মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

তাওবা করলে ধর্ষণের গুনাহ মাফ হবে কি?

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২০ জুলাই ২০২২, ০১:১০ পিএম

শেয়ার করুন:

তাওবা করলে ধর্ষণের গুনাহ মাফ হবে কি?

ধর্ষণে দুটি বড় গুনাহ সংঘটিত হয়। ১) জেনা বা ব্যভিচার, যা আল্লাহর হকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ২) ডাকাতি বা জুলুম, যা বান্দার হকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আল্লাহর হক নষ্ট করার গুনাহ আন্তরিক তাওবার মাধ্যমে মাফ হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের ওপর জুলুম করছ, তোমার আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল। পরম দয়ালু।’ (সুরা জুমা: ৫৩)

কিন্তু বান্দার হক নষ্ট করলে বান্দার ক্ষমা ছাড়া সেই গুনাহ মাফ হয় না। হাদিস অনুযায়ী, বান্দার হক নষ্টকারীরা কেয়ামতের দিন সবচেয়ে বেশি অসহায় ও নিঃস্ব হিসাবে গণ্য হবে। 


বিজ্ঞাপন


রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ওপর জুলুম করেছে সে যেন আজই মাফ চেয়ে নেয়, তার ভাইয়ের জন্য তার কাছ থেকে নেকি কর্তন করে নেওয়ার আগে। কেননা সেখানে (হাশরের ময়দানে) কোনো দিনার বা দিরহাম পাওয়া যাবে না। তার কাছে যদি নেকি না থাকে তবে তার (মজলুম) ভাইয়ের গুনাহ এনে তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে।’ (বুখারি: ৬৫৩৪)

সুতরাং তাওবা করলেও ধর্ষণের গুনাহ মাফ হবে না, যতক্ষণ ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীর ক্ষমা মিলবে না। তাই আখেরাতে জুলুমের শাস্তি ধর্ষককে পেতেই হবে। তবে, কোনো অপরাধী যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে বা দুনিয়াবি আদালতে ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী শাস্তি পায়, তাহলে সেই শাস্তি তার গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ যখন তাঁর বান্দার কল্যাণ চান তখন দুনিয়াতে তার শাস্তি তরান্বিত করেন, আর যখন কোনো বান্দার অকল্যাণ চান তখন তার পাপগুলো রেখে দিয়ে কেয়ামতের দিন তাঁর প্রাপ্য পূর্ণ করে দেন।’ (জামে তিরমিজি: ২৩৯৬)

ধর্ষণের শাস্তি কী?
ধর্ষণের শাস্তি বিষয়ে ইমাম আবু হানিফা, শাফেয়ি ও আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ)-এর মত হলো- ‘ধর্ষণের জন্য ব্যভিচারের শাস্তি প্রযোজ্য হবে।’ অর্থাৎ ধর্ষক অবিবাহিত হলে ১০০ বেত্রাঘাত আর বিবাহিত হলে তাকে পাথর মেরে মৃত্যু নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু ইমাম মালেক (রহ)-এর মতে, ‘ধর্ষণের অপরাধে ব্যভিচারের শাস্তি প্রয়োগের পাশাপাশি ‘মুহারাবা’র শাস্তিও প্রয়োগ করতে হবে।

মুহারাবার শাস্তি কী?
অস্ত্র দেখিয়ে বা অস্ত্র ছাড়াই ভীতি প্রদর্শন করে ডাকাতি করা কিংবা লুণ্ঠন করা। এই শাস্তি সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া বা হত্যা করা উভয়টিই হতে পারে। মুহারাবার শাস্তি প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাথে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে- তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলীতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে (ডান হাত বাম পা/বাম হাত ডান পা) কেটে দেয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার তথা নির্বাসিত করা হবে। ‘এটি হল তাদের জন্য দুনিয়ার লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি।’ (সুরা মায়েদা: ৩৩)


বিজ্ঞাপন


এ আয়াতের আলোকে বিচারক ধর্ষণকারীকে ব্যভিচারের শাস্তির সঙ্গে উল্লেখিত চার ধরণের যে কোনো শাস্তি প্রয়োগ করতে পারবেন। কেননা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য ধর্ষণ হলো আল্লাহ ও তার রাসুলের নিয়ম-নীতি বিরুদ্ধ অপরাধ। আর তা তাদের সঙ্গে যুদ্ধে উপনীত হওয়ার শামিল। তাছাড়া ধর্ষণের ক্ষেত্রে বল প্রয়োগ করা হয়। ইসলামের বিধান লঙ্ঘণে বল প্রয়োগ করলেও এ শাস্তি প্রযোজ্য হবে।

তাই সমাজে যখন ধর্ষণ মহামারী আকার ধারণ করে তখন (মুহারাবার) মতো ভয়াবহ শাস্তি প্রয়োগ করা জরুরি বলে মনে করেন অনেক স্কলার। আর যদি ধর্ষণ কারণে হত্যাজনিত অপরাধ সংঘটিত হয় কিংবা ধর্ষণের শিকার কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে, তাহলে ঘাতকের শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। যদিও অনেকে মৃত্যুদণ্ডের বিকল্প হিসেবে অর্থদণ্ডের কথাও বলেছেন। অর্থদণ্ডের পরিমাণ হচ্ছে, একশ উটের সমমূল্য অর্থ। ধর্ষণের সঙ্গে যদি আরও কোনো অপরাধ ঘটে— যেমন অশ্লীল ভিডিও ধারণ করা ও ওই ধরনের ভিডিও প্রচার করা ইত্যাদি অপরাধ পাওয়া গেলে, তার দণ্ডের পরিমাণ আরও বেশি হবে।

দুনিয়ায় আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি
পরকালে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি ছাড়াও দুনিয়ায় দারিদ্র ও অকালমৃত্যুর মতো আজাব দেওয়া হয় ব্যভিচারীকে। বলা হয়েছে, ‘ব্যভিচারের মন্দ পরিণাম ছয়টি। তিনটি দুনিয়ায় আর তিনটি আখেরাতে। দুনিয়ার তিনটি হলো— ১) চেহারার সৌন্দর্য নষ্ট হওয়া। ২) দারিদ্র। ৩) অকালমৃত্যু। আর আখেরাতের তিনটি হলো- ১) আল্লাহর অসন্তুষ্টি ২) হিসাব-নিকাশে কঠোরতা। ৩) জাহান্নামের কঠিন শাস্তি। (ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ, ই. ফা. পৃষ্ঠা-১০৯)

ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি নিরপরাধ
হাদিস থেকে জানা যায়, ধর্ষণের শিকার হওয়া ব্যক্তি নিরপরাধ। রাসুল (স.)-এর যুগে এক নারীকে ধর্ষণ করা হলে রাসুল (স.) ওই নারীকে তিনি কোনোরূপ শাস্তি দেননি, তবে ধর্ষককে হদের শাস্তি দেন। (ইবনে মাজাহ: ২৫৯৮)

অন্য হাদিসে আছে, গণিমতের পঞ্চমাংশে পাওয়া এক দাসির সঙ্গে সরকারি মালিকানাধীন এক গোলাম জবরদস্তিপূর্বক ব্যভিচার (ধর্ষণ) করে। এতে তার কুমারিত্ব নষ্ট হয়ে যায়। হজরত উমর (রা.) ওই গোলামকে বেত্রাঘাত করেন এবং নির্বাসন দেন। কিন্তু দাসিটিকে (অপকর্মে) সে বাধ্য করেছিল বলে তাকে বেত্রাঘাত করেননি।’ (বুখারি: ৬৯৪৯)

হদ প্রসঙ্গে হানাফি মাজহাবের (বাংলাদেশিরা সাধারণত যে মাজহাবের) বিশেষজ্ঞরা বলেন, এক্ষেত্রে হদ (শরিয়তকর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি) হলো, অবিবাহিতের জন্য একশ’ বেত্রাঘাত। আর দেশান্তরের বিষয়টি বিচারকের বিবেচনাধীন। তিনি ব্যক্তি বিশেষে চাইলে তা প্রয়োগ করতে পারেন।

উল্লেখ্য, ধর্ষণের যেসব শাস্তির কথা আলোচিত হয়েছে, তা কেবল হুকুমত (রাষ্ট্র) বা হুকুমতের অনুমোদনপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট দপ্তর প্রয়োগ করবে, ব্যক্তি পর্যায়ের কেউ নয়। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে প্রত্যেকটি বিষয়ে তাঁর হুকুম মানার এবং যাবতীয় হারাম বিষয় থেকে বেচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর