বিশ্ব মুসলিম-উম্মাহর কাছে আশুরার ঐতিহাসিক ঘটনাবলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামী পরিভাষায় আরবি বর্ষপঞ্জি হিজরি সনের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলে। ঐতিহাসিক নানা ঘটনাপ্রবাহের নির্যাস পবিত্র আশুরা।
আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে আশুরার দিনে। ওই দিনেই তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয় এবং দুনিয়ায় তাঁর তওবা কবুল করা হয়। ইবরাহিম (আ.)-এর জন্মগ্রহণ ও নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে তাঁর নিষ্কৃতি লাভও পবিত্র আশুরার দিনেই হয়েছে। এছাড়াও পবিত্র আশুরার দিনে আইয়ুব (আ.)-এর আরোগ্য লাভ, ইউনুস (আ.)-এর মাছের পেট থেকে মুক্তি পাওয়া, ইউসুফ (আ.)-এর দীর্ঘ ৪০ বছর পর বাবা ইয়াকু (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং নবী ঈসা (আ.)-এর জন্ম ও তাঁকে সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নেওয়াসহ অসংখ্য ঘটনার বিবরণ ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
সুতরাং আশুরা মানেই কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা নয়, আশুরার ঐতিহ্য আবহমানকাল থেকেই চলে এসেছে। এমনকি আশুরার রোজার প্রচলন ছিল ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগেও! আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসুল (স.)-এর কাছে আশুরার দিবস সম্পর্কে আলোচনা করা হলে তিনি বলেন, এই দিন জাহেলি যুগের লোকেরা রোজা রাখত..। (সহিহ মুসলিম: ২৬৪২)
অন্য এক হাদিসে এসেছে, ‘এটি সেদিন, যেদিন নুহ (আ.)-এর কিশতি ‘জুদি’ পর্বতে স্থির হয়েছিল। তাই নুহ (আ.) আল্লাহর শুকরিয়াস্বরূপ সেদিন রোজা রেখেছিলেন।’ (মুসনাদে আহমদ: ২/৩৫৯)
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, জাহেলি যুগে মক্কার কুরাইশ বংশের লোকেরা আশুরার রোজা রাখত এবং রাসুল (স.)-ও আশুরার রোজা রাখতেন। (সহিহ মুসলিম : ২৬৩২)। কাজেই আশুরার সুমহান ঐতিহ্যকে ‘কারবালা দিবসে’র ফ্রেমে বন্দি করা শুধুই সত্যের অপলাপ নয়; একই সঙ্গে দুরভিসন্ধিমূলকও!
অতএব, পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই আশুরা দিবসটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে আসছে। তবে, কারবালা প্রান্তরে মহানবী (স.)-এর দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.)-এর মর্মান্তিক শাহাদতবরণ আশুরা দিবসকে আরও গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমণ্ডিত করেছে। ৬০ হিজরির ১০ মহররম সংঘটিত হয় কারবালার হৃদয়বিদারক, মর্মস্পর্শী, বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শাহাদাতের পর হুসাইন ইবনে আলী (রা.)-এর দেহ মোবারকে মোট ৩৩টি বর্শার এবং ৩৪টি তরবারির আঘাত ছাড়াও অসংখ্য তীরের জখমের চিহ্ন বিদ্যমান ছিল।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: আশুরায় মাতম নিয়ে মনীষীদের অভিমত
হাদিসে আশুরার ইতিহাস সম্পর্কে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (স.) যখন হিজরত করে মদিনায় পৌঁছেন, তখন তিনি দেখলেন মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় আশুরার দিন রোজা পালন করছে। নবীজি (স.) তাদের জিজ্ঞেস করলেন, আশুরার দিন তোমরা রোজা রাখো কেন? তারা উত্তর দিল, এটি একটি মহান দিন—এ দিনে মহান আল্লাহ মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং ফেরাউন ও তার বাহিনীকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মুসা (আ.) রোজা রাখতেন, তাই আমরাও আশুরার রোজা পালন করে থাকি। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, মুসা (আ.)-কে অনুসরণের ব্যাপারে আমরা তাদের চেয়ে বেশি হকদার। এর পর থেকে তিনি নিজে আশুরার রোজা রাখেন এবং উম্মতকে তা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করেন। (সহিহ বুখারি: ৩৩৯৭; সহিহ মুসলিম: ১১৩৯)।
আশুরার রোজার সঠিক পদ্ধতি
ইমাম শাফেয়ি, ইমাম আহমদ, ইমাম ইসহাক প্রমুখ বলেছেন, আশুরার রোজার ক্ষেত্রে দশম ও নবম উভয় দিনের রোজাই মোস্তাহাব। কেননা নবী (স.) ১০ তারিখ রোজা রেখেছেন আর ৯ তারিখ রোজা রাখার নিয়ত করেছেন।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘যখন রাসুলুল্লাহ (স.) আশুরার রোজা রাখলেন এবং (অন্যদের) রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন, লোকেরা বলল- হে আল্লাহর রাসুল, এটি তো এমন দিন, যাকে ইহুদি ও খ্রিস্টানরা বড় জ্ঞান করে, সম্মান জানায়। তখন রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, আগামী বছর এই দিন এলে আমরা নবম দিনও রোজা রাখব ইনশাআল্লাহ।’ (সহিহ মুসলিম: ১৯৪৬)
সুতরাং আশুরার রোজা দুইটি রাখাই উত্তম। আবার শুধু ১০ তারিখ রোজা রাখলেও গুনাহ হবে না। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, আশুরার রোজা এক বছরের গুনাহের কাফফারা। আর আশুরার একটি রোজা রাখা মাকরুহ হবে না। আল্লামা ইবনে হাজার হায়সামি রচিত তুহফাতুল মুহতাজ গ্রন্থে আছে, আশুরা উপলক্ষে ১০ তারিখ শুধু একটি রোজা রাখাতে কোনো দোষ নেই।
আশুরার রোজার ফজিলত
আশুরার রোজা রাসুলুল্লাহ (স.) নিজে রেখেছেন এবং উম্মতকে রাখার নির্দেশ করেছেন, তাই তাঁর অনুসরণ করা আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া অসংখ্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) আশুরার রোজার ফজিলত বর্ণনা করেছেন। যেমন আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘রমজান মাসের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা মহররম মাসে আশুরার রোজা’ (সুনানে কুবরা: ৮৪২১০)। আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.)-কে আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এই রোজা বিগত বছরের গুনাহ মুছে দেয়। (মুসলিম: ১১৬২)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আশুরার রোজা রাখার তাওফিক দান করুন। আশুরার ইতিহাস নিয়ে সত্য কথা বলার, সত্য উপলব্ধি করার ও সত্যের ওপর অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

