হজ প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সব মহলেই ব্যাপক অনীহা। সরকারও যথাযথভাবে হজের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে না। প্রশিক্ষণ না থাকায় সেখানে গিয়ে হাজিরা নানা ধরনের জটিলতায় পড়েন এবং হজ সঠিকভাবে পালন হয় না। এছাড়া হজের প্রক্রিয়া যেহেতু বছরব্যাপী হয়ে থাকে, তাই এই প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্ন করতে বাংলাদেশে একটি হজ অধিদফতর গঠন করতে হবে।
রোববার (২৭ এপ্রিল) দৈনিক সময়ের আলোর কনফারেন্স রুমে আয়োজিত ‘হজ ২০২৫: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এসব কথা বলেন ইসলামিক স্কলার্স, হজবিষয়ক বিশেষজ্ঞ লেখক-সাংবাদিক ও হজ এজেন্সির মালিকরা।
বিজ্ঞাপন
সৌদি ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে হজ বিষয়ে নানা সমন্বয়হীনতার কথা তুলে ধরে হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)-এর মহাসচিব ফরিদ আহমেদ মজুমদার বলেন, হজের বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে আমাদের হাত-পা বেঁধে সাগরে ছেড়ে দেওয়া হয়। আমাদের বলা হয় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনলাইনে সব কাজ শেষ করতে। কিন্তু সৌদিতে হোটেলগুলো তাদের আপডেট নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জানায় না। ফলে আমাদের বিড়ম্বনা বাড়ে।
হাব মহাসচিব বলেন, প্রাক-নিবন্ধনের পর প্রশিক্ষণ আবশ্যক করা দরকার। প্রশিক্ষণ সার্টিফিকেট পেলে তারপর যেন চূড়ান্ত নিবন্ধনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
হাব মহাসচিব আরও বলেন, সৌদি সরকার প্রতি বছর হজ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনে। এগুলো এক বছর আগে বা নিবন্ধনের আগে জানালে আমাদের হজ ব্যবস্থাপনা করতে সুবিধা হয়। এ বছর নিবন্ধনের পর তারা জানিয়েছে, ১৫ বছরের নিচের কেউ হজে যেতে পারবে না। অথচ এর মধ্যে অনেকেই নিবন্ধন করে ফেলেছেন। এই নিয়মের কারণে এবার বহু পরিবার হজে যেতে পারছে না।
হজ প্রশিক্ষক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব গাজী মুহাম্মদ সানাউল্লাহ রাহমানী বলেন, হজ এজেন্সির বিরুদ্ধে হজযাত্রীদের অনেক অভিযোগ থাকে। দেখা যায় হাজীরা যে টাকা দিয়েছেন, সে অনুযায়ী সার্ভিস পাচ্ছেন না। আবার দেখা যায়, একজন পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে আরেকজন আট লাখ টাকা দিয়েছে। উভয়ে একই মানের একই হোটেলে অবস্থান করছে। এসব নিয়ে দোষারোপের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। আবার দেখা যায়, হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা পাঁচ দিন থেকে এক সপ্তাহের মতো। আল্লাহর রাসুলের সময় হজের সফরের সময় ছিল নয় দিন। কিন্তু এখন দেখা যায়, হজের প্যাকেজ করা হয় চল্লিশ দিনের। তো হাজীরা বিশ দিন পরই দেশে ফেরার জন্য ছটফট করতে থাকে। তাই হজের প্যাকেরজের সময়সীমা যদি ২০ দিনের মধ্যে নিয়ে আসা যায় তাহলে ভালো হয়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, হাজীরা হজের মাসয়ালা না জেনেই হজে চলে যান।
বিজ্ঞাপন
তিনি প্রস্তাব রেখে বলেন, সরকার ও হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) তত্ত্বাবধানে যারা হজ করতে যাবেন তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদের মানসিক বিষয়গুলো প্রস্তুত করতে হবে। তারা যতক্ষণ না পর্যন্ত মানসিকভাবে প্রস্তুত হবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদের জন্য ট্রেনিং ইনস্টিটিউট করে সেখান থেকে সার্টিফিকেট দিতে হবে।
আলওয়াসি হজ গ্রুপের চেয়ারম্যান ও নীড় ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী মাওলানা আবদুল গাফফার খান বলেন, অধিকাংশ হাজি জানেন না, কীভাবে হজ করতে হয়। অথচ হাজির দায়িত্ব হজ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে হজে যাওয়া। দেখা যায়, হজ প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সব মহলেই ব্যাপক অনীহা। সরকারও যথাযথভাবে হজের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে না।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, যখন সরকারিভাবে হজ প্রশিক্ষণের আয়োজন করে তখন প্রশিক্ষকদের সময় দেওয়া হয় মাত্র দুই মিনিট। আর পুরো প্রোগ্রামজুড়ে শুধু হয় রাজনীতির আলোচনা। অনেক হাজী চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে ধোঁকা খেয়ে যান। অনলাইনে সুন্দর বিজ্ঞাপন দেখেই হজের জন্য টাকা দিয়ে বসে থাকেন। পরে হজের সময় হজ ক্যাম্পে এসে দেখেন সেই এজেন্সি লাপাত্তা। সরকারের উচিত লাইসেন্সবিহীন এজেন্সির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।
জাবাল-ই-নুর ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ জুনায়েদ গুলজার বলেন, হজের অয়োজনের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকার, সৌদি আরবের সরকার এবং হজ এজেন্সিরা যুক্ত থাকে। কিছু ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণই বাংলাদেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন, কিছু ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণই সৌদি আরবের সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন আর কিছু ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করে হজ এজেন্সিগুলো। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেখা যায়, অধিকাংশ হজযাত্রীর অভিযোগের তীর থাকে কেবলই হজ এজেন্সির দিকে। এটা খুবই দুঃখজনক। একজন মুয়াল্লিম নিজের আরাম-ঘুম সব বিসর্জন দিয়ে হাজীদের খেদমত করেন, কিন্তু তিনিই সবচেয়ে বেশি অভিযোগের শিকার হন।

গোলটেবিল বৈঠকে স্কলার আলেম মুফতি মুহাম্মদ আমিমুল এহসান বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে হজের দায়িত্ব দেওয়া হলে ৯০ ভাগ সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। যারা খুব ভালো আরবি ভাষায় কথা বলতে পারেন তাদেরকে সৌদি আরবে বাংলা টিমে রাখা গেলে হজের সময় হাজীদের জন্য ভালো হবে। সেখানে বাংলাদেশের যে টিম থাকে তারা অনেকটা দুর্বল। তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
সাংবাদিক মুফতি এনায়েতুল্লাহ গোলটেবিল বৈঠকে হজ অধিদফতর করার দাবি জানান। তিনি বলেন, হজ অধিদফতরে সরকারের লোক, এজেন্সির লোক ও ইসলামিক স্কলার্সরা থাকবেন। যেহেতু হজের কাজটি সারা বছরব্যাপী হয়ে থাকে। ফলে এটি কার্যকর করতে হজ ব্যবস্থাপনার জন্য হজ অধিদফতর করা জরুরি।
শেফার্ডস হজ অ্যান্ড ওমরাহ সার্ভিসেসের ম্যানেজিং পার্টনার আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সালেহ বলেন, হজের সময় এয়ারলাইন্সের শিডিউল নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। এই শিডিউল সমস্যার কারণে আমরা সৌদি আরবে বাড়ি ভাড়া করতে অসুবিধায় পড়ি। সৌদিরা প্রতি বছরই নিয়ম পরিবর্তন করে। এটা যদি আগেই জানানো হয় তবে আমাদের জন্য ভালো হয়। এবার কিন্তু আমরা বাচ্চাসহ রেজিস্ট্রেশন করেছি। কিন্তু কিছুদিন পরে জানানো হলো বাচ্চাদের এবার নেবে না। এই সিদ্ধান্ত যদি রেজিস্ট্রেশনের আগে জানানো হতো, তবে খুব ভালো হতো।
সময়ের আলোর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিমের সভাপতিত্বে ও সিনিয়র সাব-এডিটর এবং ইসলাম বিভাগের প্রধান আমিন ইকবালের সঞ্চালনায় গোলটেবিল আয়োজনে আরও উপস্থিত ছিলেন আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেডের ডিরেক্টর ফয়সাল আর ফেরদৌস, চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) মুনিফ আম্মার, আমিন ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের ম্যানেজিং পার্টনার ইঞ্জিনিয়ার মো. ওবায়দুল হক, মাই ঢাকা ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের চেয়ারম্যান মাওলানা আহমদ আলী, মাবরুর এয়ার ট্রাভেলসের পরিচালক হাফেজ মাওলানা হানযালা, আরিশ ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের পরিচালক জহিরুল ইসলাম, ব্রডওয়ে ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস লিমিটেডের পরিচালক মাহমুদুর রহমান, তাহমিদ এয়ার ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মুসয়াব তাহমিদ প্রমুখ।
জেবি

