আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাঁদের প্রিয় করেছেন, তাঁদের অন্যতম হলেন নবী দাউদ (আ.)। তিনি ছিলেন শাসক ও নবুয়তের মর্যাদাসম্পন্ন এক ব্যক্তিত্ব। একইসঙ্গে তিনি ছিলেন পরিশ্রমী, ন্যায়পরায়ণ, আল্লাহভীরু ও অত্যন্ত ইবাদতপ্রবণ নবী। তাঁর ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল ‘যাবুর’, যা তিনি এমন সুমধুর কণ্ঠে তেলাওয়াত করতেন, পাহাড় ও পাখিরাও তাতে শরিক হতো।
অনুগত পাহাড় ও পাখি
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘স্মরণ করুন আমাদের শক্তিশালী বান্দা দাউদের কথা; তিনি ছিলেন খুব বেশী আল্লাহ অভিমুখী। আমি পর্বতমালাকে তার অনুগত করেছিলাম, তার সাথে এগুলো সকাল-সন্ধ্যায় আমার তাসবিহ পাঠ করত।’ (সুরা সোয়াদ: ১৭–১৮)
ইমাম তাবারি (রহ.) ব্যাখ্যা করেছেন, আল্লাহ তাআলা পাহাড় ও পাখিদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন দাউদ (আ.) তাসবিহ পাঠ করলে তারাও তাঁর সঙ্গে তাসবিহ পাঠ করে।
শ্রম ও আত্মনির্ভরতার অনন্য দৃষ্টান্ত
দাউদ (আ.) ছিলেন দক্ষ কর্মকার। রাজা হয়েও তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোনো বেতন গ্রহণ করতেন না; বরং নিজ হাতে বর্ম তৈরি করে বিক্রি করতেন এবং সেই উপার্জিত অর্থেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাঁর এই আত্মনির্ভরতা আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহে বিশেষভাবে সহজ করে দেওয়া হয়েছিল।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: নবী-রাসুলদের কার কী পেশা ছিল
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি দাউদের প্রতি অনুগ্রহ করেছিলাম। (আমি আদেশ করলাম) ‘হে পর্বতমালা! তোমরা তাঁর সঙ্গে আমার পবিত্রতা ঘোষণা কর’ এবং পাখিদেরও (আদেশ দিয়েছিলাম)। আমি তাঁর জন্য লোহাও নরম করে দিয়েছিলাম (বলেছিলাম) ‘তুমি পূর্ণাঙ্গ বর্ম তৈরি কর এবং যথাযথভাবে প্রস্তুত কর’। আর তোমরা সৎকর্ম কর; নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কাজ সম্যক দেখি।’ (সুরা সাবা: ১০–১১)
আরও এক আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আমি তাঁকে তোমাদের জন্য বর্ম তৈরির কৌশল শিক্ষা দিয়েছিলাম, যাতে তা যুদ্ধে তোমাদের রক্ষা করতে পারে। সুতরাং তোমরা কি কৃতজ্ঞ হবে না?’ (সুরা আম্বিয়া: ৮০)
ইবাদতের সৌন্দর্য
হজরত দাউদ (আ.) ছিলেন এমন এক নবী, যিনি ইবাদতের ভারসাম্য, পরিশ্রম ও আল্লাহভীতির অনন্য সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় সালাত হল দাউদ (আ.)-এর সালাত। আর আল্লাহ তাআলার নিকট সর্বাধিক প্রিয় সিয়াম হল দাউদ (আ.)-এর সিয়াম। তিনি অর্ধরাত পর্যন্ত ঘুমাতেন, এক তৃতীয়াংশ তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করতেন এবং রাতের এক ষষ্ঠাংশ ঘুমাতেন। তিনি একদিন সিয়াম পালন করতেন, একদিন সওমবিহীন অবস্থায় থাকতেন।’ (সহিহ বুখারি: ১১৩১)
দাউদ (আ.)-এর এই ইবাদত এতই উত্তম ছিল যে, প্রিয়নবী (স.) সাহাবিদের নির্দেশ দিতেন দাউদের মতো ইবাদত করতে এবং এর চেয়ে বেশি করার চেষ্টা না করতে।
আরও পড়ুন: নবীদের মধ্যে মহানবী (স.)-এর বিশেষত্ব
ধৈর্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে দাউদ (আ.)
যখন মক্কার কাফেররা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর ওপর নির্যাতন চালায়, তখন আল্লাহ তাআলা তাঁকে ধৈর্যধারণের উপদেশ দেন এবং নবী দাউদের কথা স্মরণ করিয়ে দেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা যা বলে তাতে আপনি ধৈর্য ধরুন এবং স্মরণ করুন আমার শক্তিশালী বান্দা দাউদের কথা; তিনি ছিলেন অধিক আল্লাহমুখী।’ (সুরা সোয়াদ: ১৭)
নিজ হাতে উপার্জনের মর্যাদা
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘দাউদের জন্য যাবুর তেলাওয়াত সহজ করে দেওয়া হয়েছিল। তিনি তাঁর পশুযানে গদি বাঁধার নির্দেশ দিতেন এবং সেই সময়ের মধ্যেই যাবুর পাঠ শেষ করতেন। তিনি নিজের হাতে উপার্জন করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন।’ (সহিহ বুখারি: ৩৪১৭)
দাউদ (আ.)-এর জীবন আল্লাহভীতি, ইবাদত, আত্মনির্ভরতা ও ধৈর্যের এক অনন্য প্রতীক। রাজত্ব, নবুয়ত ও কর্ম সবক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন ভারসাম্যপূর্ণ ও আল্লাহনিষ্ঠ। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়- সত্যিকারের ইবাদতের সৌন্দর্য কেবল পরিমাণে নয়, বরং নিয়ত, নিয়মানুবর্তিতা ও আত্মসমর্পণে নিহিত।

