নামাজে কিছু কাজ রয়েছে যেগুলো যথাযথভাবে আদায় করা ওয়াজিব বা আবশ্যক। তন্মধ্যে আত্তাহিয়াতু বা তাশাহুদ অন্যতম। নামাজি ব্যক্তি নামাজের মধ্যে যখন মৌখিকভাবে তাওহিদের সাক্ষ্য দেয়, তখন তার আঙুলও এই সাক্ষ্য দেবে। এজন্য আত্তাহিয়াতু পড়তে পড়তে যখন ‘আশহাদু আল্লা... ইলাহা’ পর্যন্ত পৌঁছবে, তখন বৃদ্ধাঙ্গুলি ও মধ্যমা দ্বারা গোল ভিত্ত বানাবে এবং শাহাদত আঙুল দ্বারা ইশারা করবে। আর কনিষ্ঠা ও অনামিকা হাতের তালুর সঙ্গে যুক্ত থাকবে। 'ইল্লাল্লাহ' বলার পর শাহাদত আঙুল নিচু করবে। তবে অন্য আঙুলগুলো আপন অবস্থায় নামাজের শেষ পর্যন্ত থাকবে। বৃদ্ধাঙ্গুলির নিকটতম আঙুলকে শাহাদত আঙুল বলা হয়। ইশারা শেষ করে আঙুল আর নাড়াচড়া করবে না।
হজরত ইবনে ওমর (রা.) বর্ণিত অন্য হাদিসে এসেছে— عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- كَانَ إِذَا قَعَدَ فِى التَّشَهُّدِ وَضَعَ يَدَهُ الْيُسْرَى عَلَى رُكْبَتِهِ الْيُسْرَى وَوَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى رُكْبَتِهِ الْيُمْنَى وَعَقَدَ ثَلاَثَةً وَخَمْسِينَ وَأَشَارَ بِالسَّبَّابَةِ রাসুল (স.) যখন তাশাহুদের জন্য বসতেন, তখন বাম হাতকে রাখতেন বাম হাঁটুর উপর এবং ডান হাতখানা ডান হাঁটুর উপর রাখতেন। আর (হাতের তালু ও আঙ্গুলসমূহ গুটিয়ে আরবি) তিপ্পান্ন সংখ্যার মতো করে শাহাদাত আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করতেন। (সহিহ মুসলিম: ১৩৩৮)
বিজ্ঞাপন
আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের (রা.) থেকে বর্ণিত— عن عبد الله بن الزبير أن النبي صلى الله عليه وسلم كان يشير بأصبعه إذا دعا ولا يحركها ‘রাসুল (স.) যখন দোয়া পড়তেন (অর্থাৎ তাশাহুদ পড়তেন), তখন আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করতেন, কিন্তু আঙ্গুল নাড়াতেই থাকতেন না।’ (সুনানে নাসায়ি কুবরা: ১১৯৩, সুনানে আবু দাউদ: ৯৮৯, মুসনাদে আবি আওয়ানা: ১৫৯৪)
বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, আমরা যখন রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সঙ্গে সালাত আদায় করতাম তখন এ দোয়া পাঠ করতাম, “আসসালা-মু আলাল্ল-হি ক্বাবলা ইবাদিহী, আসসালা-মু আলা-জিবরীলা, আসসালা-মু আলা- মীকায়ীলা, আসসালা-মু আলা- ফুলা-নিন” (অর্থাৎ আল্লাহর ওপর সালাম তাঁর বান্দাদের আগে, জিব্রাইলের ওপর সালাম, মিকায়িল-এর ওপর সালাম। সালাম অমুকের ওপর)। রাসুলুল্লাহ (স.) যখন সালাত শেষ করলেন, আমাদের দিকে ফিরে বললেন, “আল্লাহর ওপর সালাম” বলো না। কারণ আল্লাহ তো নিজেই সালাম (শান্তিদাতা)। তোমরা সালাতে বসলে বলবে, “আত্তাহিয়্যাতু লিল্লা-হি ওয়াসসালাওয়া-তু.....ওয়াআলা- ইবা-দিল্লা-হিস স-লিহীন” (অর্থ: যাবতীয় সম্মান, যাবতীয় উপাসনা ও যাবতীয় পবিত্র বিষয় আল্লাহর জন্য। হে নবী! আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক এবং আল্লাহর অনুগ্রহ ও সমৃদ্ধিসমূহ নাজিল হোক। শান্তি বর্ষিত হোক আমাদের ওপর ও আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দাগণের ওপর।) নবী (স.) বললেন, কোনো ব্যক্তি এ কথাগুলো বললে এর বারাকাত আকাশ ও মাটির প্রত্যেক নেক বান্দার কাছে পৌঁছবে। এরপর নবী (স.) বললেন, “আশহাদু আল্লা- ইলা-হা ইল্লাল্ল-হু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রসূলুহু”- (অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও রাসুল)। নবী (স.) বললেন, এরপর আল্লাহর বান্দার কাছে যে দোয়া ভালো লাগে সে দোয়া পাঠ করে আল্লাহর মহান দরবারে আকুতি মিনতি জানাবে। (বুখারি: ৮৩৫, ৬২৩০, মুসলিম: ৪০২, আবু দাউদ: ৯৬৮, নাসায়ি: ১২৯৮, ইবনু মাজাহ: ৮৯৯, আহমদ ৪১০১, মেশকাত ৯০৯। হাদিসের মান সহিহ)
আঙ্গুল নাড়াতে থাকার পক্ষের একটি হাদিস হলো–ﺛُﻢَّ ﻗَﺒَﺾَ ﺍﺛْﻨَﺘَﻴْﻦِ ﻣِﻦْ ﺃَﺻَﺎﺑِﻌِﻪِ ﻭَﺣَﻠَّﻖَ ﺣَﻠْﻘَﺔً، ﺛُﻢَّ ﺭَﻓَﻊَ ﺇِﺻْﺒَﻌَﻪُ ﻓَﺮَﺃَﻳْﺘُﻪُ ﻳُﺤَﺮِّﻛُﻬَﺎ ﻳَﺪْﻋُﻮ ﺑِﻬَﺎ রাসুলুল্লাহ (স.) দুটি আঙ্গুল গুটিয়ে বৃত্ত তৈরি করলেন আর আঙ্গুল উঠালেন। আমি দেখেছি তিনি সেটা নাড়াচাড়া করছেন; তা দ্বারা দোয়া করছেন। (নাসায়ি: ৮৯২)
এই হাদিসের ব্যাপারে আল্লামা ইবনে খুজাইমা (রহ.) বলেন, ‘শুধু এই হাদিসটি ছাড়া কোনো হাদিসে আঙ্গুল নাড়াচাড়া করার অংশটি নেই। এটি এখানে অতিরিক্ত বর্ণিত হয়েছে। (সহিহ ইবনে খুজাইমার ৭১৪ নম্বর হাদিসের আলোচনা) ইমাম বায়হাকি (রহ.) বলেন, ‘আঙ্গুল নাড়াতে থাকা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- ইশারা করা। আঙ্গুল নাড়াতেই থাকা উদ্দেশ্য নয়। এভাবে অর্থ নিলে হাদিসটি আব্দুল্লাহ বিন জুবাইর (রা.) এর বর্ণনার সাথেও মিলে যায়। (সুনানে বায়হাকি কুবরা: ২৬১৫)
বিজ্ঞাপন
এরপরও আঙ্গুল নাড়াতে থাকা হাদিসের ওপর যারা আমল করতে চান, তাদের ব্যাপারে আলেমদের পরামর্শ হলো— অন্য মুসল্লিদের নামাজের মনোযোগ যেন নষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অর্থাৎ ‘এমন দ্রুত নাড়ানো উচিত নয়, যা পাশের মুসল্লির দৃষ্টি কেড়ে নেয়।’ (মেশকাত: ৭৫৭, মিরআত: ১/৬৬৯)
তিন অথবা চার রাকাতবিশিষ্ট নামাজের দুই রাকাতের পর বৈঠক করা ওয়াজিব। (বুখারি: ১/১১৪, হাদিস: ৮২৮) এবং প্রথম ও শেষ উভয় বৈঠকে আত্তাহিয়াতু পড়া ওয়াজিব। (বুখারি ১/১১৫: ৮৩০, ৮৩১, মুসলিম: ১/১৯৪, ১৭৩, হাদিস : ৪৯৮, ৪০২, ৪০৩, তিরমিজি: ১/৮৯, হাদিস: ৩৯১)
আত্তাহিয়াতু বা তাশাহুদ আরবি: التَّحِيَّاتُ لِلَّهِ وَالصَّلَوَاتُ وَالطَّيِّبَاتُ ، السَّلَامُ عَلَيْكَ أَيُّهَا النَّبِيُّ وَرَحْمَةُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ ، السَّلَامُ عَلَيْنَا وَعَلَى عِبَادِ اللَّهِ الصَّالِحِينَ ، أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ
আত্তাহিয়াতু বাংলা উচ্চারণ: আত্তাহিয়্যা-তু লিল্লা-হি ওয়াসসালাওয়া-তু ওয়াততায়্যিবা-তু আসসালা-মু আলায়কা আইয়্যুহান নাবিইয়্যু ওয়ারাহমাতুল্লা-হি ওয়াবারাকা-তুহু আসসালা-মু আলাইনা ওয়াআলা- ইবা-দিল্লা-হিস স-লিহীন। আশহাদু আল্লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াআশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রসূলুহু।
আত্তাহিয়াতু অর্থ: ‘যাবতীয় সম্মান, যাবতীয় উপাসনা ও যাবতীয় পবিত্র বিষয় আল্লাহর জন্য। হে নবী! আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক এবং আল্লাহর অনুগ্রহ ও সমৃদ্ধিসমূহ নাজিল হোক। শান্তি বর্ষিত হোক আমাদের ওপর ও আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দাগণের ওপর। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসুল।’
আত্তাহিয়াতু নিয়ে একটি প্রচলিত কাহিনি রয়েছে। বলা হয়ে থাকে- মেরাজের রাতে আল্লাহ তাআলা নবীজিকে আত্তাহিয়াতু শিক্ষা দিয়েছেন। মূলত সহিহ বুখারি ও মুসলিমসহ অন্যান্য সকল হাদিসগ্রন্থে তাশাহুদ বা আত্তাহিয়াতু সম্পর্কে বর্ণনা থাকলেও কোথাও এ কথা বলা হয়নি যে, এটি মেরাজ থেকে এসেছে। সুতরাং নবীজি আত্তাহিয়াতু বলেছেন বা আল্লাহ সালাম দিয়েছেন এরপর নবীজি উম্মতের জন্যও সালামের অংশ রেখেছেন এরপর ফেরেশতারা তাশাহুদ পড়েছেন—এধরনের কাহিনি বলা সমীচীন নয়।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নামাজসহ দ্বীনের প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সহিহ জ্ঞান ও বুঝ দান করুন। সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন অতিবাহিত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।