শুক্রবার, ১৮ জুলাই, ২০২৫, ঢাকা

কারবালা নিয়ে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন নবীজি

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬ জুলাই ২০২৫, ০৭:৫১ পিএম

শেয়ার করুন:

কারবালা নিয়ে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন নবীজি

ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী ঘটনা কারবালার ট্র্যাজেডি সম্পর্কে নবীজি (স.) কতগুলো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে অবিকলভাবে বাস্তবায়িত হয়। এই প্রতিবেদনে আমরা কোরআন-হাদিস ও প্রামাণ্য ঐতিহাসিক দলিলের আলোকে সেই ভবিষ্যদ্বাণীগুলো বিশ্লেষণ করব।

১. সরাসরি ভবিষ্যদ্বাণী: ফোরাত নদীর তীরে শাহাদাত

উম্মে সালামা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘একদিন নবীজি (সা.) হুসাইন (রা.)-কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। আমি কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন- ‘জিবরাইল আমাকে জানিয়েছেন যে আমার উম্মতের একদল লোক তাকে ফোরাত নদীর তীরে হত্যা করবে।’ (মুসতাদরাক হাকিম: ৪/৩৯৮, সহিহ)

বিশেষ দিক: স্থানের নাম উল্লেখ (ফোরাত নদী), হত্যাকারীদের পরিচয় (নবীজির উম্মত) এবং ভবিষ্যদ্বাণীর সময় হুসাইন (রা.) শিশু ছিলেন। 

২. রক্তরঞ্জিত মাটির অলৌকিক ইঙ্গিত

উম্মে সালামা (রা.) আরও বর্ণনা করেন, ‘জিবরাইল (আ.) নবীজি (স.)-কে কারবালার মাটি দেখিয়েছিলেন। একদিন আমি দেখলাম নবীজি (স.) হাত থেকে কিছু লাল মাটি ফেলছেন। আমি জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন- ‘জিবরাইল আমাকে জানিয়েছেন যে এটা সেই মাটি যেখানে আমার হুসাইন শহীদ হবে।’ (সুনান তিরমিজি: ৩৭৭৬, হাসান)


বিজ্ঞাপন


ঐতিহাসিক সত্য: কারবালার মাটি প্রকৃতপক্ষে লালচে, হুসাইন (রা.)-এর রক্তে মাটি রঞ্জিত হয়েছিল।

আরও পড়ুন: নবীজির বাগানের দুই ফুল হজরত হাসান ও হুসাইন (রা.)

৩. নাতির জন্য নবীর অশ্রু

আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘একদিন নবীজি (স.) হুসাইন (রা.)-কে কোলে নিয়ে কাঁদছিলেন। আমরা কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন- ‘একে আমার উম্মতের একদল লোক হত্যা করবে। তাদের জন্য আল্লাহর কাছে কোনো সুপারিশ আমার থাকবে না।’ (মুসনাদ আহমদ: ১৩৯৯, সহিহ)

গুরুত্বপূর্ণ তথ্য: হত্যাকারীদের জন্য নবীর সুপারিশ না করার ঘোষণা, ঘটনার ৫০ বছর আগেই ভবিষ্যদ্বাণী এবং হত্যাকারীদের জন্য চূড়ান্ত শাস্তির ইঙ্গিত।

উল্লেখ্য, হাদিসে বর্ণিত ‘ফোরাতের তীর’ ও মাটি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য থাকলেও হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার বিষয়টি অন্যান্য সহিহ হাদিস দ্বারা সমর্থিত: (সুনান তিরমিজি: ৩৭৭৫, মুসনাদ আহমদ: ১৩৯৯)

৪. কোরআনের আয়াত দ্বারা ইঙ্গিত

তাফসির: ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন- ‘সুরা আল-ইসরার ৩৩ নং আয়াত 'وَلاَ تَقْتُلُوا النَّفْسَ' (আর তোমরা কাউকে হত্যা করো না) বিশেষভাবে হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের প্রতি ইঙ্গিত করে।’ (তাফসির ইবনে কাসির: ৩/৫৬)
তবে আয়াতটি ব্যাপক অর্থে প্রযোজ্য তথা সকল নিষ্পাপ ব্যক্তির হত্যা নিষিদ্ধ। ‘ইবনে আব্বাসের ব্যাখ্যা আয়াতের একটি বিশেষ প্রয়োগ মাত্র।’ (রুহুল মাআনি ১৫/৮৯)

আয়াতের বিশেষত্ব: নিষিদ্ধ হত্যার পরিণাম সম্পর্কে সতর্কতা এবং শহীদদের বিশেষ মর্যাদার ইঙ্গিত।

আরও পড়ুন: ইমাম হুসাইনের (রা.) মহান আত্মত্যাগের উদ্দেশ্য: একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ

৫. সাহাবায়ে কেরামের সতর্কতা

ইবনে ওমর (রা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী: ‘হুসাইন (রা.) যখন মদিনা ত্যাগ করেন, ইবনে ওমর (রা.) বলেছিলেন- ‘তুমি শাহাদাত বরণ করবে, কারণ আমি নবীজি (স.)-কে বলতে শুনেছি...’ (তারিখ দিমাশক: ১৪/২০১)

ইবনে আব্বাস (রা.)-এর হুঁশিয়ারি: ‘কুফাবাসীদের বিশ্বাস করো না, তারা তোমার পিতাকে হত্যা করেছিল।’ (আল-ইসাবা: ১/৩৩৩)

৬. ভবিষ্যদ্বাণী উপেক্ষার কারণ

  • ইয়াজিদের শক্তি দেখে অনেকেই নীরব থাকলেন
  • হজরত আলী (রা.)-এর সময় থেকেই কুফাবাসীর খারাপ রেকর্ড
  • মুসলিম উম্মাহ তখন বিভক্ত ছিল

৭. আমাদের জন্য শিক্ষা

১. নবীর বাণী গুরুত্বসহকারে নেওয়া: প্রতিটি হাদিস গভীরভাবে বিবেচনা করা।
২. ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ: অতীতের ভুলগুলো যেন না হয়, সেজন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা।
৩. সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো: ভয় ও লোভের কাছে নতি স্বীকার না করা।

চিরন্তন হাদিস

حُسَيْنٌ مِنِّي وَأَنَا مِنْ حُسَيْنٍ ‘হুসাইন আমার থেকে এবং আমি হুসাইন থেকে।’ (সুনান তিরমিজি: ৩৭৭৫)

আজকের কারবালা: সময়ের পরীক্ষা

হুসাইন (রা.)-এর রক্ত আজও প্রশ্ন করে- ‘তোমাদের মধ্যে কয়জন সত্যিই নবীর উম্মত?’ ক্ষমতার লোভে যখন ন্যায় বিসর্জন দেয়া হয়, সুবিধাবাদিতায় যখন সত্য চেপে রাখা হয় এবং ভয়ের কাছে যখন মাথা নত করা হয়, সেই মুহূর্তেই আমরা আবারও কারবালার ময়দানে দাঁড়িয়ে যাই!

কারবালার মরুভূমিতে যে রক্ত ঝরেছিল, তা শুধু হুসাইন (রা.)-এর নয়; সে রক্তে লেখা হয়েছে প্রতিটি যুগের মুমিনের জন্য এক অনন্ত প্রশ্ন- ‘আমরা কি সত্যিই শিক্ষা নিয়েছি, নাকি আবারও সেই একই পথে হাঁটব?’

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর