রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

দ্বীন প্রচার থামাতে যেভাবে নির্যাতন করত আবু জাহেলরা

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৬ পিএম

শেয়ার করুন:

দ্বীন প্রচার থামাতে যেভাবে নির্যাতন করত আবু জাহেলরা

আল্লাহর দেওয়া দ্বীন ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে মহানবী (স.) অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। অমানুষিক নিপীড়ন ও অকথ্য নির্যাতন নীরবে সহ্য করেছেন। আল্লাহর দেওয়া দায়িত্ব পালনে সামান্য ত্রুটিও করেননি। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘অতএব আপনি উপদেশ দিতে থাকেন। কেননা আপনি উপদেশদাতা বৈ কিছুই নন। আপনি তাদের কর্মনিয়ন্ত্রক নন।’ (সুরা গাশিয়া: ২১-২২)

মক্কার কুরাইশরা দ্বীন ইসলামের প্রচার থামাতে মুসলিমদের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন শুরু করে। মক্কার শীর্ষস্থানীয় ২৫ ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। যার নেতৃত্বে ছিল আবু লাহাব ইবনে আবদুল মুত্তালিব। তারা মুসলিমদের ওপর সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার অনুমোদন করে।


বিজ্ঞাপন


হজের মৌসুমে আবু লাহাব রাসুল (স.)-এর পিছে লেগে থাকত। যেখানেই রাসুল (স.) দাওয়াত দিতেন, সেখানেই সে তাঁকে গালি দিয়ে লোকদেরকে ভাগিয়ে দিত এবং বলত, إِنَّهُ صَابِئِىْ كَذّابٌ فَلاَ تُصَدِّقُوْهُ ‘এ লোকটি বিধর্মী মিথ্যাবাদী তোমরা এর কথা বিশ্বাস করো না।’ (আহমদ: ১৬০৬৬, ১৬০৬৯; সহিহ ইবনে খুজাইমা: ১৫৯, সনদ সহিহ)। এমনকি ‘যুল মাজাজ’ নামক বাজারে যখন তিনি লোকদের বলছিলেন, তোমরা বলো, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, তাহলে সফলকাম হবে’, তখন পেছন থেকে তাঁকে লক্ষ্য করে সে পাথর ছুঁড়ে মারে। তাতে নবীজির পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত রক্তাক্ত হয়ে যায়। (সহিহ ইবনে হিববান, হাকেম ২/৬১১; দারাকুতনি: ২৯৫৭; তাফসিরে কুরতুবি)

আরও পড়ুন: যে কারণে মুমিনদের নিশ্চিহ্ন করা যায় না

মহানবী (স.)-এর অনন্য ব্যক্তিত্ব, বংশীয় মর্যাদা ও আবু তালিবের আশ্রয়ের কারণে তাঁর ওপর সরাসরি আঘাত করা সহজ ছিল না। তাই তাদের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয় দরিদ্র ও অসহায় মুসলিমরা। রাসুলুল্লাহ (স.), আবু বকর ও উসমান (রা.)-এর মতো অভিজাত ব্যক্তিরা প্রথমে নির্যাতন থেকে মুক্ত থাকলেও পরবর্তী সময়ে তারাও নানা অত্যাচার ও লাঞ্ছনার শিকার হন। (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা: ৯৮-৯৯)

একবার পবিত্র কাবা তাওয়াফ করার সময় মুশরিকরা রাসুলুল্লাহ (স.)-কে নিয়ে নানা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করল। প্রথম দুবার তিনি চুপ করে থাকলেন। তৃতীয়বার বললেন, ‘কুরাইশের লোকেরা, আমি তোমাদের জন্য ধ্বংস বয়ে এনেছি।’ তাঁর কথায় কুরাইশরা হতভম্ব হয়ে গেল, কিছুই বলতে পারল না। কিন্তু পরের দিন মহানবী (স.) তাওয়াফ করতে গেলে মুশরিকরা তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং গলায় চাদর পেঁচিয়ে ধরে যেন দম আঁটকে যায়। আবু বকর (রা.) তাদের প্রতিহত করেন। এরপর তারা নবীজি (স.)-কে ছেড়ে দিলেন কিন্তু আবু বকর (রা.)-কে বেদম প্রহার করে, তাঁর দাঁড়ি ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে যায়। ফলে তার মুখ ও মাথা ফুলে যায়।


বিজ্ঞাপন


আরেক দিন মহানবী (স.) মসজিদুল হারামে সেজদারত অবস্থায় ছিলেন। তখন উকবা ইবনে আবি মুয়িত আল্লাহর রাসুলের মাথার ওপর মরা উটের নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দেয়। ফলে তিনি উঠতে পারছিলেন না। ফাতেমা (রা.) দৌড়ে এসে তাঁর ওপর থেকে নাড়িভুঁড়ি সরিয়ে দেন। ভারমুক্ত হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ (স.) ওই পাষণ্ডসহ আরো কয়েকজনের নাম ধরে বদদোয়া করেন। তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহ, আবু জাহেলকে পাকড়াও করো, উতবা ইবনে রাবিয়া, শায়বা ইবনে রাবিয়া, ওয়ালিদ ইবনে উতবা, উমাইয়া ইবনে খালফ এবং উকবা ইবনে আবি মুয়িতকে পাকড়াও করুন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) যাদের বদদোয়া করেছিলেন তাদের বদরের দিন কূপের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখেছি।’ (নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা ১৩৫ ও ১৩৭; আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা-১০৪)

আরও পড়ুন: নবীজির জীবনী পাঠ যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ

একদিন আবু জেহেল সাফা পাহাড়ের কাছাকাছি জায়গায় রাসুলুল্লাহ (স.)-কে গালমন্দ করে ও শাসিয়ে দেয়। নবীজি (স.) নীরব রইলেন, কোনো কথা বললেন না। এরপর আবু জেহেল নবীজির (স.) মাথায় এক টুকরো পাথর নিক্ষেপ করল। এতে তাঁর মাথা ফেটে রক্ত বের হলো। অবশ্য এর প্রতিশোধ নিয়েছিলেন চাচা হামজাহ (রা.)। (নবুওয়াতের ৬ষ্ঠ বছরের শেষ দিকে জিলহজ মাসে হামজাহ (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন।)

রাসুলুল্লাহ (স.) একবার মক্কার লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘হে লোকেরা, বলো, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই; তোমরা সফল হবে।’ তখন লোকেরা তাঁকে গালি দিল এবং তার চেহারা মোবারকে ধুলো নিক্ষেপ করল। তাঁর পুরো শরীর ধুলাধূসরিত হয়ে গেল। তখন রাসুলুল্লাহ (স.)-এর মেয়ে জয়নব (রা.) তাঁর চেহারা মোবারক ধুয়ে দেন। তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লে মহানবী (স.) বলেন, ‘মেয়ে, তুমি তোমার পিতার ব্যাপারে এমন আশঙ্কা করো না যে তিনি আকস্মিক মারা যাবেন বা লাঞ্ছিত হবেন।’ রাসুলুল্লাহ (স.) যখন জুলুমে জর্জরিত হয়ে পড়তেন, মহান আল্লাহ তাঁকে ওহি অবতীর্ণ করে সান্ত্বনা দিতেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আপনার প্রতিপালক আপনাকে ত্যাগ করেননি এবং আপনার প্রতি বিরূপও হননি। আপনার জন্য পরবর্তী সময় তো পূর্ববর্তী সময় অপেক্ষা শ্রেয়। অচিরেই আপনার প্রতিপালক আপনাকে অনুগ্রহ দান করবেন আর আপনি সন্তুষ্ট হবেন।’ (সুরা দোহা: ৩-৫; মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস: ১/৩০৬)

নবীজির জীবনের একটি বছরকে দুঃখের বছর বলা হয়। সেটি হলো নবুয়তের দশম বছর। এর কারণ হলো, সেই বছর তাঁর আশ্রয়স্থল চাচা আবু তালেব ইন্তেকাল করেন এবং তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রা.) ইন্তেকাল করেন। এ সুযোগে মক্কার কাফেরদের অত্যাচার ও নিপীড়ন বহুগুণ বেড়ে যায়। প্রিয়নবী (স.) তায়েফ চলে যান। কিন্তু সেখানে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠে। ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন, আবু তালেবের ইন্তেকালের পর কোরাইশরা নবী রাসুল (স.)-এর ওপর এত বেশি নির্যাতন চালিয়েছিল, যা তাঁর জীবদ্দশায় তারা চিন্তাও করতে পারেনি। (ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪১৬)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআন সুন্নাহ অনুযায়ী জীবনযাপন করার তাওফিক দান করুন। দ্বীনি দায়িত্ব পালনে মহানবী (স.)-এর সিরাত থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর