রাগ ক্ষতি ছাড়া ভালো কিছু বয়ে আনে না। রাগের সময় নেওয়া সিদ্ধান্ত বরাবরই ভুল হয়। এছাড়া মাত্রাতিরিক্ত রাগ, মন ও শরীরের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শয়তানের উস্কানিতেই মানুষ রাগান্বিত হয়। তাই রাগ-নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। যে এই কঠিন কাজটি করতে সক্ষম, তাকে প্রিয়নবী (স.) প্রকৃত বীর বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে—
‘সে প্রকৃত বীর নয়, যে কাউকে কুস্তিতে হারিয়ে দেয়; বরং প্রকৃত বীর সে-ই, যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়।’ (বুখারি: ৫৬৮৪)
রাগ দমনকারীর জন্য জান্নাতের ঘোষণা দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তুমি রাগ করবে না, তাহলে তোমার জন্য জান্নাত। ’ (তিবরানি: ২১)
অন্য হাদিসে আছে, আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আল্লাহর রাসুল (স.) কখনো নিজের কোনো ব্যাপারে কারোর কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। তবে, মহান আল্লাহর নিষিদ্ধ কোনো কাজ করে ফেললে তার জন্য যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করতেন। ’ (আল জামে বাইনাস সাহিহাইন: ৩১৮৪)
এক ব্যক্তি নবীজি (সা.)-কে বললেন, ‘আপনি আমাকে অসিয়ত করুন। তিনি বললেন, ‘তুমি রাগ করো না’। ওই ব্যক্তি কয়েকবার তা বললেন। নবীজি (সা.) প্রতিবারই বললেন, ‘রাগ করো না’। (বুখারি, খণ্ড: ৮, অধ্যায়: ৭৩, হাদিস: ১৩৭)।
নবীজি (সা.)-এর জীবন থেকে এমন অসংখ্য ঘটনা আমরা দেখতে পাই, যেগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারি, যখন আমরা রাগান্বিত অবস্থায় থাকি, তখন কী করা উচিত।
বিজ্ঞাপন
রাগ নিয়ন্ত্রণ আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে। যে ব্যক্তি রাগ নিয়ন্ত্রণ করে, সে আধ্যাত্মিকভাবে এবং জাগতিকভাবেও পুরস্কৃত হয়। নবীজি (স.) বলেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বান্দার ক্রোধ সংবরণে যে মহান প্রতিদান রয়েছে, তা অন্য কিছুতে নেই।’ (ইবনে মাজাহ: ৪১৮৯)।
হজরত আলী (রা.) এক যুদ্ধে অমুসলিম বাহিনীর সেনাপ্রধানকে সম্মুখযুদ্ধে ধরাশায়ী করলেন এবং যখন তাকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন, তখন তিনি আলী (রা.)-এর মুখে থুতু নিক্ষেপ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আলী (রা.) লোকটিকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেলেন। তখন ওই সেনাপ্রধান বললেন, ‘আপনি আমাকে হত্যা করতে পারতেন, কিন্তু তা করলেন না কেন?’ উত্তরে আলী (রা.) বললেন, ‘আপনার সঙ্গে আমার কোনো ব্যক্তিগত বিরোধ নেই। আপনার সঙ্গে আমি যুদ্ধ করছি শুধু আপনার অবিশ্বাস ও আল্লাহর প্রতি বিদ্রোহের কারণে। আমার মুখে থুতু নিক্ষেপের পর আমি যদি আপনাকে হত্যা করতাম, তবে তা হয়ে পড়ত আমার ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও প্রতিশোধস্পৃহার বহিঃপ্রকাশ, যা আমি কখনোই চাই না।’ (সাহাবা চরিত)।
আল্লাহ তাআলা রাগ নিয়ন্ত্রণকারীদের প্রশংসায় আয়াত নাজিল করেন।
এ আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, রাগ দমনকারীরা দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াব।
‘যে ব্যক্তি নিজের ক্রোধ চরিতার্থ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা সংবরণ করে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন সমগ্র সৃষ্টির সামনে ডেকে আনবেন এবং জান্নাতের যেকোনো হুর নিজের ইচ্ছামতো বেছে নেওয়ার অধিকার দেবেন।’ (ইবনে মাজাহ: ৪১৮৬)।
মহানবী (স.) তাঁর প্রিয় উম্মতকে দ্রুত রাগ-প্রশমনের চমৎকার কিছু উপায় বর্ণনা করেছেন। হাদিস অনুযায়ী, মুসলিম বীরপুরুষরা নিশ্চয়ই এর উপর আমল করে থাকেন। উপায়গুলো হলো-
১. অজু করা
গ্রহণযোগ্য এক হাদিসে প্রিয়নবী (স.) বলেছেন, ‘রাগ বা ক্রোধ শয়তানের তরফ থেকে আসে। শয়তান আগুনের তৈরি। আর আগুনকে পানি ঠাণ্ডা করে দেয়। যদি কারো ক্রোধ বা রাগ আসে তবে তার উচিত অজু করে নেওয়া।’ (বুখারি, মিশকাত, আবু দাউদ: ৪৭৮৬)
২. চুপ থাকা
রাগের সময় চুপ থাকার কথাটি প্রিয়নবী (স.) তিনবার বলেছেন। চুপ থাকলে রাগ দমন হয়। রাগের ক্ষতি থেকে বাঁচা যায়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘তোমরা শিক্ষা দাও এবং সহজ করো; কঠিন করো না। যখন তুমি রাগান্বিত হও তখন চুপ থাকো; যখন তুমি রাগান্বিত হও তখন চুপ থাকো; যখন তুমি রাগান্বিত হও তখন চুপ থাকো।’ (মুসনাদে আহমদ: ৪৭৮৬)
৩. মাটিতে শুয়ে পড়া
প্রিয়নবী (স.) আরও বলেছেন, ‘যদি দাঁড়ানো অবস্থায় কেউ রাগান্বিত হয়, তবে সে যেন বসে যায়। এতেও যদি রাগ না কমে তবে সে যেন (মাটিতে) শুয়ে পড়ে।’ (মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি, মিশকাত, আবু দাউদ: ৪৭৮৪)
৪. তাউজ পড়া
রাগ শুরু হলে তখনই আল্লাহর কাছে রাগ নিয়ন্ত্রণে ‘তাউজ’ পড়ার কথা বলেছেন বিশ্বনবী (স.)। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘আমি এমন একটি কালেমা জানি, যা পাঠ করলে ক্রোধ দূর হয়ে যায়। (আর তা হলো) “আউযু বিল্লাহি মিনাশ্ শাইত্বনির রাজিম” অর্থাৎ, আমি বিতাড়িত শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই।’ (মুসলিম: ৬৩১৭)।
দুই ব্যক্তি নবীজি (স.)-এর পাশে বসে পরস্পর গালাগাল করছিল। তাদের একজনের চোখ লাল হয়ে উঠল ও গলার শিরা ফুলে গেল। তখন রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, ‘‘আমি একটি বাক্য জানি, যদি সে তা পড়ে, তবে তার এ অবস্থা কেটে যাবে। বাক্যটি হলো-
أعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْم
উচ্চারণ: ‘আউজু বিল্লাহি মিনাশ শাইত্বানির রাঝিম।’
অর্থ: ‘আমি আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় চাই’। (মুসলিম: ৬৮১২)
প্রচণ্ড রাগের মুহূর্তে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা মানেই হাদিস অনুযায়ী বীরপুরুষে পরিণত হওয়া। সুতরাং, রাগের সময় উপরোল্লিখিত সুন্নতের উপর আমল করা উম্মতের সবার জন্য জরুরি। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রাগমুক্ত জীবন গঠনে সুন্নতের আমলে মনোযোগী হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

