ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের চরিত্র, আচরণ ও কথাবার্তাকে পরিশুদ্ধ করতে চায়। একজন প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য হলো- সে সর্বাবস্থায় ভদ্র, মার্জিত ও সত্যভাষী। ক্রোধের মুহূর্তেও সে তার জিহ্বাকে সংযত রাখে; প্রয়োজনে যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রতিবাদ জানায়, কিন্তু কখনোই অশ্লীল ভাষা বা গালিগালাজের আশ্রয় নেয় না। বিপরীতে, যে ব্যক্তি রাগের বশে হুঁশ হারিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় অন্যকে আঘাত করে, তার এ আচরণ অমানবিকতার পরিচায়ক। ইসলামে গালিগালাজকে অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
কোরআনে গালিগালাজ নিষিদ্ধ
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে গালিগালাজ ও সম্মানহানিকর আচরণ থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর কোনো পুরুষকে উপহাস না করে। কেননা, হতে পারে যাকে উপহাস করা হচ্ছে, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম। আর কোনো নারীও যেন অপর কোনো নারীকে উপহাস না করে। কেননা যাকে উপহাস করা হচ্ছে, সে উপহাসকারিনী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করবে না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডাকবে না৷ আল্লাহর ওপর ঈমান আনার পর কাউকে মন্দ নামে ডাকা গর্হিত কাজ। যারা এ ধরনের আচরণ হতে নিবৃত্ত না হয় তারাই জালিম।’ (সুরা হুজুরাত ১১)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা বিনা অপরাধে ঈমানদার পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তারা অবশ্যই মিথ্যা অপবাদ এবং স্পষ্ট অপরাধের বোঝা বহন করে।’ (সুরা আহজাব: ৫৮) আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ করেছেন, ‘আর তোমরা তাদের গালি দিও না, যাদের তারা আল্লাহ ছাড়া ডাকে; নচেৎ তারা শত্রুতাবশত অজ্ঞতাবশে আল্লাহকেই গালি দেবে।’ (সুরা আনআম: ১০৮)
এসব আয়াত প্রমাণ করে যে, গালিগালাজ কেবল সামাজিক শিষ্টাচারবিরোধী নয়, বরং ঈমানের পরিপন্থী আচরণ।
আরও পড়ুন: বিকৃত নামে ডাকা মারাত্মক গুনাহ
বিজ্ঞাপন
হাদিসে গালিগালাজ কঠোরভাবে নিষেধ
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘মুমিন গালিগালাজকারী, অভিশাপদাতা ও অশ্লীলভাষী হয় না।’ (তিরমিজি ১৯৭৭) যৌক্তিক বা অযৌক্তিক কোনোভাবেই কাউকে গালি দেওয়ার অনুমতি ইসলামে নেই। এমনকি হাসি-কৌতুক ও ঠাট্টাচ্ছলেও অন্যকে গালি দেওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে অশোভনীয় ও নিন্দনীয়। আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকি (আল্লাহর অবাধ্যাচরণ) এবং তার সঙ্গে লড়াই ঝগড়া করা কুফরি।’ (বুখারি: ৬০৪৪)
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘চারটি স্বভাব যার মধ্যে রয়েছে, সে খাঁটি মুনাফিক এবং এর কোনো একটি স্বভাব থাকবে, তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকের একটি স্বভাব থেকে যায়। ১. আমানত রাখা হলে খেয়ানত করে; ২. কথা বললে মিথ্যা বলে; ৩. অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে; এবং ৪. বিবাদে লিপ্ত হলে অশ্লীলভাবে গালাগালি করে।’ (বুখারি: ৩৪)
হাদিসে আরও এসেছে, ‘পরস্পর গালি দেওয়া দুজনই দুই শয়তান, যারা একে অপরকে নিন্দা করে এবং মিথ্যা কথা বলে।’ (মুসনাদ আহমদ: ১৬৮৩৬)
শত্রুর প্রতিক্রিয়াতেও মার্জিত আচরণ বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন মহানবী (স.)। বলেছেন, ‘যখন কেউ তোমাকে এমন বিষয়ে গালি দেয় যা সে জানে, তুমি তাকে তার ত্রুটি ধরে গালি দিয়ো না। এতে তোমার জন্য পুণ্য এবং তার জন্য পাপ।’ (সহিহুল জামে: ৫৯৪)
‘যদি কোনো ব্যক্তি তোমাকে গালি দেয় এবং যে ত্রুটি তোমার মধ্যে নেই, তা নিয়ে তোমাকে লজ্জা দেয়, তুমি তাকে সেই ত্রুটি নিয়ে লজ্জা দিয়ো না, যা ওর মধ্যে আছে। ওকে উপেক্ষা করে চল। ওর পাপ ওর উপর এবং তোমার পুণ্য তোমার জন্য। আর অবশ্যই কাউকে গালি দিয়ো না।’ (ইবনে হিব্বান: ৫২১)
আরও পড়ুন: ১০টি কঠিন গুনাহ হয় শুধু মুখের কারণে
গালিগালাজ কবিরা গুনাহ
হাদিসে এসেছে, ‘কবিরা গুনাহগুলোর একটি হলো নিজের বাবা-মাকে অভিশাপ করা।’ জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আল্লাহর রাসুল! মানুষ নিজের বাবা-মাকে কীভাবে অভিশাপ করে?’ তিনি বললেন, ‘যখন সে অন্যের বাবাকে গালি-গালাজ করে, তখন সে নিজের বাবাকেও গালি-গালাজ করে থাকে। আর সে অন্যের মাকে গালি দেয়, বিনিময়ে সে তার মাকেও গালি দেয়।’ (বুখারি: ৫৯৭৩; তিরমিজি: ১৯০২)
আখেরাতে ভয়াবহ পরিণতি
গালিগালাজ কেবল দুনিয়ার নয়, আখেরাতেরও ভয়ংকর শাস্তির কারণ। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় বান্দা কখনও আল্লাহর সন্তুষ্টির কোনো কথা বলে অথচ সে কথা সম্পর্কে তার চেতনা নেই। কিন্তু এ কথার দ্বারা আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আবার বান্দা কখনও আল্লাহর অসন্তুষ্টির কথা বলে ফেলে যার পরিণতি সম্পর্কে তার ধারণা নেই, অথচ সে কথার কারণে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।’ (বুখারি: ৬৪৭৮)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে অন্যের সম্মানহানি করেছে বা জুলুম করেছে, সে যেন দুনিয়াতেই ক্ষমা চেয়ে নেয় ওইদিনের আগে, যেদিন কোনো সম্পদ (দিনার-দিরহাম) কাজে লাগবে না।’ (বুখারি: ২৪৪৯)
আরও পড়ুন: সবসময় ইস্তেগফার করলে ১৫ নেয়ামত লাভ হয়
গালিগালাজ থেকে মুক্তির উপায়
- তাকওয়া অর্জন: সর্বদা সচেতন থাকা যে আল্লাহ আমাদের প্রতিটি কথা শুনছেন।
- জিহ্বার সংযম: নবী (স.) বলেছেন, ‘যে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ (বুখারি)
- রাগ নিয়ন্ত্রণ: ‘রাগ করো না।’ (বুখারি)
- দোষ উপেক্ষা: অন্যের গালির জবাবে নীরবতা ও ধৈর্য ধারণ করা।
- ইস্তেগফার: জিহ্বাকে শুদ্ধ রাখতে নিয়মিত তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করা।
মোটকথা, গালিগালাজ ইসলামে কোনো তুচ্ছ বিষয় নয়; এটি একটি কবিরা গুনাহ, যা ঈমান দুর্বল করে, সম্পর্ক নষ্ট করে এবং সমাজে বিদ্বেষ ছড়ায়। একজন সত্যিকার মুমিনের পরিচয় হলো- তার মুখে থাকে নরম, সত্য ও কল্যাণকর শব্দ। মার্জিত ভাষা মুমিনের অলংকার, আর গালিগালাজ শয়তানের অস্ত্র।
সংক্ষিপ্ত বার্তা
‘মুমিনের জিহ্বা সর্বদা পবিত্র, তার কথায় থাকে মাধুর্য, ক্রোধে থাকে সংযম’। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে জিহ্বার নিয়ন্ত্রণ, সুন্দর আচরণ ও ভদ্র ভাষার অভ্যাস দান করুন। আমিন।

