ভুলিয়ে বশ করাকে এক কথায় পটানো বলে। এটি শরিয়তে বৈধ বা অবৈধ হওয়ার সঙ্গে জড়িত উদ্দেশ্য বা নিয়ত। মনে করেন, কোনো মা অনন্যোপায় হয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাঁর ছেলেদের মধ্যে বিবদমান ঝগড়া মিটিয়ে দিয়েছে। এতে গুনাহের কিছু নেই। একইভাবে দুই মুসলিম ভাইয়ের শত্রুতা মেটাতে কোনো মধ্যস্থতাকারী প্রয়োজনে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। এতেও দোষ নেই। অর্থাৎ শুদ্ধ নিয়তের গুরুত্ব আছে ইসলামে।
হজরত আসমা বিনতে ইয়াজিদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘তিন ক্ষেত্র ছাড়া মিথ্যা বলা বৈধ নয়- ১) মানুষের মধ্যে আপস-মীমাংসার জন্য মিথ্যা বলা। ২) যুদ্ধক্ষেত্রে মিথ্যা বলা এবং ৩) স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য মিথ্যা বলা।’ (আবু দাউদ : ৪৯২১)
বিজ্ঞাপন
কিন্তু এখানে যে পটানোর কথা বলা হচ্ছে তা সেরকম কিছু নয়। বরং এ ধরণের কাজের পেছনে কাজ করে খারাপ উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য হতে পারে, প্রেমের সম্মতি আদায় করে গায়রে মাহরামকে বিরহের আগুনে জ্বালানো, প্রলোভনে সম্পদ আদায় করে নেওয়া কিংবা জিনার সুযোগ গ্রহণ করা ইত্যাদি। এর কোনোটিই ইসলামে জায়েজ নেই। বরং এগুলো হচ্ছে প্রতারণা, যা ইসলামে কঠিনভাবে নিষেধ।
প্রতারণা বা ধোঁকাবাজি মুমিনের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে যায় না। এটি মুনাফিকের স্বভাব। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ মুনাফিকদের এই বদ-অভ্যাসটি সম্পর্কে ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ ও মুমিনদের তারা প্রতারিত করে, বস্তুত তারা নিজেদেরই নিজেরা প্রতারিত করছে, অথচ তারা তা বুঝে না। (সুরা বাকারা: ৯)
আখেরাতে প্রতারকের তিন শাস্তি নির্ধারিত। ১) কবিরা গুনাহের শাস্তি। ২) বান্দার হক নষ্ট করার শাস্তি এবং ৩) হাশরবাসীর সামনে লাঞ্ছনার শিকার করা হবে প্রতারককে। এর প্রত্যেকটি শাস্তির শেষ পরিণতি হচ্ছে জাহান্নাম। ব্যভিচার বড় গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। হাদিস অনুযায়ী, ব্যভিচার করার সময় ঈমান চলে যায়। (সহিহ বুখারি: ৬৭৭২)। পবিত্র কোরআনে ব্যভিচারের দিকে অগ্রসর হতেও নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ৩২)
বান্দার হক নষ্ট করার কঠিন পরিণতি বর্ণিত এসেছে হাদিসে। রাসুল (স.) সাহাবাদের কাছে জানতে চাইলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে নিঃস্ব গরিব?’ সাহাবিরা বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! যার কোনো টাকা-পয়সা নেই।’ রাসুল (স.) বললেন, ‘না। প্রকৃত গরিব ওই ব্যক্তি, যে কেয়ামতে পাহাড়সম নেকি নিয়ে উঠবে; কিন্তু সে জাহান্নামে যাবে। কারণ সে দুনিয়ায় কাউকে গালি দিয়েছিল, প্রতারণা করেছিল, অন্যের হক নষ্ট করেছিল ইত্যাদি। কেয়ামতের মাঠে ওইসব লোক তার কাছে পাওনা দাবি করবে। বিনিময়ে সে নিজের সব নেকি দিতে বাধ্য হবে। নেকি শেষ হলে তার কাছে দেওয়ার মতো আর কিছু থাকবে না। তখন সে পাওনাদারদের পাপের বোঝা নিজের মাথায় নিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (মুসলিম : ৬৩৪৩)
বিজ্ঞাপন
ধোঁকাবাজের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর স্পষ্ট ঘোষণা- ‘যে প্রতারণা করে, সে আমার দলভুক্ত নয়’ (মুসলিম: ১০২)। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ওপর জুলুম করেছে সে যেন আজই মাফ চেয়ে নেয়, তার ভাইয়ের জন্য তার কাছ থেকে নেকি কর্তন করে নেওয়ার আগে। কেননা সেখানে (হাশরের ময়দানে) কোনো দিনার বা দিরহাম পাওয়া যাবে না। তার কাছে যদি নেকি না থাকে তবে তার (মজলুম) ভাইয়ের গুনাহ এনে তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে।’ (বুখারি: ৬৫৩৪)
ছেলে বা মেয়ে পটানোর শেষটা যদি হয় ধর্ষণের মাধ্যমে, তাহলে তার পরিণতি হবে আরও ভয়াবহ। যে গুনাহে দুই প্রকার ক্ষমা আবশ্যক। ১) আল্লাহর ক্ষমা ২) ভুক্তভোগীর ক্ষমা। আল্লাহর ক্ষমা আন্তরীক তাওবার মাধ্যমে পাওয়া যায়, কিন্তু এক্ষত্রে বান্দার ক্ষমা পাওয়া সহজ নয়। আর যতক্ষণ না বান্দার হক নষ্টের ক্ষমা মিলবে না, ততক্ষণ ওই গুনাহের মাফ নেই। ইমাম আবু হানিফাসহ অনেক ইসলামি আইনজ্ঞ ধর্ষণের শাস্তি জিনার অনুরূপ বললেও ইমাম মালেকের মতে, ধর্ষককে ব্যভিচারের শাস্তি প্রয়োগের পাশাপাশি ‘মুহারাবা’র শাস্তিও প্রয়োগ করতে হবে। তা না হলে ধর্ষণের শাস্তি পুরোপুরি আদায় হবে না।
মুরাহাবা হচ্ছে—ব্যভিচারের শাস্তির সঙ্গে আরও চার শাস্তি যোগ হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলার ঘোষণা—
‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাথে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে- তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলীতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে (ডান হাত বাম পা/বাম হাত ডান পা) কেটে দেয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার তথা নির্বাসিত করা হবে। ‘এটি হল তাদের জন্য দুনিয়ার লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি।’ (সুরা মায়েদা: ৩৩)
এ আয়াতের আলোকে বিচারক ধর্ষণকারীকে ব্যভিচারের শাস্তির সঙ্গে উল্লেখিত চার ধরণের যে কোনো শাস্তি প্রয়োগ করতে পারবে।
মনে রাখতে হবে, মেয়ে পটানো বা ছেলে পটানোর উদ্দেশ্য যদি হয় বিয়ে করা, তাহলেও গুনাহগার হতে হবে। অর্থাৎ কেউ যদি বিয়ে করার নেক উদ্দেশ্যে ভুলিয়ে ভালিয়ে গায়রে মাহরমকে বশ করতে চায়, তা-ও শরিয়তের দৃষ্টিতে হারাম। কারণ শরিয়তে এই কাজটিও ব্যভিচার হিসেবে পরিগণিত। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, চোখের ব্যভিচার হলো (বেগানা নারীকে) দেখা, জিহ্বার ব্যভিচার হলো (তার সঙ্গে) কথা বলা (যৌন উদ্দীপ্ত কথা বলা)। (বুখারি: ৬২৪৩)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, দুই চোখের ব্যভিচার হলো (বেগানা নারীর দিকে) তাকানো, কানের ব্যভিচার যৌন উদ্দীপ্ত কথা শোনা, মুখের ব্যভিচার আবেগ উদ্দীপ্ত কথা বলা, হাতের ব্যভিচার (বেগানা নারীকে খারাপ উদ্দেশ্যে) স্পর্শ করা আর পায়ের জিনা ব্যভিচারের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হওয়া এবং মনের ব্যভিচার হলো চাওয়া ও প্রত্যাশা করা। (মেশকাত: ৮৬)
তাই ইসলামি দিক-নির্দেশনা হলো—নারী-পুরুষ উভয়ে অবৈধ সংস্পর্শ, হাসাহাসি, রসিকতা, কথা-বার্তা, দেখা-সাক্ষাৎ থেকে বেঁচে থাকবে; নিজেদের দীন ও আত্মসম্মান রক্ষা করবে।
স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্য বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া বা ভালো লাগাকে প্রশ্রয় দেওয়া নাজায়েজ হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, এতে মানুষ নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারে। অর্থাৎ বিষয়টির ওপর মানুষের হাত নেই। আগে থেকে কেউ বলতে পারবে না যে, সে গুনাহের কাজে লিপ্ত হবে না। এই কারণেই রাসুল (স.)-ও আপন স্ত্রীদের পালা বণ্টন করে বলেছেন, ‘হে আল্লাহ, আমার যতটুকু সাধ্য ছিল, আমি ইনসাফ করার চেষ্টা করেছি, আর যে বিষয়টি আমার সাধ্যে নেই (অর্থাৎ কোনো স্ত্রীর প্রতি বেশি ভালোবাসা), সে বিষয়ে আমাকে ভর্ৎসনা করবেন না।’ (সুনানে তিরমিজি: ৩/১৮৫, হাদিস নং ১১৪০, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ৪/৪১৪)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ধোঁকাবাজি করা ও এর শিকার হওয়া থেকে হেফাজত করুন। পবিত্র জীবন যাপন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

