কোরআনুল কারিমের ১৬ পারার শুরুতে আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা (আ.) ও হজরত খিজির (আ.)-এর এক চমৎকার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। যা সুরা কাহাফের শেষাংশে বর্ণিত হয়েছে। এ ঘটনা এক বিশেষ জ্ঞানী ব্যক্তিকে নিয়ে, যিনি মুসা (আ.)-এর চেয়েও বেশি জ্ঞানী ছিলেন।
হাদিসে এসেছে, একদিন মুসা (আ.) বনি ইসরাইলের এক সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলেন- মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী কে? মুসা (আ.) বললেন, আমিই সবার চেয়ে বেশি জ্ঞানী। এই উত্তরের কারণ ছিল- মুসা (আ.)-এর জানামতে, আল্লাহ তাআলা তাঁকেই বেশি জ্ঞান দিয়েছেন। কিন্তু মহান আল্লাহ মুসা (আ.)-এর এই উত্তর পছন্দ করলেন না। এখানে বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়াই ছিল আদব। অর্থাৎ মুসা (আ.)-এর এ কথা বলা উচিত ছিল যে, আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন, কে অধিক জ্ঞানী।
বিজ্ঞাপন
এ ঘটনার প্রেক্ষিতে মুসা (আ.)-এর কাছে ওহি নাজিল হলো যে, দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে অবস্থানকারী আমার এক বান্দা আপনার চেয়ে বেশি জ্ঞানী। এ কথা শুনে মুসা (আ.) তাঁর (খিজির আ.) কাছ থেকে জ্ঞান লাভের প্রার্থনা জানালেন। বললেন, হে আল্লাহ! আমাকে তার ঠিকানা বলে দিন। আল্লাহ তাআলা বললেন, থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে নিন এবং দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলের দিকে সফর করুন। যেখানে পৌঁছার পর মাছটি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে, সেখানেই আমার এই বান্দার সাক্ষাৎ পাবেন। মুসা (আ.) নির্দেশমতো থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন। সাথে তাঁর খাদেম ইউশা ইবনে নূনও ছিলেন।
পথিমধ্যে প্রস্তরখণ্ডের উপর মাথা রেখে তাঁরা ঘুমিয়ে পড়লেন। এখানে হঠাৎ মাছটি নড়াচড়া করতে লাগল এবং থলে থেকে বের হয়ে সমুদ্রে চলে গেল। (মাছটি জীবিত হয়ে সমুদ্রে যাওয়ার সময় আরো একটি মুজেজা প্রকাশ পেল যে,) মাছটি সমুদ্রের যে পথ দিয়ে চলে গেল, আল্লাহ তাআলা সে পথে পানির স্রোত বন্ধ করে দিলেন। ফলে সেখানে পানির মধ্যে একটি সুড়ঙ্গের মতো হয়ে গেল। ইউশা ইবনে নূন এই আশ্চর্যজনক ঘটনা দেখছিলেন।
মুসা (আ.) যখন ঘুম থেকে জাগলেন, তখন ইউশা ইবনে নুন আশ্চর্যজনক ঘটনাটি তাঁকে বলতে ভুলে গেলেন এবং সেখান থেকে তাঁরা সামনে রওনা হয়ে গেলেন। পূর্ণ একদিন একরাত সফর করার পর সকাল বেলা মুসা (আ.) খাদেমকে বললেন, আমাদের নাশতা আনো; যথেষ্ট ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। নাশতা চাওয়ার পর ইউশা ইবনে নূনের মাছের ঘটনা মনে পড়ে গেল। তিনি ভুলে যাওয়ার ওজর পেশ করে বললেন, শয়তান আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল।
অতঃপর বললেন, মৃত মাছটি জীবিত হয়ে আশ্চর্যজনকভাবে সমুদ্রে চলে গেছে। তখন মুসা (আ.) বললেন, সে স্থানটিই তো আমাদের লক্ষ্য ছিল। (অৰ্থাৎ মাছের জীবিত হয়ে নিরুদ্দেশ হওয়ার স্থানটিই ছিল গন্তব্যস্থল।) সে মতে তৎক্ষণাৎ তাঁরা ফিরে চললেন এবং স্থানটি পাওয়ার জন্য পূর্বের পথ ধরেই চললেন।
বিজ্ঞাপন
প্রস্তরখণ্ডের নিকট পৌঁছে দেখলেন, এক ব্যক্তি আগাগোড়া চাদরে আবৃত হয়ে শুয়ে আছেন। হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ বুখারিতে এ ব্যক্তির নাম 'খাদর' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যার অর্থ হলো 'সবুজ-শ্যামল'। অর্থাৎ তিনি যেখানে বসতেন, সে স্থানই সবুজ শ্যামল হয়ে যেতো। মুসা (আ.) তাঁকে সালাম করেন। খিজির (আ.) বললেন, এই (জনমানবহীন) প্রান্তরে সালাম কোথা থেকে এলো? মুসা (আ.) বললেন, আমি মুসা। খিজির (আ.) প্রশ্ন করলেন, বনী-ইসরাইলের মুসা? তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ, আমিই বনি-ইসরাইলের মুসা। আমি আপনার কাছ থেকে ওই বিশেষ জ্ঞান অর্জন করতে এসেছি, যা আল্লাহ তাআলা আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন।
খিজির (আ.) বললেন, যদি আপনি আমার সাথে থাকতে চান, তবে কোনো বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না, যে পর্যন্ত আমি নিজে তার প্রকৃত অর্থ বলে না দেই। একথা বলার পর উভয়ে সমুদ্রের তীর ধরে চলতে লাগলেন। ঘটনাক্রমে একটি নৌকা এসে গেলে তারা নৌকায় আরোহণের ব্যাপারে কথাবার্তা বললেন। মাঝিরা খিজিরকে চিনে ফেলল এবং পারিশ্রমিক ছাড়াই তাঁদেরকে নৌকায় তুলে নিলো। নৌকায় চড়েই খিজির কুড়ালের সাহায্যে নৌকার একটি তক্তা তুলে ফেললেন।
এতে মুসা (আ.) (স্থির থাকতে না পেরে) বললেন, তারা কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই আমাদেরকে নৌকায় তুলে নিয়েছে। আপনি কি এরই প্রতিদানে তাদের নৌকা ভেঙে দিলেন যাতে সবাই ডুবে যায়? আপনি অতি মন্দ কাজ করলেন। খিজির (আ.) বললেন, আমি আগেই বলেছিলাম, আপনি ধৈর্য ধরতে পারবেন না। তখন মুসা (আ.) ওজর পেশ করে বললেন, আমি ওয়াদার কথা ভুলে গিয়েছিলাম; আমার প্রতি রুষ্ট হবেন না। রাসুলুল্লাহ (স.) এ ঘটনা বর্ণনা করে বললেন, মুসা (আ.)-এর প্রথম আপত্তি ভুলক্রমে, দ্বিতীয় আপত্তি শর্ত হিসেবে এবং তৃতীয় আপত্তি ইচ্ছাক্রমে হয়েছিল।
সহিহ বর্ণনা অনুযায়ী, ইতোমধ্যে একটি কালো চড়ুই পাখি এসে নৌকার এক প্রান্তে বসে এবং সাগর থেকে এক চঞ্চু পানি তুলে নিল। সেদিকে ইঙ্গিত করে খিজির (আ.) মুসা (আ.)-এর উদ্দেশে বলেন, ‘আমার-আপনার এবং সমস্ত সৃষ্টিজগতের জ্ঞান মিলিতভাবে আল্লাহর জ্ঞানের মোকাবিলায় সাগরের বুক থেকে পাখির চঞ্চুতে ওঠানো এক ফোঁটা পানির সমতুল্য।’ (সহিহ বুখারি: ৪৭২৭)
অতঃপর তারা নৌকা থেকে নেমে সমুদ্রের তীর ধরে চলতে লাগলেন। হঠাৎ খিজির এক বালককে অন্যান্য বালকের সাথে খেলা করতে দেখলেন। খিজির নিজ হাতে বালকটির মাথা তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। বালকটি মারা গেলো। মুসা (আ.) বললেন, আপনি একটি নিষ্পাপ শিশুকে বিনা অপরাধে হত্যা করেছেন। এ যে বিরাট গুনাহের কাজ করলেন। খিজির বললেন, আমি তো আগেই বলেছিলাম, আপনি ধৈর্য ধরতে পারবেন না। মুসা (আ.) দেখলেন, এ ব্যাপারটি আগের ঘটনার চাইতেও গুরুতর। তাই বললেন, এরপর যদি কোনো প্রশ্ন করি তবে আপনি আমাকে পৃথক করে দেবেন। আমার ওজর-আপত্তি চূড়ান্ত হয়ে গেছে।
অতঃপর তাঁরা আবার চলতে লাগলেন। এক গ্রামের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় তারা গ্রামবাসীদের কাছে খাবার চাইলেন। গ্রামবাসীরা খাবার দিতে অস্বীকার করল। খিজির এই গ্রামের একটি প্রাচীরকে দেখলেন পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থায়। তিনি নিজ হাতে প্রাচীরটি সোজা করে দিলেন। মুসা (আ.) বিস্মিত হয়ে বললেন, আমরা তাদের কাছে খাবার চাইলে তারা দিতে অস্বীকার করলো। অথচ আপনি তাদের এত বড় কাজ করে দিলেন; ইচ্ছা করলে এর পারিশ্রমিক তাদের কাছ থেকে আদায় করতে পারতেন। খিজির (আ.) বললেন, هَٰذَا فِرَاقُ بَيْنِي وَبَيْنِكَ অর্থাৎ এখন শর্ত পূর্ণ হয়ে গেছে। এটাই আমার ও আপনার মধ্যে বিচ্ছেদের সময়।
এরপর খিজির (আ.) তিনটি ঘটনার প্রকৃত কারণ মুসা (আ.)-এর কাছে বর্ণনা করে বললেন, ذَٰلِكَ تَأْوِيلُ مَا لَمْ تَسْطِعْ عَلَيْهِ صَبْرًا অর্থাৎ এ হচ্ছে সেসব ঘটনার স্বরূপ; যেগুলো আপনি দেখে ধৈর্য ধরতে পারেননি। পবিত্র কোরআনে এ প্রসঙ্গে এসেছে, ‘সে (খিজির) বলল, এখানেই আমার এবং আপনার মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হলো; যে বিষয়ে আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারেননি অচিরেই আমি সেগুলোর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করছি।’ (সুরা কাহাফ: ৭৮)
রাসুলুল্লাহ (স.) সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করে বললেন, মুসা (আ.) যদি আরো কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরতেন, তবে আরো কিছু জানা যেত ৷ (বুখারি: ১২২, মুসলিম: ২৩৮০)
পবিত্র কোরআনে খিজির (আ.)-এর তিনটি কাজের কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে—
নৌকা ছিদ্র করে দেওয়ার কারণ
‘নৌকাটির ব্যাপারে, সেটি ছিল কয়েকজন দরিদ্র ব্যক্তির। তারা সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষণ করত। আমি ইচ্ছা করলাম যে, সেটিকে ত্রুটিযুক্ত (নষ্ট) করে দেই। (কেননা) তাদের অপরদিকে ছিল এক বাদশাহ। সে বলপ্রয়োগে প্রত্যেকটি (ভালো) নৌকা ছিনিয়ে নিত।’ (সুরা কাহাফ: ৭৯)
ছোট বাচ্চাকে মেরে ফেলার কারণ
আর কিশোরটি, তার পিতামাতা ছিল মুমিন। অতঃপর আমরা আশঙ্কা করলাম যে, সে সীমালঙ্ঘন ও কুফরির মাধ্যমে তাদেরকে অতিষ্ঠ করে তুলবে। তাই আমরা চাইলাম যে, তাদের রব যেন তাদেরকে তার পরিবর্তে এক সন্তান দান করেন, যে হবে পবিত্রতায় উত্তম ও দয়া-মায়ায় ঘনিষ্ঠতর। (সুরা কাহাফ: ৮০-৮১)
প্রাচীর সোজা করে দেয়া কারণ
প্রাচীরের ব্যাপার, সেটি ছিল নগরের দুজন পিতৃহীন বালকের। এর নিচে ছিল তাদের (বাবার রেখে যাওয়া) গুপ্তধন এবং তাদের পিতা ছিল সৎকর্মপরায়ণ। সুতরাং আপনার পালনকর্তা দয়াপরবশ ইচ্ছা করলেন যে, তারা যৌবনে পদার্পণ করুক এবং নিজেদের গুপ্তধন উদ্ধার করুক। আমি নিজ মতে এটা করিনি। আপনি যে বিষয়ে ধৈর্যধারণ করতে অক্ষম হয়েছিলেন, এই হল তার ব্যাখ্যা।’ (সুরা কাহাফ: ৮২)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত নবী-রাসুলদের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।