আরবি মহররম মাসের ১০ তারিখ ‘আশুরা’ নামে পরিচিত। কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা আশুরার দিনে ঘটলেও এই দিনের তাৎপর্য তারও বহু আগে থেকেই নানাভাবে স্বীকৃত।
পবিত্র কোরআনে মহররম মাসের ফজিলত সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘আসমান ও জমিন সৃষ্টির সময় থেকেই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা ১২। এর মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। (সূরা তাওবা: ৩৬)
বিজ্ঞাপন
এই চার মাসের ব্যাপারে এক হাদিসে রাসূল (স.) বলেছেন, তিনটি মাস হলো ধারাবাহিক—জিলকদ, জিলহজ ও মহররম, অন্যটি হলো রজব। (বুখারি: ৩১৯৭, মুসলিম: ১৬৭৯)
হাদিস শরিফে মহররম মাসকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর মাস’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। হাদিসে এসেছে— (রমজানের পর) শ্রেষ্ঠ মাস হচ্ছে আল্লাহর মাস, যাকে তোমরা মহররম বলে থাকো। (সুনানে কুবরা: ৪২১৬)
মহররম মাসের ১০ তারিখ তথা আশুরার দিনে রোজা পালনেও ইসলামে বিশেষ ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। বিশুদ্ধ মত অনুসারে– রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে মুসলিমদের ওপর আশুরার রোজা ওয়াজিব ছিল। কিন্তু রমজানে রোজা ফরজ হওয়ার পর এদিন রোজা রাখা মোস্তাহাব।
আয়েশা (রা.) বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, ‘(জাহেলি যুগে) লোকেরা রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার দিন রোজা রাখতো। এদিন কাবায় গিলাফ জড়ানো হতো। এরপর যখন রমজানের রোজা ফরজ হলো, তখন আল্লাহর রাসুল (স.) বললেন— যে এদিন রোজা রাখতে চায় সে রাখুক। যে না চায় না রাখুক। (বুখারি: ১৫৯২)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: আশুরার রোজা কোন দুই দিন রাখতে হবে?
আশুরার রোজায় গুনাহ মাফের ওয়াদা করা হয়েছে। এ রোজার ফজিলত বর্ণনা করে রাসুল (স.) বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোজার কারণে আল্লাহ তাআলা অতীতের এক বছরের (সগিরা) গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সহিহ মুসলিম: ১/৩৬৭; জামে তিরমিজি: ১/১৫৮)
আশুরা উপলক্ষে ইসলামে দুটি রোজার কথা বলা হয়েছে। রাসুল (স.) ১০ মহররমের সঙ্গে ৯ কিংবা ১১ মহররম মিলিয়ে দুটি রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে, ৯ ও ১০ তারিখ রাখা উত্তম। কারণ একটি হাদিসে ৯ তারিখের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘তোমরা ৯ তারিখ এবং ১০ তারিখ রোজা রাখো...।’ (তিরমিজি: ৭৫৫)
১০ মহররম তথা আশুরা মুসলিম ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, এই দিনে নবী মুসা (আ.) ও তাঁর সঙ্গীরা ফেরাউন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন, সাগরে রাস্তা বানিয়ে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে নিরাপদে অপর প্রান্তে পৌঁছে দিয়েছিলেন এবং এই রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করার সময় ফেরাউন ও তার সৈন্যদেরকে দরিয়ায় ডুবিয়ে ধ্বংস করার ঘটনাটিও একই দিনে অর্থাৎ আশুরার দিনেই ঘটেছিল। এজন্য ইহুদিরা আশুরার দিনটি উদযাপন করত এবং রোজা রাখত।
আরও পড়ুন: কারবালার ময়দানে কী ঘটেছিল
হাদিসে এসেছে, যখন নবীজি হিজরত করে মদিনায় চলে আসেন দেখেন, মদিনার আহলে কিতাব ইহুদিরাও এ দিনে রোজা রাখছে। এ দিনকে তারা বিশেষভাবে উদযাপন করছে। নবীজি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন- এ দিনে তোমরা কীজন্য রোজা রাখছ? তারা বলল- এটি একটি মর্যাদাপূর্ণ দিবস। আল্লাহ তাআলা এ দিনে মুসা (আ.) ও তাঁর কওমকে (ফেরাউনের কবল থেকে) মুক্তি দিয়েছেন এবং ফেরাউনকে তার দলবলসহ (দরিয়ায়) নিমজ্জিত করেছেন। এরপর মুসা (আ.) এ দিনে শুকরিয়াস্বরূপ রোজা রাখতেন। তাই আমরাও রোজা রাখি। নবীজি এ কথা শুনে বললেন- فَنَحْنُ أَحَقّ وَأَوْلَى بِمُوسَى مِنْكُمْ ‘মুসা (আ.)-এর অনুসরণের ক্ষেত্রে তো আমরা তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার।’ এরপর নবীজি নিজেও রোজা রাখলেন এবং অন্যদের রোজা রাখতে বললেন। (সহিহ মুসলিম: ১১৩০; সহিহ বুখারি: ১১২৫, ৩৯৪৩)
এই দিনে হজরত আদম (আ.)-এর তাওবা কবুল হওয়া সম্পর্কেও বর্ণনা পাওয়া যায়। (লাতাইফুল মাআরিফ, ইবনে রজব, পৃষ্ঠা: ১১৩-১১৫; আল-ইলাল ওয়া মারিফাতির রিজাল, আবদুল্লাহ ইবনে ইমাম আহমদ, নম্বর: ৩৭৯৫) অন্যান্য আরো অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা আশুরার দিনে সংঘটিত হয়েছে বলে বিভিন্ন বর্ণনার কারণে আশুরার দিনটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে মুসলিম সমাজে।
আরও পড়ুন: আশুরার দিনে যেসব বিদআত নিয়ে সাবধান করেছেন আলেমরা
আশুরার দিনকে আরও গুরুত্ববহ করে তোলার পেছনে যে হৃদয়বিদারক ঘটনাটি অন্যতম ভূমিকা রেখেছে, সেটি হলো নবীদৌহিত্র হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত। এ ঘটনাটি নবীজির ইন্তেকালের প্রায় ৫০ বছর পর ৬১ হিজরিতে আশুরার দিনেই সংঘটিত হয়েছিল।
তবে, আল্লাহর রাসুল (স.) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম যে আশুরা পালন করেছেন ও যে আশুরা উম্মতে মুহম্মদির জন্য রেখে গেছেন তাতে কারবালার ঘটনার কোনো ভূমিকা ছিল না। কারবালার এ দুঃখজনক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর সাহাবাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.), আব্দুল্লাহ বিন ওমার (রা.), আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.), আনাস বিন মালেক (রা.), আবু সাঈদ খুদরি (রা.), জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা.), সাহল বিন সায়াদ (রা.), যায়েদ বিন আরকাম (রা.), সালামাতা ইবনুল আওকা (রা.)-সহ বহু সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম জীবিত ছিলেন। তাঁরা তাদের পরবর্তী লোকদের চেয়ে রাসুলুল্লাহ (স.) ও তাঁর পরিবারবর্গকে অনেক বেশি ভালবাসতেন।
তাঁরা আশুরার দিনে কারবালার ঘটনার কারণে কোনো কিছুর প্রচলন করেননি। মাতম, তাযিয়া মিছিল, আলোচনাসভা কোনোকিছুরই প্রমাণ পাওয়া যায় না। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সঠিক বোধ দান করুন। আমিন।

