আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার বাইরে কিছুই হয় না। রোদ-বৃষ্টিও তাঁরই রহমত ও মহান কুদরতের প্রকাশ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি বায়ু প্রেরণ করেন, অতঃপর তা (বায়ু) মেঘমালাকে সঞ্চালিত করে। অতঃপর তিনি মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তাকে (মেঘমালাকে) স্তরে স্তরে রাখেন। এরপর তুমি দেখতে পাও যে, তার মধ্য হতে বৃষ্টিধারা নির্গত হয়। তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাদের ইচ্ছা তা (বৃষ্টি) পৌঁছান; তখন তারা আনন্দিত হয়।’ (সুরা রুম: ৩৮)
আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ করেন, ‘তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন, অতঃপর আমি এর মাধ্যমে সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছি। অতঃপর আমি এ থেকে সবুজ ফসল নির্গত করেছি, যা থেকে যুগ্ম বীজ উৎপন্ন করি। খেজুরের কাঁদি থেকে গুচ্ছ বের করি, যা নুয়ে থাকে এবং আঙ্গুরের বাগান, জয়তুন, আনার পরস্পর সাদৃশ্যযুক্ত ও সাদৃশ্যহীন। বিভিন্ন গাছের ফলের প্রতি লক্ষ্য করো, যখন সেগুলো ফলন্ত হয় এবং তার পরিপক্কতার প্রতি লক্ষ্য করো। নিশ্চয় এগুলোতে ঈমানদারদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা আনআম: ৯৯)
বিজ্ঞাপন
এখন তীব্র তাপদাহ। পুড়ছে মানুষ ও পশু-পাখি। এমন প্রচণ্ড গরমে এক পশলা বৃষ্টির জন্য মুমিনরা আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশী। শস্য ফলানোসহ পশু-পাখির খাবারের জন্য যেমন বৃষ্টি দরকার, তেমনি তীব্র তাপপ্রবাহে সৃষ্ট নানা জটিলতা ও কষ্ট থেকে মুক্তি পেতেও আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি খুবই প্রয়োজন। এহেন পরিস্থিতিতে তাঁরই দরবারে বৃষ্টি কামনা করে নামাজ পড়া ও দোয়া করা সুন্নত। ইসলামি পরিভাষায় এই দোয়ার নাম ইসতিসকা বা সিক্তকরণের দোয়া এবং নামাজের নাম ‘সালাতুল ইসতিসকা’ বা ‘বৃষ্টি কামনায় নামাজ’।
ইসতিসকার নামাজের পদ্ধতি
বৃষ্টি প্রার্থনায় সম্মিলিতভাবে জামাতে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে হয়। এরপর ইমাম সাহেব কেবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে দুই হাত প্রসারিত করে রহমতের বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেন। মুসল্লিরাও তখন কায়মনোবাক্যে তাঁর সঙ্গে শরিক হয়ে দোয়া-প্রার্থনা করেন।
বস্তুত যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বা নানা প্রতিকূলতায় পাপমোচনের জন্য আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠ অন্তরে তওবা-ইস্তেগফার করতে হয়। কেউ অন্যের হক বা অধিকার নষ্ট করলে, তা ফেরত দিয়ে দোয়া করতে হয়। তবেই আল্লাহ তাআলা মানুষের মনোকামনা পূরণ করেন এবং বৃষ্টি দিয়ে নিসর্গ সিক্ত করেন।
শরিয়ত ও তরিকতের আলেম-ওলামাদের মতে, এ নামাজ মাঠে গিয়ে আদায় করার আগে পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণপূর্বক একাধারে তিন দিন রোজা রাখবে। তারপর সংশ্লিষ্ট ওই এলাকার ইমাম ও খতিব মুসল্লিদের নিয়ে বসবেন, নসিহত করবেন, উপদেশ দেবেন। তিন দিনের রোজা শেষে চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ দিনে মাঠে গিয়ে নামাজ আদায় করবেন। মাঠে যাওয়ার আগে এবং পরে সবাই তওবা করবেন। তওবা করলে বৃষ্টি বর্ষণের প্রবল সম্ভাবনা থাকে। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, 'অতঃপর বললাম, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য অজস্র বৃষ্টিধারা প্রবাহিত করবেন এবং তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি দ্বারা সাহায্য করবেন' (সুরা নূহ: ১০-১২)।
বিজ্ঞাপন
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় অধিকাংশ আলেম-ওলামা বলেন, গুনাহ থেকে তওবা করলে আল্লাহ তাআলা বৃষ্টি বর্ষণ করেন। দুর্ভিক্ষজনিত নানা বিপদাপদ হতে দেন না এবং ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততিতে বরকত দান করেন।
আয়াত তিনটির ব্যাখ্যায় হজরত বায়জাভি ও হজরত হাসান বসরি (রা.) বৃষ্টির জন্য ইস্তেগফার ও তওবা পাঠ করাই উত্তম বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
ইসতিসকার দোয়া
ইসতিসকার নামাজ আদায়ের ব্যাপারে ইমামদের মধ্যে নিয়ম এবং তরতিবে কিছুটা মতপার্থক্য বোঝালেও আল্লাহ তাআলার কাছে নিচের দোয়াটি পাঠ করা খুবই কল্যাণকর ও বরকতময়। কারণ এ দোয়াটি স্বয়ং শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (স.) বৃষ্টির জন্য পাঠ করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, লোকজন রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে অনাবৃষ্টির কষ্টের কথা নিবেদন করলে রাসুলুল্লাহ (স.) ঈদগাহে সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে নিচের দোয়া করেন। অতঃপর আল্লাহর হুকুমে বৃষ্টি বর্ষণ হতে শুরু করে। বৃষ্টি থেকে পরিত্রাণ পেতে মানুষের ছোটাছুটি দেখে নবীজি হেসে ফেলেন। (আবু দাউদ: ১১৭৩)
দোয়াটি হলো—
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ * الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ * مَلِكِ يَوْمِ الدِّينِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ يَفْعَلُ مَا يُرِيدُ اللَّهُمَّ أَنْتَ اللَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ الْغَنِيُّ وَنَحْنُ الْفُقَرَاءُ أَنْزِلْ عَلَيْنَا الْغَيْثَ وَاجْعَلْ مَا أَنْزَلْتَ لَنَا قُوَّةً وَبَلاَغًا إِلَى حِينٍ উচ্চারণ: ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। আর-রাহমানির রাহিম। মালিকি ইয়াউমিদ্দিন। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ইয়াফয়ালু মা ইউরিদ। আল্লাহুম্মা আনতাল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা আনতাল গানিয়্যু ওয়া নাহলুল ফুকারাউ। আনজিল আলাইনাল গাইছা ওয়াজয়া'ল মা আনজালতা লানা কুওয়্যাতান ওয়া বালাগান ইলা হীন।’
অর্থ: ‘সব প্রশংসা পৃথিবীর প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তিনি পরম করুণাময় এবং দয়ালু ও শেষ বিচারের মালিক। আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো মাবুদ নেই, তিনি যা ইচ্ছা করেন, তা-ই করেন। হে আল্লাহ! তুমিই একমাত্র মাবুদ, তুমি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই। তুমি ধনী, আমরা গরিব। আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করো এবং আমাদের জন্য যা অবতীর্ণ করো, তা আমাদের জন্য শক্তিময় ও কল্যাণ দান করো।’ (আবু দাউদ: ১১৭৩)
এই দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার কাছে তাঁর দয়া ও রহমত লাভের জন্য প্রার্থনা করা হয়। দোয়াটিতে নিজেকে অতি অসহায়-গরিব বলে উল্লেখ রয়েছে এবং আল্লাহকে জ্ঞান করা হয়েছে সম্পদশালী ও মহান শক্তিধর হিসেবে। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর নিবেদিত ইসতিসকার নামাজ ও দোয়া কবুল করুন। আমিন।