কোরবানি আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম। এই মহান ইবাদত নষ্ট হতে পারে সামান্য ভুলে। এমনই একটি ভুল হচ্ছে ফেসবুকে কোরবানির পশুর ছবি শেয়ার করা। যা মূলত রিয়ার অন্তর্ভুক্ত। ইসলামে রিয়া বলা হয় লোক দেখানো আমলকে। প্রিয়নবী (স.) রিয়াকে ছোট শিরক বলেও অভিহিত করেছেন।
রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘আমি তোমাদের ব্যাপারে ছোট শিরক নিয়ে যতটা ভয় পাচ্ছি, অন্য কোনো বিষয়ে ততটা ভীত নই।’ সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, ছোট শিরক কী? রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, রিয়া বা প্রদর্শনপ্রিয়তা। আল্লাহ কেয়ামতের দিন বান্দার আমলের প্রতিদান প্রদানের সময় বলবেন, ‘তোমরা পৃথিবীতে যাদের দেখাতে, তাদের কাছে যাও। দেখো তাদের কাছে তোমাদের কোনো প্রতিদান আছে কি না?’ (মুসনাদে আহমদ: ২২৫২৮)
আল্লাহর দরবারে কোনো ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য প্রথম শর্তই হচ্ছে ইখলাস। ইখলাস ছাড়া এবং শিরক থাকলে ইবাদত কবুল হয় না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা শিরক থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের আশা রাখে, সে যেন সৎ কাজ করে এবং তার প্রভুর ইবাদতে কাউকে অংশীদার না করে।’ (সুরা কাহাফ: ১১০)
রিয়া বা শিরকে আসগরের মতো আরো অনেক ছোট ছোট শিরক মিশে আছে আমাদের বিভিন্ন আচরণে। মুমিনের দায়িত্ব হলো, এসব বিষয়ে হক্কানি উলামায়ে কেরাম থেকে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা এবং সেগুলো থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। পবিত্র কোরআনের অন্য আয়াতে লোক-দেখানো ইবাদতকারীদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘ধ্বংস সেসব নামাজির জন্য, যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে উদাসীন, যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে।’ (সুরা মাউন: ৪-৭)
কোরবানি ইসলামি শরিয়তের এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা সামর্থ্যবান সব নারী-পুরুষের ওপর ওয়াজিব। কোরআনে আল্লাহ তাআলা কোরবানির নির্দেশ দিয়ে বলেন—‘আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি আদায় করুন।’ (সুরা কাউসার: ২)
এই আত্মত্যাগের ইবাদতে রিয়ার মিশ্রণ হওয়া খুবই দুঃখজনক। সৎ বান্দারা কখনও রিয়া বা লোক দেখানো আমল করতে পারেন না। সৎ বান্দাদের বৈশিষ্ট্যই হল ইখলাস। এ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আল্লাহ তাআলা বলছেন, তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকিন, এতিম ও বন্দীকে খাদ্য দেয় এবং বলে, শুধু আল্লাহর সস্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদেরকে খাবার দান করি, আমরা তোমাদের কাছ থেকে প্রতিদান চাই না, কৃতজ্ঞতাও নয়।’ (সুরা দাহর: ৮-৯)
বিজ্ঞাপন
ইখলাস নেই তো কোরবানি নেই। আল্লাহ তাআলা এ বিষয়ে বলেন, আল্লাহর নিকট এদের গোশত ও রক্তের কিছুই পৌঁছে না, কিন্তু তাঁর নিকট পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। (সুরা হজ, আয়াত নম্বর: ৩৭)
ইবাদতের আরেক বৈশিষ্ট্য হলো ইহসান। এর অর্থ- সবসময় আল্লাহ তাআলার জিকির হৃদয়ে জাগ্রত থাকা। হাদিসের ভাষায়- আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করো যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। তা যদি সম্ভব না হয়, তো এতটুকু অনুভূতি হৃদয়ে অবশ্যই জাগ্রত রাখ যে, আল্লাহ তোমাকে দেখছেন। (সহিহ বুখারি: ৫০; সহিহ মুসলিম: ৮)
মুমিনের ইবাদত আল্লাহর দরবারে গৃহীত হওয়ার আরেকটি শর্ত হলো, ইবাদতটি সুন্নত অনুযায়ী হওয়া। রাসুল (স.) যে ইবাদত যে পদ্ধতিতে আদায় করেছেন এবং সাহাবিদের শিখিয়েছেন সেই পদ্ধতিতেই ইবাদতটি সম্পন্ন হওয়া। মোটকথা, ইখলাস, ইহসান ও সুন্নাহসমর্থিত ইবাদত-ই কেবল প্রাণবন্ত ইবাদত। আর কোরবানির আমলে ইবাদতের উপরোক্ত শর্ত এবং বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে বেশি কাম্য।
আফসোস! বর্তমানে এই কোরবানিকে ঘিরে ইখলাস ও ইহসান পরিপন্থী, রিয়া ও লৌকিকতাসূলভ নানা জিনিসের বিস্তার ঘটেছে। হাঁটের সেরা পশুটি কিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ঢাকঢোল পেটানো এবং লোকের ‘বাহবা’ কুড়ানোর জন্য মানুষ মরিয়া হয়ে ওঠেছে! এমনকি নিরীহ পশুটির কাঁধে চড়ে ছবি তোলার মতো অমানবিক দৃশ্যও নজরে পড়ে! আরো দুঃখজনক বিষয় হল, পশু জবাইয়ের সময় আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠা। ইবাদতকে এভাবে বিনোদনে পরিণত করা মুমিনের জন্য শোভনীয় নয়।
এসব জাহান্নামীদের স্বভাব। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, যারা নিজেদের দীনকে তামাশা এবং ক্রীড়া-কৌতূকরূপে গ্রহণ করেছিল এবং পার্থিব জীবন ওদের ধোঁকায় ফেলেছিল। সুতরাং আজ আমি তাদেরকে ভুলে যাব যেভাবে তারা এই দিনের সাক্ষাৎকে ভুলে গিয়েছিল। (সুরা আরাফ: ৫১)
সত্য কথা হলো, সেলফি তোলা, ভিডিও করা, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা ইত্যাদির মাধ্যমে ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যটাই ক্ষুণ্ণ হয়ে যায়। এটা বোঝার জন্য খুব বেশি বোধ-বুদ্ধিরও প্রয়োজন হয় না। শেষকথা হলো- মুসলিমের কোনো আমলই আচারসর্বস্ব নয়। কোরবানিও তেমনি নিছক আচার-অনুষ্ঠান নির্ভর কোনো আমল নয়। এতে রয়েছে তাওহীদ ও আল্লাহর বড়ত্ব-মহত্বের প্রকাশ। তাঁর স্মরণ ও আনুগত্যের শিক্ষা। সর্বোচ্চ সমর্পণের দীক্ষা।
হজরত ইবরাহিম (আ.) কীভাবে আল্লাহর হুকুমের সামনে নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশ করেছেন! কীভাবে ছোট্ট শিশু ইসমাঈল মহান প্রভুর নির্দেশের সামনে মাথা পেতে দিয়েছেন! কীভাবে মহান শিশু-নবীর পরিবর্তে জান্নাতি পশু কোরবানি হলো! এসব কুদরত ও ত্যাগের শিক্ষা অন্তরে জাগ্রত করি, ছবি-সেলফি নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে দোয়ায় মগ্ন থাকি, তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ তাআলা আমাদের কোরবানি কবুল করবেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে হেদায়েত দান করুন। কোরবানির মাধ্যমে নিজেদের অন্তরের পরিশুদ্ধতা অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন।

