মানুষের জীবনে হাসি-কান্না, সুখ-বেদনা সবই আল্লাহপ্রদত্ত স্বাভাবিক অনুভূতি। রাসুলুল্লাহ (স.) ছিলেন মানবীয় গুণাবলির পূর্ণাঙ্গ ও ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিচ্ছবি। তিনি যেমন হাসতেন, তেমনি কাঁদতেনও। তবে তাঁর কান্না ছিল বিনয়, মমতা ও আল্লাহভীতির নিঃশব্দ প্রকাশ। তিনি কখনো বিলাপ করতেন না; বরং আল্লাহর সামনে নত হয়ে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতেন।
সংযত ও হৃদয়স্পর্শী কান্না
ইবনুল কাইয়িম (রহ.) লিখেছেন, নবীজির (স.) কান্না ছিল তাঁর হাসির মতোই নিঃশব্দ, গভীর ও মর্মস্পর্শী। কেবল চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরত। (জাদুল মায়াদ, খণ্ড ১, পৃ. ১৮৩)
এ ছিল এমন এক কান্না, যা হৃদয়ে অনুভূত হতো।
আরও পড়ুন: নবীজির হাসিখুশির ঘটনা
নামাজে কান্না: আল্লাহভীতির নিদর্শন
নামাজ ছিল নবীজির (স.) জন্য আল্লাহর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের মুহূর্ত। সেই মুহূর্তে তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরত। মুতাররিফ (রহ.) তাঁর পিতার সূত্রে বলেন, আমি দেখেছি রাসুলুল্লাহ (স.) নামাজ আদায় করছিলেন এবং সে সময় তাঁর বুক থেকে জাঁতা পেষার আওয়াজের মতো কান্নার আওয়াজ হচ্ছিল।’ (আবু দাউদ: ৯০৪)
বিজ্ঞাপন
কোরআনের আয়াত শুনে অশ্রুসিক্ত নবী
একদিন নবীজি (স.) সাহাবি আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.)-কে বললেন, ‘তুমি আমাকে কোরআন শুনাও।’ ইবন মাসউদ (রা.) সুরা নিসার ৪১ নম্বর আয়াত পাঠ করেন- ‘তখন কী অবস্থা হবে, যখন আমি ডেকে আনব প্রত্যেক উম্মতের মধ্য থেকে সাক্ষী এবং আপনাকে ডাকব তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরূপে?’ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন- ‘আমি নবীজির দিকে তাকিয়ে দেখি, তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।’ (সহিহ বুখারি: ৫০৫৫, ৫০৪৯)
প্রিয়জন হারানোর মুহূর্তে কান্না
মানবতার শিক্ষক নবীজি (স.) ছিলেন করুণায় পরিপূর্ণ। প্রিয়জনের মৃত্যুতে তাঁর চোখের পানি ঝরত, কিন্তু মুখে থাকত ধৈর্য ও আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি সমর্পণ। উসমান ইবনে মাজউন (রা.)-এর মৃত্যুতে নবীজি (স.) তাঁর ললাটে চুমু দেন এবং কেঁদে ফেলেন। (শামায়েলে তিরমিজি: ২৫১); কন্যা উম্মে কুলসুম (রা.)-এর কবরের পাশে বসেও তাঁর চোখ অশ্রুতে ভিজে ওঠে। (বুখারি: ১২৮৫); রাসুল (স.)-এর কোনো এক কন্যার এক ছেলের মৃত্যু উপস্থিত হলে তিনি তাকে দেখতে যান। সেখানে প্রবেশ করলে তখন তারা শিশুটিকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে দিলেন। ...রাসুলুল্লাহ (স.) কাঁদলেন। তা দেখে সাদ ইবনে উবাদাহ (রা.) বলেন, আপনি কাঁদছেন? তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর দয়ালু বান্দাদের ওপরই দয়া করেন।’ (বুখারি: ৭৪৪৮)
আরও পড়ুন: নবীজির ইতিহাস বদলে দেওয়া সেই কষ্টের ৩ বছর
নবীজির প্রিয় পুত্র ইব্রাহিমের মৃত্যুর সময় নবীজি (স.) শিশুটিকে কোলে নিয়ে কাঁদতে থাকেন।... তিনি বলেন, ‘চোখ অশ্রু ঝরায়, হৃদয় বিষণ্ন হয়, কিন্তু আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির বিরুদ্ধে কিছু বলি না। হে ইব্রাহিম, তোমার বিচ্ছেদে আমরা সত্যিই মর্মবেদনায় কষ্ট পাচ্ছি।’ (বুখারি, ১৩০৩)
এসব কান্নার ঘটনায় শোক ও আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ সমর্পণের অপূর্ব ভারসাম্য প্রকাশ পায়।
সাহাবিদের জন্য অশ্রু
সাহাবিদের প্রতি নবীজির ভালোবাসা ছিল পিতার চেয়েও গভীর। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) জায়দ, জাফর ও আবদুল্লাহ (রা.)-এর মৃত্যু সংবাদ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আসার আগেই আমাদের শুনিয়েছিলেন। তিনি বলছিলেন, জায়দ (রা.) পতাকা ধারণ করে শাহাদাত লাভ করেছে। অতঃপর জাফর (রা.) পতাকা ধারণ করে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করল। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) পতাকা হাতে নিয়ে শাহাদাত লাভ করল। তিনি যখন এ কথাগুলো বলছিলেন তখন তাঁর দুই চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল।’ (বুখারি: ৩৭৫৭)
আরও পড়ুন: সাহাবিদের চোখে প্রিয়নবীজির সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্ব
মৃত্যুর স্মরণে কান্না
হজরত বারা (রা.) থেকে বর্ণিত, আমরা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সঙ্গে এক জানাজায় উপস্থিত ছিলাম। তিনি কবরের কিনারে বসে কাঁদলেন, এমনকি তাঁর চোখের পানিতে মাটি ভিজে গেল। অতঃপর তিনি বলেন, ‘হে ভাই সব, তোমাদের অবস্থাও তার মতোই হবে, সুতরাং তোমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করো।’ (ইবনে মাজাহ: ৪১৯৫)
নবীজির (স.) কান্না আমাদের শেখায়- আবেগ দুর্বলতা নয়, বরং ঈমানের পরিপূর্ণতার নিদর্শন। তাঁর অশ্রু ছিল আল্লাহভীতি, মমতা ও মানবপ্রেমের প্রতীক। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আর তিনিই হাসান ও কাঁদান।” (সুরা নাজম: ৪৩) রাসুলুল্লাহ (স.)-এর চোখের প্রতিটি অশ্রুবিন্দু আমাদের মনে করিয়ে দেয়- সত্যিকার মানুষ হওয়া মানে হলো, আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির জন্য হৃদয়কে কোমল রাখা।

