মাতৃভক্তির কথা উঠলেই মনে পড়ে যায় বায়েজিদ বোস্তামি (রহ)-এর নাম। তাঁর নাম শোনেননি এমন লোক উপমহাদেশে নেই বললেই চলে। মাতৃভক্তিতে তিনি অনন্য হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়। সুলতানুল আরেফিনখ্যাত আল্লাহর এই ওলি জন্মেছিলেন ৮০৪ খ্রিস্টাব্দে ইরানের বোস্তাম শহরে। বোস্তামের দিকে সম্পর্ক করেই তাঁকে বোস্তামি বলা হয়।
একদিন হজরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ)-এর মা শয্যাশায়ী ছিলেন। তখন শীতকাল। ঘরের দরজা খোলা থাকায় ঠাণ্ডায় বাতাস ভেতরে আসছিল। বায়েজিদকে মা বললেন, দরজার একটি কপাট বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। বায়েজিদ মাকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলেন কোন পাশের কপাটটি বন্ধ করবেন। ডান পাশের কপাট নাকি বাম পাশের। ততক্ষণে মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। বায়েজিদ মনে করলেন, এ অবস্থায় মাকে ঘুম ভাঙ্গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে তার কষ্ট হবে। তাই ঘুম না ভাঙ্গিয়ে কিছুক্ষণ একপাশের কপাট খোলা রেখে আরেক পাশের কপাট বন্ধ রাখেন। আবার কিছুক্ষণ অন্যপাশের কপাট খোলা রেখে অপর পাশেরটি বন্ধ রাখেন। এভাবে সারারাত কাটিয়ে দিলেন। মা তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে উঠে বায়েজিদকে এ অবস্থা করতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, বায়েজিদ তুমি এমন করছ কেন? তিনি ব্যাপারটি খুলে বললেন। এরপর মা আনন্দে বুকে বায়েজিদকে জড়িয়ে ধরে আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন, প্রভু! তুমি আমাকে এমন সন্তান দান করেছ ধন্য আমার জীবন। তার মর্যাদা তোমার বন্ধুদের সারিতে অন্তর্ভুক্ত কর।
বিজ্ঞাপন
অন্য একদিন রাতে হজরত বায়েজিদ পড়াশোনা করছিলেন। বাবা তাঁর বাল্যকালেই ইন্তেকাল করেন বিধায় বাবার সেবা করার সুযোগ না হলেও মায়ের যে খেদমত তিনি করেছেন তা খুবই আশ্চর্যজনক। একদিন বায়েজিদ বোস্তামি (রহ)-এর মা গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে পানি খেতে চাইলেন।
আরও পড়ুন: মায়ের সেবায় আল্লাহর সন্তুষ্টি
বায়েজিদ বোস্তামি পানি আনতে গিয়ে দেখেন, ঘরের মশকে পানি নেই। পাশের কূপ থেকে মশক ভর্তি করে পানি এনে দেখলেন মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। তখন ছিল শীতকাল। পানির গ্লাস হাতে নিয়ে সারারাত মায়ের শিয়রে দাঁড়িয়ে রইলেন সন্তান বায়েজিদ। খুব ঠাণ্ডায় হাত যেন অবশ হয়ে যাচ্ছিল। ফজরের আজানের আগে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে উঠেন বায়েজিদের মা। দেখেন বায়েজিদ তার মাথার পাশে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রশ্ন করলেন, বাবা বায়েজিদ তুমি আমার মাথার পাশে পানির গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন? তিনি বলেন, মা আপনি পানি চাইলে মশকে পানি না থাকায় পাশের কূপ থেকে পানি নিয়ে আসতে দেরি হয়ে যায়। এসে দেখি আপনি ঘুমাচ্ছিলেন। তাই আপনার কষ্ট হবে বলে ঘুম ভাঙ্গানোর চেষ্টা করিনি। আপনি কখন ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে পানি খোঁজ করেন। আর যদি হাতের নাগালে পানি না পান হয়ত কষ্ট পাবেন, এ কথা ভেবে পানির গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
বায়েজিদের কথা শুনে মায়ের আনন্দে বুক ভরে যায়। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে মা আল্লাহর দরবারে দুহাত তুলে দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! আমার বায়েজিদকে সুলতানুল আরেফিন হিসাবে তোমার বন্ধুর দফতরে অতি মর্যাদার আসন প্রদান কর।
বিজ্ঞাপন
সুলতানুল আউলিয়া হজরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) বলেন, সেদিন মাতৃহৃদয়ে সেই অকপট প্রাণখোলা দোয়া আল্লাহর দরবারে পৌঁছে সঙ্গে সঙ্গে মঞ্জুর হয়ে গিয়েছিল। ফলে আমার বর্তমান এ অবস্থা। কারণ মহানবী (স.) বলেন, তিন ব্যক্তির দোয়া আল্লাহর দরবার থেকে ফেরত যায় না। মজলুম, মুসাফির, পিতা-মাতার দোয়া।
আরও পড়ুন: মায়ের দিকে তাকালে কবুল হজের সওয়াব
হজরত বায়েজিদ বোস্তামির বংশধারা হলো -আবু ইয়াজিদ তাইফুর বিন ঈসা বিন সরূশান/আদম বিন ঈসা বিন আলী আল বোস্তামি। জীবনের বেশির ভাগ সময়ই তিনি ইবাদতে কাটিয়েছেন নিজ বাড়ির নিভৃতে অথবা মসজিদে। সুফিবাদের আলোচনা করার জন্য লোকজনকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ করতেন। কঠোর তপস্যা করতেন এবং সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভের আশায় দুনিয়ার সকল আনন্দ-ফূর্তি থেকে নিজেকে দূরে রাখতেন।
বায়েজিদ বোস্তামি (রহ) বলেন, তোমরা যদি এমন কোনো ব্যক্তি দেখ, যার কাছে অনেক কারামত, সে বাতাসে উড়ছে, তা সত্ত্বেও তোমরা আশ্চর্য হবে না। (তাকে অলি মনে করবে না) বরং সে শরিয়তের আদেশ-নিষেধ মেনে চলে কি না সেটাই দেখ এবং শরিয়তের সীমারেখা হেফাজত করে কি না। তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি শরিয়ত এবং সুন্নতের অনুসরণ ব্যতীত নিজকে তরিকতপন্থী বলে দাবি করে সে মিথ্যুক। কেননা শরিয়তের অনুসরণ ব্যতীত তরিকত অর্জন অসম্ভব। আমি দীর্ঘ ৪০ বছরের কঠোর সাধনায় আল্লাহর নৈকট্যভাজন হওয়ার জন্য শরিয়তের জ্ঞান এবং সে অনুযায়ী আমলের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ অন্য কিছু পাইনি।
তিনি সর্বদা আল্লাহর জিকিরে মগ্ন থাকতেন। তারপরও বলতেন, ওহে মাবুদ! সারাজীবন আমি আপনার নাম স্মরণ করেছি একান্ত উদাসীনভাবে। আমি এক চরম অকৃতজ্ঞ। জানি না, আপনার সাথে আমি সাক্ষাতের যোগ্য বলে বিবেচিত হবো কি না। ৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে ২৬১ হিজরি সনে লাখো ভক্তকে শোকসাগরে ভাসিয়ে চিরকালের জন্য বিদায় নেন এই মহান সাধক।

