আল্লাহর ওলিদের থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারামত প্রকাশিত হয়—এ কথা স্বীকৃত। পাশাপাশি এ কথাও স্বীকৃত যে, কারামতের সঙ্গে বুজুর্গির কোনো সম্পর্ক নেই। বরং আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার মাপকাঠি হলো, অন্তরে আল্লাহর ভয় থাকা ও সুন্নত অনুযায়ী জীবন যাপন করা।
অনেকে কারামতের আতিশয্যে নিজেকে অবাস্তব কল্পনার মধ্যে ডুবিয়ে রাখেন। যেমন- তার এক ইশারায় সারাদেশ কেঁপে ওঠলে কতইনা ভালো হতো! তার হস্তক্ষেপে পানিতে আগুন জ্বলে উঠলে বা মুহূর্তে শত মাইল চলে যাওয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে পারলে আর কী-ই বা লাগে! এভাবে নবীজির পবিত্র সুন্নতকেই এক পর্যায়ে ভুলে যান তারা। অথচ শরিয়তের সুস্পষ্ট নির্দেশনা হলো- সুন্নতের অনুসরণ ছাড়া মুক্তির কোনো পথ নেই।
বিজ্ঞাপন
বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-এর কাছে জনৈক ব্যক্তির কারামতের কথা বলা হলো যে, অমুক ব্যক্তি এক রাতে মক্কা শরিফে পৌঁছে গেছেন। তিনি বললেন, এটি কোনো বড় অর্জন নয়। কেননা শয়তানও মুহূর্তেই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে যেতে পারে। তাই কেউ যতই বাতাসে উড়ে দেখাক, আগে পরীক্ষা করে নেবে যে, সে রাসুল (স.)-এর সুন্নতের রাজপথে অবিচল কি না? (বাসায়েরুল আশায়ের পৃষ্ঠা-৬১২)
মুজাদ্দিদে আলফে সানি (রহ.) জনৈক মুরিদকে বলেন যে, ‘কারামতের ঠেলায় জমিন কেঁপে ওঠা বা মৃত ব্যক্তি জীবিত হয়ে যাওয়ার চেয়েও অজুর সময় মিসওয়াকের সুন্নত পালন করা হাজার গুণ উত্তম।’ (ফতোয়ায়ে রহিমিয়া: ২/১৯৫)
সুন্নতের গুরুত্ব বর্ণনায় ফাতহুল বারিতে ইমাম আবু দাউদ (রহ.) এর এক ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। একদা তিনি নৌসফরকালীন একটি জাহাজে ছিলেন। তখন জাহাজ থেকে নদীর পার দিয়ে গমনকারী এক পথিককে হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলতে শুনলেন। তিনি জাহাজ থেকে নেমে এক দিরহামের বিনিময়ে একটি নৌকা ভাড়া করে পারে এসে হাঁচিদাতার উত্তরে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলে এলেন।
এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, আমি তার জবাবে গিয়ে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলায় সে প্রতি-উত্তরে ‘ইয়াহদিকুমুল্লাহ’ (আল্লাহ তোমাকে হেদায়াত দিন) এ দোয়া করেছে, আর লোকটি হতে পারে এমন কেউ, যার দোয়া অবশ্যই কবুল করা হয়। তাহলে তো এটিই আমার সফলতার জন্য যথেষ্ট। অতঃপর ওই রাতে জাহাজের যাত্রীগণ স্বপ্নে দেখল, জনৈক ব্যক্তি ঘোষণা করছে, ‘নিশ্চয়ই আবু দাউদ এক দিরহামের বিনিময়ে জান্নাত ক্রয় করে নিয়েছে।’ (ফাতহুল বারি: ১০/৬১০-৬১১)
বিজ্ঞাপন
আলেমগণ বলেন, আল্লাহর দরবারে আমল কবুল হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত: এক. আকিদা বিশুদ্ধ হওয়া, দুই. সুন্নতের অনুসরণ করা, তিন. নিয়ত সঠিক হওয়া।
‘সুন্নত’ অর্থ প্রকৃতি, জীবনপদ্ধতি, রীতি, আদর্শ ইত্যাদি। এক কথায় ইসলামের আকিদা-বিশ্বাস থেকে শুরু করে ইবাদত, লেনদেন ও শিষ্টাচারসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর জীবনাদর্শই হলো সুন্নত। যদিও এই জীবনাদর্শ ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নতসহ নানা স্তরে বিন্যাস করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সুন্নত বাদ দিয়ে কোনো কিছুতেই মুক্তি নেই। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নত অপছন্দ করল তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই’ (বুখারি: ৪৭৭৬)। নতুন আবিষ্কৃত কোনো ইবাদত দিয়েই বিন্দু পরিমাণ লাভ হবে না।
ইরবাদ ইবনে সারিয়া (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) আমাদের এ মর্মে অন্তিম উপদেশ দিয়েছেন, ‘তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নত এবং আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খলিফাদের সুন্নত কঠোরভাবে অনুসরণ করবে। সাবধান! (দীনি বিষয়ে) নব আবিষ্কার সম্পর্কে! কারণ প্রতিটি নতুন আবিষ্কার হলো বিদআত এবং প্রতিটি বিদআত হলো ভ্রষ্টতা।’ (আবু দাউদ: ৪৬০৭)
রাসুলুল্লাহ (স.) আরও বলেন, ‘আমার সব উম্মতই জান্নাতে প্রবেশ করবে; কিন্তু যে অস্বীকার করবে। সাহাবিরা বললেন, কে অস্বীকার করবে? তিনি বলেন, যারা আমার অনুসরণ করবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্য হবে সে-ই অস্বীকার করবে।’ (বুখারি: ৭২৮০)
অতএব, মহানবী (স.)-এর জীবনকেই আদর্শ হিসেবে নিতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে, তোমাদের মধ্যে যারা পরকালের আশা রাখে এবং আল্লাহকে খুব বেশি করে স্মরণ করে তাদের জন্য রাসুলুল্লাহর জীবনে সর্বোত্তম আদর্শ রয়েছে’ (সুরা আহজাব: ২১)। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘বলো, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমার অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (আলে ইমরান: ৩১)
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে জীবিত করল, সে আমাকেই ভালোবাসল, আর যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসল সে জান্নাতে আমার সঙ্গেই থাকবে।’ (তিরমিজি: ২৬৭৮)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সুন্নতের ওপর অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।