য হয়ে যাবে। এরপর আল্লাহ তায়ালা ইয়েমেনের দিক থেকে রেশমের মতো মোলায়েম একটি বাতাস প্রবাহিত করবেন। যার অন্তরে সামান্য পরিমাণও ঈমান থাকবে তার শরীরে এই বাতাস স্পর্শ করবে। ফলে সব ঈমানদার ব্যক্তির ইন্তেকাল হয়ে যাবে। তারপর পৃথিবীতে শুধু নিকৃষ্ট লোকেরা থাকবে। তাদের ওপর কেয়ামত কায়েম হবে। (মুসলিম: ১১৭, ১৯২৪)
অন্য হাদিসে এসেছে, পৃথিবীতে তখন শুধু নিকৃষ্ট আর পাপাচারী লোকেরা থাকবে। তাদের জীবনযাত্রা অত্যন্ত সুখময় হবে। পাখির মতো ক্ষিপ্র থাকবে তাদের গতি। পশু-পাখির মতো স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে। কোনো কল্যাণকর কাজ তারা করবে না। কেউ কোনো মন্দ কাজ করলে বারণ করবে না। তখন শয়তান তাদের সামনে মানুষের আকৃতিতে এসে বলবে আমি তোমাদের যা করতে বলব তোমরা কি তা করবে না? লোকেরা বলবে, তুমি আমাদেরকে কী করতে বলো? তখন শয়তান তাদের মূর্তিপূজার আদেশ করবে। সে যুগে মানুষের প্রাচুর্য ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অনেক বৃদ্ধি পাবে। অতঃপর শিঙ্গায় ফুক দেওয়া হবে। (মুসলিম : ২৯৪০)
অন্য একটি হাদিসে এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয় ও দাব্বাতুল আরদের আবির্ভাবের পর পৃথিবী আরও ১২০ বছর অবশিষ্ট থাকবে। (ফাতহুল বারি: ৩৬১)
এ কথা ধ্রুব সত্য যে, পৃথিবী একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে কেয়ামতের ছোট ছোট অনেক আলামত প্রকাশিত হয়েছে বলে আলেমরা একমত। শিগগির বড় আলামতগুলো প্রকাশিত হবে এক এক করে। তাই আমাদের এখনই সতর্ক হওয়া উচিত। নানাবিধ ফেতনা থেকে বেঁচে থাকার জন্য চেষ্টা করা উচিত। পরিবার-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশী, দেশবাসী সবাইকে নেক আমলের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা উচিত। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তাওফিক দান করুন। আমিন।

