মর্যাদাপূর্ণ মাস মহররম। হিজরি সনের প্রথম মাস। এই মাসের রয়েছে অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য ও তাৎপর্য। বিশেষ করে পবিত্র আশুরার দিন এই মাসের ১০ তারিখ। আশুরা শব্দটি আরবি। অর্থ দশম। শব্দটি হিজরি বর্ষের ১০ তারিখকে বুঝায়। এই দিনের সর্বাপেক্ষা আলোড়িত ও আলোচিত বিষয় হলো কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস।
তবে, আশুরার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ও স্মরণীয় ঘটনার শীর্ষে স্থান পায় মুসা (আ.)-এর ঘটনাটি। এই দিনে তিনি অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা সেদিন চিরকালের জন্য নীল নদে ডুবিয়েছিলেন খোদা দাবিদার ফেরাউন ও তার বিশাল বাহিনীকে।
বিজ্ঞাপন
আশুরার দিন রোজা রাখার প্রচলন আছে। এই প্রচলন ইসলাম আগমনের আগেও জাহেলি সমাজে প্রচলিত ছিল। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘জাহেলি যুগের লোকেরা আশুরার রোজা বা সাওম পালন করত।’ (তুহফাতুল আশরাফ: ১২৭৩৬)
অন্য এক হাদিসে এসেছে, ‘এটি সেদিন, যেদিন নুহ (আ.)-এর নৌকা ‘জুদি’ পর্বতে স্থির হয়েছিল। তাই নুহ (আ.) আল্লাহর শুকরিয়াস্বরূপ সেদিন রোজা রেখেছিলেন।’ (মুসনাদে আহমদ: ২/৩৫৯)
এদিন রোজার ঘটনা বর্ণনায় ইমাম বুখারি (রহ.) সাহাবি হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘মহানবী (স.) হিজরত করে মদিনায় পৌঁছে মদিনার ইহুদিদের আশুরার দিনে রোজা পালন করতে দেখেন। রাসুলুল্লাহ (স.) তাদের জিজ্ঞেস করেন, এই দিনে কী ঘটেছে যে তোমরা এতে রোজা পালন করো? তারা বলল, এই দিনটি অনেক বড় দিন, এই দিনে আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.) ও তাঁর সঙ্গীদের ফেরাউন থেকে মুক্ত করেছিলেন এবং ফেরাউন ও তার বাহিনীকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মুসা রোজা রাখতেন, তাই আমরাও আশুরার রোজা পালন করে থাকি। ইহুদিদের জবাব শুনে রাসুলে করিম (স.) বলেন, মুসা (আ.)-এর কৃতজ্ঞতার অনুসরণে আমরা তাদের চেয়ে বেশি যত্নশীল হওয়ার অধিকারী। অতঃপর তিনি নিজেও আশুরার রোজা রাখেন এবং মুসলমানদের তা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করেন।’ (বুখারি: ৩৩৯৭, মুসলিম: ১১৩৯)
বিজ্ঞাপন
আশুরার রোজার ফজিলত
আশুরার রোজা রাসুলুল্লাহ (স.) নিজে রেখেছেন এবং উম্মতকে রাখার নির্দেশ করেছেন, তাই তাঁর অনুসরণ করা আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া অসংখ্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) আশুরার রোজার ফজিলত বর্ণনা করেছেন। যেমন আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘রমজান মাসের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা মহররম মাসে আশুরার রোজা।’ (সুনানে কুবরা: ৮৪২১০)
আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.)-কে আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এই রোজা বিগত বছরের গুনাহ মুছে দেয়। (মুসলিম: ১১৬২)
আশুরার রোজা আসলে কয়টি?
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) যখন আশুরার দিনে রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ প্রদান করেন, তখন সাহাবিরা অবাক হয়ে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, বিধর্মীরা তো এই দিনটিকে বড় দিন মনে করে। এই দিনে তারাও রোজা পালন করে। আমরা যদি এই দিনে রোজা রাখি তাহলে তো এদের সঙ্গে সামঞ্জস্য হবে। তাদের প্রশ্নের জবাবে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন (তারা যেহেতু এদিন একটি রোজা পালন করে), আগত বছর ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা পালন করব, ইনশাআল্লাহ। (মুসলিম: ১১৩৪)
অন্য বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আশুরার দিনে রোজা রাখো, তবে এ ক্ষেত্রে ইহুদিদের সঙ্গে মিল না হওয়ার জন্য ১০ তারিখের আগের দিন অথবা পরের দিন আরো একটি রোজা রেখে নিয়ো।’ (মুসনাদে আহমদ: ২১৫৪)
উপরোক্ত হাদিসগুলোর আলোকে প্রমাণিত হয় যে আশুরার রোজা হবে দুটি—মহররমের ১০ তারিখ আর ৯ তারিখ অথবা ১১ তারিখ আরো একটি।
আশুরার দিনের অন্য আমল
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিনে আপন পরিবার-পরিজনের মধ্যে পর্যাপ্ত খানাপিনার ব্যবস্থা করবে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য সারা বছর পর্যাপ্ত রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন।’ (তাবরানি: ৯৩০৩)
বেশ কয়েকজন সাহাবি থেকে এ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হাদিসটির ব্যাপারে ইমামদের মধ্যে কিছু মতপার্থক্য আছে। ইমাম সুয়ুতিসহ অনেক বড় ইমামের মতানুসারে হাদিসটি গ্রহণযোগ্য ও আমলযোগ্য। (জামেউস সাগির: ১০১৯)
অতএব, কোনো মুসলমান যদি উপরোক্ত হাদিসের ওপর আমল করার উদ্দেশ্যে আশুরার দিন তাদের খানাপিনায় উন্নত ব্যবস্থা করতে আগ্রহ করে, তাহলে তার অনুমতি আছে। তবে কোনো ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করাকে ইসলাম সমর্থন করে না। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহ পবিত্র আশুরার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়ার এবং উপরোক্ত করণীয় যথাযথ আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

