রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

নবীজি (স.) প্রতি মাসে কয়টি রোজা রাখতেন?

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩ আগস্ট ২০২৫, ০৬:৪৪ পিএম

শেয়ার করুন:

নবীজি (স.) প্রতি মাসে কয়টি রোজা রাখতেন?

রাসুলুল্লাহ (স.)-এর রোজা রাখার অভ্যাস ছিল অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। এর মাধ্যমে তিনি উম্মতকে বিভিন্ন সময়ে রোজা রাখার গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছেন। যদিও ফরজ রোজা শুধু রমজান মাসেই সীমাবদ্ধ, নফল রোজা হিসেবে তিনি প্রায় সারাবছরই বিভিন্ন দিনে রোজা রাখতেন। তাঁর রোজা রাখার নির্দিষ্ট সংখ্যা মাসের তারতম্যে ভিন্ন হতো, তবে কিছু বিশেষ দিনের রোজা ছিল তাঁর নিত্যদিনের আমল।

প্রতি মাসে নবীজির (স.) রোজার সংক্ষিপ্ত তালিকা

নবীজি (স.) প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সংখ্যক রোজা রাখতেন, তবে এর সংখ্যা সবসময় এক রকম ছিল না। বিভিন্ন হাদিসে তাঁর রোজা রাখার অভ্যাস সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়।

প্রতিমাসের তিনদিন রোজা (আইয়ামে বিজ): রাসুলুল্লাহ (স.) প্রায়শই প্রতি মাসের তিনদিন রোজা রাখতেন। এই তিনটি দিন ছিল আইয়ামে বিজ (চাঁদের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ)। এটি ছিল তাঁর নিয়মিত আমল।

আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবীজি (স.) যখন সফরে যেতেন, তখন বলতেন, ‘প্রতি মাসে তিনদিন রোজা রাখা যেন সারাবছর রোজা রাখার মতো।’ (আবু দাউদ: ২৪৪৯) আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন- ‘প্রতি মাসে তিনদিন রোজা রাখা সারাজীবন রোজা রাখার সমান।’ (বুখারি: ১৯৭৯)

সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোজা: নবীজি (স.) সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখতে পছন্দ করতেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন- ‘সোমবার ও বৃহস্পতিবার আল্লাহর কাছে আমলসমূহ পেশ করা হয়। তাই আমি চাই আমার আমলগুলো রোজা রাখা অবস্থায় পেশ করা হোক।’ (তিরমিজি: ৭৪৭)


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: সোম-বৃহস্পতিবার রোজা রাখার ফজিলত

সাধারণত, প্রতি মাসে ৪টি সোমবার ও ৪টি বৃহস্পতিবার থাকে। যদি তিনি এই ৮টি রোজা ছাড়াও আইয়ামে বিজ-এর ৩টি রোজা রাখতেন, তাহলে তাঁর মাসিক রোজার সংখ্যা প্রায় ১১-১২টি হতে পারে।

শাবান মাসের অধিক রোজা: রাসুলুল্লাহ (স.) রমজান ছাড়া অন্য যে মাসে সবচেয়ে বেশি রোজা রাখতেন তা ছিল শাবান মাস। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবীজি (স.) শাবান মাসের মতো এত বেশি রোজা অন্য কোনো মাসে রাখতেন না। তিনি প্রায় পুরো শাবান মাস রোজা রাখতেন।’ (বুখারি: ১৯৭০; মুসলিম: ১১৫৬)
তবে হাদিসের ব্যাখ্যায় বোঝা যায়, তিনি পুরো মাস রোজা রাখতেন না, বরং অধিকাংশ দিন রোজা রাখতেন, যাতে রমজানের রোজা পালনের প্রস্তুতি হয়।

আশুরার রোজা: মহররম মাসের বিশেষ রোজা

মহররম মাসে রাসুলুল্লাহ (স.) আশুরার রোজা রাখতেন এবং এর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। 

আশুরার দিনের (১০ই মহররম) রোজা: এই রোজা ছিল ইহুদিদেরও আমল, কিন্তু এর গুরুত্ব ইসলামে আরও বাড়ানো হয়।

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) মদিনায় এসে দেখলেন ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটি কোন দিন যে তোমরা রোজা রাখো?’ তারা বলল, ‘এটি এক মহান দিন, যেদিন আল্লাহ মুসা (আ.) ও তাঁর কওমকে ফেরাউনের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং ফেরাউনকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। তাই মুসা (আ.) শুকরিয়াস্বরূপ এই দিনে রোজা রেখেছিলেন।’ রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, ‘মুসার (আ.) ক্ষেত্রে তোমাদের চেয়ে আমাদের অধিকার বেশি।’ অতঃপর তিনি নিজেও রোজা রাখলেন এবং রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন।’ (বুখারি: ৩৩৯৭)

৯ই বা ১১ই মহররমের রোজা: পরবর্তীতে নবীজি (স.) আশুরার রোজার সাথে আরও একদিন রোজা রাখার কথা বলেন, যাতে ইহুদিদের সাথে পার্থক্য হয়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যদি আমি আগামী বছর জীবিত থাকি, তবে অবশ্যই ৯ই মহররম রোজা রাখব।’ (মুসলিম: ১৯৪৬)
এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ১০ই মহররমের সাথে ৯ তারিখ অথবা ১১ তারিখেও রোজা রাখা।

আরও পড়ুন: আশুরার রোজা যে কারণে ২টি রাখতে হয়

সাহাবিদের অনুশীলন: অনুপ্রেরণামূলক দৃষ্টান্ত

নবীজি (স.)-এর রোজা রাখার অভ্যাস সাহাবিদের জীবনেও গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তাঁরাও তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে নফল রোজা রাখতেন। তাঁদের অনুশীলন আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।

আবু হুরায়রা (রা.): তিনি নবীজি (স.)-এর তিনটি বিশেষ অসিয়তের কথা উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘প্রতি মাসে তিন দিন রোজা রাখা।’ এটি আবু হুরায়রা (রা.)-এর নিয়মিত আমল ছিল। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘আমার বন্ধু (রাসুলুল্লাহ স.) আমাকে তিনটি বিষয়ে অসিয়ত করেছেন: প্রতি মাসে তিন দিন রোজা রাখা, চাশতের দুই রাকাত নামাজ পড়া এবং ঘুমানোর আগে বিতির আদায় করা।’ (বুখারি: ১১৭৮; মুসলিম: ৭২১)

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.): তিনি রোজা রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত আগ্রহ রাখতেন। নবীজি (স.) তাঁকে দাউদ (আ.)-এর রোজার উদাহরণ দিয়েছিলেন, যা ছিল একদিন বিরতি দিয়ে রোজা রাখা। এটি ছিল সবচেয়ে উত্তম নফল রোজা। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘সর্বোত্তম রোজা হলো আমার ভাই দাউদ (আ.)-এর রোজা। তিনি একদিন রোজা রাখতেন, আর একদিন ইফতার করতেন।’ (তিরমিজি: ৭৬৮)
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) এই রোজার অভ্যাসে এতটাই অভ্যস্ত ছিলেন যে, বার্ধক্যেও তিনি এই কঠিন আমলটি ত্যাগ করতে পারেননি এবং অনুশোচনা প্রকাশ করতেন যে, তিনি কেন নবীজির (স.) দেওয়া সহজ বিকল্পগুলো গ্রহণ করেননি।

সারা বছর রোজা না রাখার কারণ

রাসুলুল্লাহ (স.) প্রায় সারা বছর রোজা রাখলেও, তিনি কখনো লাগাতার রোজা রাখতেন না। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি নবী কারিম (স.)-কে শাবান মাসের মতো এত অধিক রোজা অন্যকোনো মাসে রাখতে দেখিনি। এ মাসের শেষদিকের অল্প ক’দিন ছাড়া বলতে গেলে সারা মাসই তিনি রোজা রাখতেন। (তিরমিজি: ৭৩৭)
এর কারণ হলো, তিনি উম্মতের জন্য সহজীকরণ চেয়েছিলেন এবং চাইতেন না যে রোজা রাখা তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়, যা ফরজ ইবাদতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

সংক্ষেপে বলা যায়, নবীজি (স.) প্রতি মাসে সুনির্দিষ্টভাবে কতটি রোজা রাখতেন তার কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই, যা প্রতি মাসের জন্য কঠোরভাবে নির্ধারিত ছিল। তবে তাঁর নিয়মিত আমল ছিল প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ (আইয়ামে বিজ) এবং সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোজা। এছাড়া, শাবান মাসে তিনি অধিক পরিমাণে রোজা রাখতেন এবং মহররম মাসের আশুরার দিনেও রোজা রাখতেন। তাঁর রোজা রাখার উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর নৈকট্য অর্জন এবং উম্মতের জন্য আদর্শ স্থাপন করা, যাতে তারা নফল রোজার ফজিলত সম্পর্কে জানতে পারে। তাঁর সাহাবিরাও এই পথে চলে দ্বীনের প্রতি নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করেছেন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর