সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ইসলামি নির্দেশনা মেনে চলুন

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০ অক্টোবর ২০২২, ১১:৫২ এএম

শেয়ার করুন:

মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ইসলামি নির্দেশনা মেনে চলুন

মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ইসলামে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনা। শারীরিক অসুস্থতায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া এবং প্রতিষেধক দ্রব্য গ্রহণ করা হয়। কিন্তু মনের অবকাঠামোগত কোনো বাহ্যিক আকৃতি না থাকায় মানসিক অসুখের সুস্থতার ক্ষেত্রে তা খুব একটা দেখা যায় না। নিচে মানসিক নানা অসুস্থতা, কারণ এবং কোরআন-সুন্নাহর আলোকে তার প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হলো।

নেতিবাচক চিন্তাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না
মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার মূলে রয়েছে ব্যক্তির নেতিবাচক চিন্তা। মানবতার ধর্ম ইসলাম মানসিক রোগের মূলকে উৎপাটন করে। যে বিষয়ের চিন্তা-ভাবনা করা ক্ষতিকর কিংবা যে বিষয়ের চিন্তা-ভাবনায় হতাশা ও বিষণ্ণতা বাড়ে, ইসলাম সে বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে নিষেধ করেছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমাদের মনে যা আছে, তোমরা তা প্রকাশ করো অথবা গোপন রাখো, আল্লাহ তার হিসাব তোমাদের কাছ থেকে গ্রহণ করবেন।’ (সুরা বাকারা: ২৮৪)


বিজ্ঞাপন


পরিমিত খাবারগ্রহণ
শারীরিক সমস্যা থেকেও মানসিক অসুস্থতার সৃষ্টি হয়। অতি ভোজন ও অখাদ্য গ্রহণ শারীরিক অসুস্থতার অন্যতম কারণ। তাই বান্দার সুস্থতা রক্ষায় আল্লাহ তাআলা খাদ্যগ্রহণের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘..খাও ও পান করো, তবে অপচয় করোনা। কেননা তিনি আপচয়কারীদেরকে অপছন্দ করেন।’ (সুরা আরাফ: ৩১)

আয়াতের ভাষ্য অনুযায়ী খাদ্য ও পানীয় গ্রহণে মুসলমানের নীতি হবে, মনের চাহিদায় নয় বরং শরীরের চাহিদা অনুযায়ে খাবে; যাতে সে দুনিয়ার পেশাগত কার্যক্রম ও ইবাদত বন্দেগী স্বাভাবিকভাবে করতে পারে। পক্ষান্তরে অমুসলিমদের স্বভাব হবে- সে মনের চাহিদা পূরণে খাবার গ্রহণ করবে। এইদিকে ইশারা করে প্রিয়নবী (স.) বলেন, ‘মুমিন এক পেটে খায়, আর কাফের ও মুনাফিক সাত পেটে খায়।’ (বুখারি: ৫৩৯৪) 

ভোগবাদিতা বর্জন
যে সুস্থতা চাইবে সে যেন পেট ভর্তি না করে এবং মানুষকে খাওয়ায়। এতেই তার মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত হবে। মিকদাম বিন মাদিকারিব (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসুল (স.)-কে বলতে শুনেছি, পেটের চেয়ে মন্দ কোনো পাত্র মানুষ ভরাট করে না। পিঠের দাঁড়া সোজা রাখার মতো কয়েক লোকমা খাবারই আদম সন্তানের জন্য যথেষ্ট। আরও বেশি ছাড়া যদি তা সম্ভব না হয়, তবে পেটের এক তৃতীয়াংশ খানার জন্য; এক তৃতীয়াংশ পানির জন্য; আরেক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে। (তিরমিজি: ২৩৮০)
রাসুল (স.) বলেছেন, যে লোক তার কোনো মুসলিম ভাইয়ের অভাব পূরণের চেষ্টা করে মহান আল্লাহ তার অভাব পূরণ করবেন। (মুসলিম: ২৬৯৯; মেশকাত: ২০৪)
অন্যত্র তিনি আরো বলেছেন, ‘যে লোক কোনো গরীবের চলার পথ সহজ করে দেয় ইহকালে ও পরকালে মহান আল্লাহ তার চলার পথ সহজ করে দিবেন।’ (আবুদাউদ: ২৫৯৪; তিরমিজি: ১৭০২; নাসায়ি: ৩১৭৯)

বিষণ্ণ হওয়া যাবে না
এমন কোনো বিষয়ে মনে মনে চিন্তা করা যাবে না, যার কারণে মানসিক অবসাদ আসতে পারে। সেটার জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। পড়াশোনায় অকৃতকার্য, কর্মক্ষেত্রে অস্থিরতা, উপার্জনে অক্ষমতা, দাম্পত্য জীবনে অসুখী, নিঃসন্তান থাকা এবং কাঙ্ক্ষিত বস্তু অর্জন করতে না পারা প্রভৃতি বিষয়ে ব্যর্থ হয়ে মানুষ ভয়ঙ্কর রকমের বিষণ্ণতায় ভোগে। অথচ কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘বিষণ্ণ হয়ো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ সঙ্গে আছেন।’ (সুরা তওবা: ৪০)


বিজ্ঞাপন


মানুষকে কষ্ট দেওয়া যাবে না
মানুষকে কষ্ট দেওয়া হারাম। তা শারীরিক হোক কিংবা মানসিক। কাউকে কষ্ট দিলে এর বোঝা মূলত নিজেকেই ভোগ করতে হয়; ইহকাল কিংবা পরকালে। তাই নিজের মন সুস্থ সবল রাখতে পরকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা বিনা অপরাধে বিশ্বাসী পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সুরা আহজাব: ৫৮)

অনুগত বান্দা হওয়ার প্রশিক্ষণ
যাবতীয় সুখ শান্তির মূলে রয়েছে আল্লাহ ও রাসুলের (স.) আনুগত্য। যে বান্দা তাঁর মালিকের অনুগত, প্রভূত কল্যাণ তারই। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো, যেন তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।’ ( সুরা আলে ইমরান: ১৩২)

ক্ষমার গুণ অর্জন
যে ব্যক্তি ক্ষমা করার গুণ যে অর্জন করতে পারে, তার কোনো মানসিক অবসাদ থাকে না। বরং তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘সদকা করলে সম্পদের ঘাটতি হয় না। যে ব্যক্তি ক্ষমা করে, আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আর কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনীত হলে, তিনি তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।’(মুসলিম: ২৫৮৮)

অল্পতে তুষ্ট থাকার প্রশিক্ষণ
যতই ধনী হোন বা জীবন প্রাচুর্যময় হোক অল্পতে তুষ্ট থাকার গুণ অর্জন করতে না পারলে জীবনের কোনো স্বাদই পাবেন না। আসল কল্যাণ ও সফলতা নিহিত অল্পে তুষ্টিতে। অন্যথায় মানসিক অসুস্থতা শুরু হবে এবং জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলামের দিকে হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়েছে, যাকে প্রয়োজন মাফিক রিজিক প্রদান করা হয়েছে এবং যে তাতেই পরিতুষ্ট থাকে, সে-ই সফলকাম হয়েছে। (ইবনে মাজাহ: ৪১৩৮)

তাই অল্পে তুষ্ট হওয়ার শক্তি অর্জন করতে হবে। যেকোনো দুঃখ-কষ্ট ও অভাব-অনটনে মনোবল অটুট রাখতে হবে। সবসময় হৃদয়ে প্রশস্ততা অনুভব করার অভ্যাস করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, প্রকৃত ধনী আত্মার ধনী। (বুখারি: ৬৪৪৬)

এই হাদিসের একটি শিক্ষা হচ্ছে, আল্লাহ যা দিয়েছেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকতে পারলেই আসল শান্তি মিলবে। সম্পদশালী না হয়েও সম্পদশালীর সুখ অর্জিত হবে। এরপর আল্লাহ তাআলাও সেই বান্দাকে বাড়িয়ে দেওয়া শুরু করবেন। মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় করো, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেবো...।’ (সুরা ইবরাহিম: ৭)

দুনিয়ার চেয়ে আখেরাতকে প্রাধান্য দেওয়া
আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি তোমাদের নবী (স.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি তার সব চিন্তাকে একই চিন্তায় অর্থাৎ আখেরাতের চিন্তায় কেন্দ্রীভূত করেছে, আল্লাহ তার দুনিয়ার চিন্তার জন্য যথেষ্ট। অন্যদিকে যে ব্যক্তি যাবতীয় পার্থিব চিন্তায় নিমগ্ন থাকবে, সে যেকোনো উন্মুক্ত মাঠে ধ্বংস হোক, তাতে আল্লাহর কিছু আসে যায় না। (ইবনে মাজাহ: ২৫৭)

হাদিস অনুযায়ী, দুনিয়ার পেছনে লেগে পড়লে সফলতা আসবে না। ফলে হতাশা বেড়ে যাবে। উপরন্তু দারিদ্র্যও পিছু ছাড়বে না। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তির একমাত্র চিন্তার বিষয় হবে পরকাল, আল্লাহ সেই ব্যক্তির অন্তরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন এবং তার যাবতীয় বিচ্ছিন্ন কাজ একত্র করে সুসংহত করে দেবেন, তখন তার কাছে দুনিয়াটা নগণ্য হয়ে দেখা দেবে। আর যে ব্যক্তির একমাত্র চিন্তার বিষয় হবে দুনিয়া, আল্লাহ তাআলা সেই ব্যক্তির গরিবি ও অভাব-অনটন দুই চোখের সামনে লাগিয়ে রাখবেন এবং তার কাজগুলো এলোমেলো ও ছিন্নভিন্ন করে দেবেন। তার জন্য যা নির্দিষ্ট রয়েছে, দুনিয়ায় সে এর চেয়ে বেশি পাবে না।’ (তিরমিজি: ২৪৬৫)

গুনাহ ছেড়ে দিতে হবে
গুনাহ করতে করতে অন্তর মরে যায়। ইবাদতের স্বাদ পাওয়া যায় না। হতাশা দানা বেঁধে ওঠে। খারাপ প্রভাব পড়ে পরিবারে। রিজিক সংকুচিত হয়ে যায়। সুতরাং গুনাহ মানসিক অসুস্থতার অন্যতম কারণ। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে গুনাহের অভ্যাস ছাড়তে হবে এবং আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে তাওবা করতে হবে। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি— মহান আল্লাহ বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি যত দিন পর্যন্ত আমার কাছে দোয়া করতে থাকবে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে, আমি তত দিন তোমার গুনাহ মাফ করতে থাকব, তুমি যা-ই করে থাকো আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করব না। হে আদম সন্তান! তোমার গুনাহ যদি আকাশের উচ্চতা পর্যন্তও পৌঁছে যায়, অতঃপর তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাও, তবুও আমি তোমাকে ক্ষমা করব, আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করব না। হে আদম সন্তান! তুমি যদি পৃথিবী পরিমাণ গুনাহ নিয়ে আমার কাছে আসো এবং আমার সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক না করে থাকো, তাহলে আমিও সমপরিমাণ ক্ষমা নিয়ে তোমার কাছে আসব। ’ (তিরমিজি: ৩৫৪০)

হিংসা করা যাবে না
হিংসা এমন এক ব্যাধি, যা শুধু মনের নয়, দেহেরও ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। বলা হয়ে থাকে যে, হিংসুক মানুষের কোনো বিশ্রাম (ঘুম) নেই ও সে বন্ধুর লেবাসে একজন শত্রু । হিংসা হিংসুককেই প্রথমে হত্যা করে। তাকে তিলে তিলে ক্ষয় করে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘..বলে দাও, তোমাদের আক্রোশেই তোমরা মরো..।’ (সুরা আলে ইমরান: ১১৯)

কোরআন তেলাওয়াত
পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও তাফসির মানসিক শান্তির অন্যতম কারণ। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‌‌‌‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখো, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়।’ (সুরা রা‘দ: ২৮) 

মানসিক অস্থিরতায় দোয়া 
প্রিয়নবী (স.) উম্মতকে মানসিক অসুস্থতা অস্থিরতা ও ঋণমুক্তির জন্য একটি দোয়া পড়তে বলেছেন। দোয়াটি হলো- اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الهَمِّ وَالحَزَنِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ العَجزِ وَالكَسَلِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ الجُبنِ وَالبُخلِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ غَلَبَةِ الدَّينِ وَقَهْرِ الرِّجَالِ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হুজনি, ওয়া আউজুবিকা মিনাল আজজি ওয়াল কাসালি, ওয়া আউজুবিকা মিনাল জুবনি ওয়াল বুখলি, ওয়া আউজুবিকা মিন গলাবাতিদ দাইনি ওয়া কহরির রিজাল।
অর্থ: হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা থেকে আশ্রয় চাই। আমি আশ্রয় চাই অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, আপনার কাছে আশ্রয় চাই ভীরুতা ও কার্পণ্য থেকে, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই ঋণের বোঝা ও মানুষের রোষানল থেকে। আবু উমামাহ (রা.) বলেন, আমি তা-ই করলাম। ফলে মহান আল্লাহ আমার দুশ্চিন্তা দূর করলেন এবং আমার ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থাও করে দিলেন। (আবু দাউদ: ১৫৫৫)

সুতরাং আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া অব্যাহত রাখতে হবে। তিনিই পারেন বান্দাকে অশান্তিমুক্ত পবিত্র জীবন দিতে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা দান করুন। আল্লাহর অনুগত বান্দা হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর