হজ ইসলামের অন্যতম রুকন ও ফরজ বিধান। তাই হজের মাসায়েলগুলো ভালোভাবে জেনে সতর্কতার সঙ্গে হজ আদায় করতে হয়। যারা হজের মাসায়েল জানেন না, তাদের ক্ষেত্রে কিছু বড় ভুল প্রকাশ পায়, যা থেকে সতর্ক হওয়া জরুরি। নিচে ইহরাম বাঁধার সময়ের কিছু সচরাচর ভুল নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।
১) দুরাকাত নামাজের জন্য ইহরাম বিলম্বিত করা। ইহরামের আগে দুই রাকাত নামাজ পড়া সকল মাজহাবেই মোস্তাহাব, জরুরি কিছু নয়। পক্ষান্তরে ইহরাম ছাড়া মিকাত অতিক্রম করা নাজায়েজ। সুতরাং ইহরামের আগে নামাজের সুযোগ পেলে তা আদায় করা চাই। সুযোগ না থাকলে নামাজের কারণে ইহরাম বাঁধা বিলম্বিত করবেন না। (সহিহ মুসলিম: ১/৩৭৬; মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ১২৯০০; ফতোয়া হিন্দিয়া: ১/২২৩; রদ্দুল মুখতার: ২/৪৮১-৪৮২)
বিজ্ঞাপন
২) ইহরাম বাঁধার নিয়মে ভুল করেন অনেকে। কেউ কেউ মনে করেন, ইহরামের কাপড় পরে নামাজ পড়ার পর নিয়ত করলেই ইহরাম সম্পন্ন হয়ে যায়। বস্তুত এ ধারণা ভুল। শুধু নিয়ত করলে ইহরাম সম্পন্ন হয় না, বরং নিয়তের পর তালবিয়া পড়লে ইহরাম পূর্ণ হয়। (জামে তিরমিজি: ১/১০২; মোল্লা আলী কারী পৃ- ৮৯)
৩) আগেভাগে ইহরাম বাঁধাকে ঝামেলা ভাবেন কেউ কেউ। ইহরাম বাঁধার পর কিছু নিষেধাজ্ঞা আছে—সেটাকে ঝামেলা ভেবে কেউ কেউ আগে থেকে ইহরাম বাঁধেন না। অথচ ইহরাম ব্যতীত মিকাত অতিক্রম করা জায়েজ নেই। উপমহাদেশ থেকে গমনকারী হাজিদের মিকাত হলো কারনুল-মানাজিল ও জাতু ইরক, যা অতিক্রম করেই বিমান জেদ্দায় অবতরণ করে। যদি কেউ বিনা ইহরামে মিকাত অতিক্রম করে ফেলে, তবে তার জন্য পুনরায় মিকাতে ফিরে এসে ইহরাম বেঁধে যাওয়া জরুরি। যদি তা না করেন তবে দম ওয়াজিব হবে। যেহেতু বিমানে থাকা অবস্থায় মিকাতের জায়গা নির্ধারণ করা কঠিন বা ওই সময় ঘুমিয়ে পড়া, অন্যমনস্ক থাকা ইত্যাদি হতে পারে। তাই বিমানে চড়ার আগে কিংবা বিমানে উঠেই ইহরাম বেঁধে নেওয়া উচিত। (সূত্র: মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা: ১৫৭০২; ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া ১/২২১; আলমুগনী ইবনে কুদামা: ৫/৭৬; রদ্দুল মুখতার ২/৪৭৭)
৪) সেলাইবিহীন কাপড় বা চপ্পলের জন্যও কেউ কেউ ইহরামে বিলম্ব করেন, যার কারণে মিকাত অতিক্রম করে ফেলেন। ফলে দম ওয়াজিব হয়ে যায়। অথচ মিকাত অতিক্রমের আগে সেলাইযুক্ত কাপড় অবস্থায়ও যদি ইহরাম বেঁধে নিতেন এবং গাড়ি বা বিমান থেকে অবতরণের পরেই ইহরামের কাপড় পরে নিতেন, তবে তার অন্যায়টা দম ওয়াজিব হওয়ার মতো বড় হতো না, বরং একটি পূর্ণ সদকা ফিতর আদায় করে দিলেই চলতো। (জামে তিরমিজি: ১/১৭১; ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/২৪২; রদ্দুল মুখতার: ২/৫৪৭)
৫) যে কাপড়ে ইহরাম বাঁধা হয়েছে, সে কাপড় ইহরাম শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বদলানো যাবে না বলে ভুল ধারণা আছে অনেকের মধ্যে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ওই কাপড় নাপাক না হলেও বদলানো যাবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ১৫০১০, ১৫০১১; মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ- ৯৮)
বিজ্ঞাপন
৬) তাওয়াফের সময় ছাড়াও ইজতিবা করেন অনেকে। তারা এটিকে শরয়ি হুকুম মনে করেন। এটি ভুল। ইজতিবা হচ্ছে- বাম কাঁধের উপর চাদর রেখে ডান বগলের নিচ দিয়ে নিয়ে পরিধান করা। এটি সকল তাওয়াফে এটি সুন্নত নয় বরং যে তাওয়াফের পর সায়ি করতে হয় শুধু সেই তাওয়াফেই ইজতিবা করতে হয়। সুতরাং নফল তাওয়াফে ইজতিবা নেই। কেননা নফল তাওয়াফের পর সায়ি নেই। ইজতিবা অবস্থায় নামাজ পড়লে নামাজ মাকরুহ হবে। অনেকে এই অবস্থায় সায়িও করেন। অথচ সায়িতে ইজতিবার বিধান নেই। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/২২৫; আলমুগনী ইবনে কুদামা: ৫/২১৭)
৭) তামাত্তু হজকারীর একটি সচরাচর ভুল হচ্ছে- কোনো তামাত্তুকারী প্রথমে ইহরাম বাঁধার সময় একত্রে হজ ও উমরার নিয়ত করে ফেলেন। এ ভুলটি বেশি হতে দেখা যায়। হজে-তামাত্তুর ক্ষেত্রে নিয়ম হলো, প্রথমে শুধু উমরার নিয়ত করবেন। বায়তুল্লাহ পৌঁছে উমরার কাজ সেরে হালাল হবেন। তারপর আবার হজের সময় হজের নিয়তে এহরাম বাঁধবেন। (সহিহ বুখারি: ১/২১২; ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/২৩৮; আদ্দুররুল মুখতার: ২/৫৩৫-৫৩৭)
৮) ইহরামে থাকা অবস্থায় নারীদের চেহারার পর্দা করা জরুরি, কিন্তু কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা নিষেধ। এ কারণে মাসআলা না জানার কারণে পর্দানশীন মহিলাদের অনেককেই পুরো হজের সফরে ইহরাম অবস্থায় চেহারা খুলে চলাফেরা করতে দেখা যায়। অথচ এ ধারণা ঠিক নয়। চেহারায় কাপড়ের স্পর্শ ছাড়াও চেহারার পর্দা করা সম্ভব। এজন্য আজকাল ক্যাপ পাওয়া যায়, যা পরিধান করলে মুখের পর্দাও হয়ে যায়, আবার মুখে কাপড় না লাগানোর উপরও আমল হয়ে যায়।
প্রকাশ থাকে, ক্যাপের উপর দিয়ে নেকাব পরিধান করলে বাতাসে কিংবা চলাফেরার সময় অনেক ক্ষেত্রে নেকাবের কাপড় চেহারায় লেগে যায়। এতে অনেকে বিব্রত হন যে, না জানি এহরাম পরিপন্থী হয়ে গেল কি না। কিন্তু, মাসআলা হলো, এত অল্প সময় লাগলে কোনো অসুবিধা হয় না। তাই এই পন্থা অবলম্বন করে হলেও চেহারার পর্দা করা জরুরি। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা: ১৪৫৩৯, ১৪৫৪০; আবু দাউদ: ১/২৫৪; হিন্দিয়া: ১/২৩৮; রদ্দুল মুখতার: ২/৪৮৮, ৫২৭)
৯) ইহরাম অবস্থায় বায়তুল্লাহ স্পর্শ করা বড় ভুল। বায়তুল্লাহর দেয়ালে ও গিলাফে নিচ থেকে প্রায় ৭/৮ ফুট পরিমাণ চতুর্দিকেই সুগন্ধি লাগানো থাকে। তাই যেকোনো অংশে হাত লাগানোর মাধ্যমে সুগন্ধি লেগে যায়, যা ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ। আবেগের বশবর্তী হয়ে ইহরামের অবস্থার কথা ভুলে গিয়ে বায়তুল্লাহয় হাত লাগান, আলিঙ্গন করেন কেউ কেউ। ফলে ইহরাম অবস্থায় অঙ্গ প্রত্যঙ্গে সুগন্ধি লেগে যায়। এ সময় আবেগের বশবর্তী না হয়ে হুঁশকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। একটু সতর্ক হলেই এই বড় ভুল থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব। (সহিহ মুসলিম: ১/৩৭৩; ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/১২৪; আদ্দুররুল মুখতার: ২/৪৮৭)
১০) ইহরামের স্থান নিয়ে বিভ্রান্তি। হারামে অবস্থানকারীদের অনেকে হজের ইহরাম মসজিদে হারামে গিয়ে করাকে জরুরি মনে করেন, অথচ সেখানে ইহরাম বাঁধা জরুরি নয়, উত্তম। হজের ইহরাম হোটেল বা অবস্থানের জায়গাতেও করা যাবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা: ১৫৯৩১, ১৫৯৩৩; ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/২৩৯; রদ্দুল মুখতার: ২/৪৭৮)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মহান ইবাদতগুলোর ব্যাপারে বিশেষ সচেতনতা দান করুন। হাজিদের যাবতীয় ভুলভ্রান্তি থেকে বাঁচিয়ে রাখুন। আমিন।