ইসলামি স্কলার ও গবেষকরা স্পষ্ট করেছেন যে আল্লাহর ওলি বা প্রিয় বান্দা হওয়ার প্রকৃত মাপকাঠি কোনো অলৌকিক কারামত নয়, বরং তা হলো রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সুন্নতের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য এবং অন্তরে আল্লাহভীতির অবস্থান। বিভিন্ন ইসলামিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও মাদরাসায় এ বিষয়ে নিয়মিত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
কারামত নয়, সুন্নতই প্রধান বিবেচ্য
বিশেষজ্ঞ আলেমরা উল্লেখ করেন, অনেক মানুষ কারামতের দৃষ্টান্ত দেখে বিমোহিত হন। কিন্তু শরিয়তের সুস্পষ্ট নির্দেশনা হলো- সুন্নতের অনুসরণ ছাড়া মুক্তির কোনো পথ নেই। হজরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)-এর একটি ঘটনা উদ্ধৃত করে বলা হয়, যখন তাঁর কাছে জনৈক ব্যক্তির রাতারাতি মক্কা পৌঁছানোর কারামতের কথা বলা হলো, তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘এটি কোনো বড় অর্জন নয়। শয়তানও মুহূর্তেই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে যেতে পারে। তাই কেউ যতই বাতাসে উড়ে দেখাক, আগে পরীক্ষা করে নেবে যে, সে রাসুল (স.)-এর সুন্নতের রাজপথে অবিচল কি না?’ (বাসায়েরুল আশায়ের, পৃষ্ঠা-৬১২)
সুন্নতের অনুসরণই সর্বোত্তম আমল
হজরত মুজাদ্দিদে আলফে সানি (রহ.) এক মুরিদকে বলেন, ‘কারামতের ঠেলায় জমিন কেঁপে ওঠা বা মৃত ব্যক্তি জীবিত হয়ে যাওয়ার চেয়েও অজুর সময় মিসওয়াকের সুন্নত পালন করা হাজার গুণ উত্তম।’ (ফতোয়ায়ে রহিমিয়া: ২/১৯৫)
ইমাম আবু দাউদ (রহ.)-এর ঐতিহাসিক ঘটনা
ফাতহুল বারিতে বর্ণিত এক ঘটনায় দেখা যায়, ইমাম আবু দাউদ (রহ.) নৌসফরকালীন অবস্থায় জাহাজ থেকে নদীর পার দিয়ে গমনকারী এক পথিককে হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলতে শুনে এক দিরহামের বিনিময়ে নৌকা ভাড়া করে পারে গিয়ে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলেছিলেন। পরবর্তীতে জাহাজের যাত্রীরা স্বপ্নে দেখলেন, জনৈক ব্যক্তি ঘোষণা করছে, ‘নিশ্চয়ই আবু দাউদ এক দিরহামের বিনিময়ে জান্নাত ক্রয় করে নিয়েছে।’ (ফাতহুল বারি: ১০/৬১০-৬১১)
আমল কবুলের তিন শর্ত
আলেমগণ নির্দেশ করেন, আল্লাহর দরবারে আমল কবুল হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত পূরণ করা অপরিহার্য: ১. আকিদা বিশুদ্ধ হওয়া ২. সুন্নতের অনুসরণ করা ৩. নিয়ত সঠিক হওয়া
কোরআন-হাদিসের সুস্পষ্ট নির্দেশনা
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নত অপছন্দ করল তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’ (সহিহ বুখারি: ৪৭৭৬)
অন্য হাদিসে ইরবাদ ইবনে সারিয়া (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) আমাদের এ মর্মে অন্তিম উপদেশ দিয়েছেন, ‘তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নত এবং আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খলিফাদের সুন্নত কঠোরভাবে অনুসরণ করবে। সাবধান! (দ্বীনি বিষয়ে) নব আবিষ্কার সম্পর্কে! কারণ প্রতিটি নতুন আবিষ্কার হলো বিদআত এবং প্রতিটি বিদআত হলো ভ্রষ্টতা।’ (সুনান আবু দাউদ: ৪৬০৭)
আল্লাহ তাআলা কোরআন মজিদে নির্দেশ দেন, ‘বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমার অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সুরা আলে ইমরান: ৩১)
সুন্নতের ব্যাপক সংজ্ঞা
বিশ্লেষকরা ব্যাখ্যা করেন, ‘সুন্নত’ বলতে শুধু ধর্মীয় রীতিনীতি নয়, বরং রাসুলুল্লাহ (স.)-এর জীবনপদ্ধতি, আচরণ, আদর্শ ও নির্দেশনাসমূহকে বোঝায়, যা ইসলামের আকিদা-বিশ্বাস থেকে শুরু করে ইবাদত, লেনদেন ও শিষ্টাচারসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত।
আলেমদের বক্তব্য অনুযায়ী, আল্লাহর নৈকট্য লাভ এবং প্রকৃত মর্যাদা অর্জনের একমাত্র পথ হলো নবীজি (স.)-এর সুন্নতের পূর্ণ অনুসরণ। অতএব, কারামত নয় বরং সুন্নতের আনুগত্যই আল্লাহর নৈকট্য ও চূড়ান্ত সাফল্যের একমাত্র নিশ্চিত পথ।

