মাহরাম শব্দের অর্থ হারাম। পারিভাষিক অর্থে মাহরাম বলা হয় যাদেরকে আত্মীয়তা, দুধপান এবং শ্বশুরালয়ের সম্পর্কের কারণে বিয়ে করা জায়েজ নয়। (লিসানুল আরব, খণ্ড: ৩, পৃ-১৩৯; ফতোয়ায়ে শামি, খণ্ড: ২, পৃ-১৪৫)
আর যেসব পুরুষের সামনে যাওয়া নারীর জন্য বৈধ নয় এবং যাদের সঙ্গে বিবাহবন্ধন বৈধ—তারা গায়রে মাহরাম। বিনা প্রয়োজনে গায়রে মাহরামের সঙ্গে কথা বলাও জায়েজ নয়। এমনকি প্রয়োজনে কথা বললেও তা যেন কোমল স্বরে না হয় সে ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে সতর্ক করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘..যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তবে পরপুরুষের সঙ্গে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, এতে করে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে, যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে; তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে।’ (সুরা আহজাব: ৩২)
বিজ্ঞাপন
পুরুষের জন্য যেসব নারীকে বিয়ে করা হারাম সে সম্পর্কে মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতাদেরকে, তোমাদের মেয়েদেরকে, তোমাদের বোনদেরকে, তোমাদের ফুফুদেরকে, তোমাদের খালাদেরকে, ভাতিজীদেরকে, ভাগ্নিদেরকে, তোমাদের সেসব মাতাকে যারা তোমাদেরকে দুধপান করিয়েছে, তোমাদের দুধবোনদেরকে, তোমাদের শাশুড়িদেরকে, তোমরা যেসব স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়েছ সেসব স্ত্রীর অপর স্বামী থেকে যেসব কন্যা তোমাদের কোলে রয়েছে তাদেরকে, আর যদি তোমরা তাদের সঙ্গে মিলিত না হয়ে থাকো তবে তোমাদের ওপর কোনো পাপ নেই এবং তোমাদের ঔরসজাত পুত্রদের স্ত্রীদেরকে এবং দুই বোনকে একত্র করা। তবে অতীতে যা হয়ে গেছে তা ভিন্ন কথা। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা নিসা: ২৩)
আরও পড়ুন: স্মার্টফোন আপনার জীবনের সব নেকি খেয়ে ফেলছে না তো?
নারীর জন্য যেসব পুরুষ মাহরাম
উপরোক্ত আয়াতের আলোকে নারীর জন্য যেসব পুরুষকে বিয়ে করা চিরতরে হারাম, তারা হলেন—
১) বাপ, দাদা, নানা ও ক্রমানুযায়ী তাদের ঊর্ধ্বতন পুরুষগণ।
বিজ্ঞাপন
২) সহোদর ভাই, বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় ভাই।
৩) শ্বশুর, আপন দাদা শ্বশুর ও নানা শ্বশুর এবং তাদের ঊর্ধ্বতন ক্রমানুযায়ী পুরুষগণ।
৪) আপন ছেলে, ছেলের ছেলে, মেয়ের ছেলে এবং তাদের ঔরসজাত পুত্র সন্তান এবং কন্যা সন্তানদের স্বামী।
৫) স্বামীর অন্য স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র।
৬) ভাতিজা, ভাগনে তথা সহোদর-বৈমাত্রেয়-বৈপিত্রেয় ভাই-বোনের ছেলে এবং তাদের অধঃস্থন ছেলেরা।
৭) চাচা অর্থাৎ বাবার সহোদর-বৈপিত্রেয়-বৈমাত্রেয় ভাই।
৮) আপন মামা তথা মায়ের সহোদর-বৈমাত্রেয়-বৈপিত্রেয় ভাই।
৯) দুধ সম্পর্কীয় ছেলে, উক্ত ছেলের ছেলে, দুধ সম্পর্কীয় মেয়ের ছেলে ও তাদের ঔরসজাত যে কোনো পুত্র সন্তান এবং দুধ সম্পর্কীয় মেয়ের স্বামী।
১০) দুধ সম্পর্কীয় বাপ, চাচা, মামা, দাদা, নানা ও তাদের ঊর্ধ্বতন ক্রমানুযায়ী পুরুষগণ।
১১) দুধ সম্পর্কীয় ভাই, দুধ ভাইয়ের ছেলে, দুধ বোনের ছেলে এবং তাদের ঔরসজাত যে কোনো পুত্র সন্তান।
১২) যৌন শক্তিহীন এমন বৃদ্ধ, যার মাঝে মহিলাদের প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই আবার মহিলাদেরও তার প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই।
১৩) অপ্রাপ্ত বয়স্ক এমন বালক যার মাঝে এখনো যৌন আকর্ষণ সৃষ্টি হয়নি।
উপরোক্ত পুরুষগণ ছাড়া কোনো মহিলার জন্য অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হারাম। তবে নিয়ম মেনে শরিয়তের অনুমোদনসাপেক্ষে কথা বলা যাবে।
আরও পড়ুন: দুর্ঘটনা-অগ্নিকাণ্ডে মৃত ব্যক্তিরা শহীদ
পুরুষের জন্য যেসব নারী মাহরাম
একইভাবে পুরুষের জন্য মাহরাম তথা যেসব নারী সামনে যাওয়া জায়েজ তারা হলেন—
১) মা, দাদি, নানী ও তাদের ঊর্ধ্বতন মহিলাগণ।
২) বোন (আপন-বৈপিত্রেয়-বৈমাত্রেয় বোন)।
৩) আপন মেয়ে, ছেলের মেয়ে, মেয়ের মেয়ে, এবং তাদের গর্ভজাত যেকোনো কন্যা সন্তান ও ছেলে সন্তানদের স্ত্রী।
৪) স্ত্রী এবং যে স্ত্রীর সঙ্গে দৈহিক মিলন হয়েছে তার পূর্ববর্তী বা পরবর্তী স্বামীর কন্যা সন্তান। স্ত্রীর মা অর্থাৎ শাশুড়ি, দাদি শাশুড়ি।
৫) ফুপু, তথা বাবার সহোদর-বৈমাত্রেয়-বৈপিত্রেয় বোন।
৬) খালা তথা মায়ের সহোদর-বৈমাত্রেয়-বৈপিত্রেয় বোন।
৭) ভাতিজি তথা সহোদর-বৈপিত্রেয়-বৈমাত্রেয় ভাইয়ের মেয়ে তাদের অধঃস্থন কন্যা সন্তান।
৮) ভাগ্নি তথা সহোদর-বৈমাত্রেয়-বৈপিত্রেয় বোনের মেয়ে ও তাদের অধঃস্থন কন্যা সন্তান।
৯) দুধ সম্পর্কীয় মেয়ে, মেয়ের মেয়ে, ছেলের মেয়ে ও তাদের অধঃস্থন যে কোনো কন্যা সন্তান ও দুধ সম্পর্কীয় ছেলের স্ত্রী।
১০) দুধ সম্পর্কীয় মা, খালা, ফুপু, নানি, দাদি ও তাদের ঊর্ধ্বতন ক্রমানুযায়ী মহিলাগণ।
১১) দুধ সম্পর্কীয় বোন, দুধ বোনের মেয়ে, দুধ ভাইয়ের মেয়ে এবং তাদের গর্ভজাত যে কোনো কন্যা সন্তান।
১২) যৌন শক্তিহীন এমন বৃদ্ধা যার প্রতি পুরুষের কোনো প্রকার আকর্ষণ নেই।
১৩) অপ্রাপ্ত বয়স্কা এমন মেয়ে যার প্রতি পুরুষের এখনো যৌন আকর্ষণ সৃষ্টি হয়নি।
উপরোক্ত মহিলাগণ ছাড়া কোনো পুরুষের জন্য অন্য কোনো মহিলার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করা জায়েজ নয় এবং হারাম। তবে নিয়ম মেনে শরিয়তের অনুমোদনসাপেক্ষে কথা বলা যাবে।
পুরুষ ও নারীর পর্দার বিধান
পুরুষ ও নারীর পর্দা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন। ‘ঈমানদার নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও বালক যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ছাড়া কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণ না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা নুর: ৩০-৩১)
নারী-পুরুষের সতর
নারীদের জন্য গায়রে মাহরামের সামনে পূর্ণ শরীরই সতর। তবে অতীব প্রয়োজনে চেহারা, পা ও হাত খোলা জায়েজ আছে। যেমন—রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড় হলে, আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া ইত্যাদি। (ফতোয়ায়ে শামি: ১/৪০৬, ফতোয়ায়ে রহিমিয়া: ৪/১০৬)
আর মাহরামদের সামনে নারীদের সতর হলো মাথা, চুল, গর্দান, কান, হাত, পা, টাখনু, চেহারা, গর্দানসংশ্লিষ্ট সিনার ওপরের অংশ ছাড়া বাকি পূর্ণ শরীর। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ৫/৩২)
নামাজে পুরুষের নাভির নিচ থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঢেকে রাখা ফরজ। তবে বিনা কারণে পুরুষের মাথা, পেট-পিঠ, হাতের কনুই খোলা রেখে নামাজ পড়লে তা আদায় হয়ে গেলেও মাকরুহ হবে। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/১০৬)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে শরিয়তের বিধান মাহরাম ও গাইরে মাহরাম সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি জাগ্রত করুন। পুরুষ ও নারীদের পর্দা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।