কোরবানি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রিয়বস্তু উৎসর্গ করা থেকেই পশু কোরবানির সূচনা হয়। শেষনবী মুহাম্মদ (স.)-এর আগমনের আগে যুগে যুগে সব শরিয়তে কোরবানির বিধান চালু ছিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি সব জাতির জন্য কোরবানির বিধান রেখেছি, যেন আমি তাদের জীবনোপকরণ হিসেবে যে চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি তাতে (জবাই করার সময়) আল্লাহর নাম স্মরণ করে। (সুরা হজ: ৩২)
হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর কোরবানির ঘটনার আগে কোরবানি কবুল হতো আসমান থেকে আগুন এসে কোরবানি খেয়ে ফেলত। এটা ছিল কোরবানি কবুলের আলামত। আর কারো কোরবানি কবুল না হলে তা পড়ে থাকত। হজরত আদম (আ.)-এর ছেলে হাবিলের কোরবানি এরপর হজরত ইলিয়াসসহ একাধিক নবীর কোরবানি এভাবেই কবুল হয়েছিল বলে তাফসিরের কিতাবে রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম কোরবানি করেন আদিপিতা হজরত আদম (আ.)-এর আমলে তাঁর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, আদমের দুই পুত্রের (হাবিল ও কাবিলের) বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শুনিয়ে দাও, যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কোরবানি কবুল হলো না। তাদের একজন বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন বলল, আল্লাহ তো সংযমীদের কোরবানিই কবুল করে থাকেন। (সুরা মায়েদা: ২৭)
আয়াতের তাফসির অনুযায়ী, আল্লাহ তাআলা হাবিলের কোরবানি কবুল করেন এবং তা পুড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে কবুল হওয়ার আলামত দেখিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু কাবিলের কোরবানি কবুল করেননি। ফলে তা নির্দিষ্ট স্থানে পড়ে রইল। ই ক্ষোভে এক পর্যায়ে কাবিল হাবিলকে হত্যা করে ফেলল। (তাফসির ইবনু কাসির, দুররে মনসুর, ফতহুল বায়ান: ৩/৪৫ ও ফতহুল কাদির: ২/২৮-২৯)
আরও পড়ুন: যেসব কারণে একাকী কোরবানি করা উত্তম
বিস্তারিত ঘটনা
আদম ও হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে আসার পর থেকে তাঁদের বংশবিস্তার শুরু হয়। তখন হাওয়া (আ.)-এর গর্ভ থেকে জোড়াসন্তান অর্থাৎ প্রতিবার একটি ছিলে ও একটি মেয়ে জন্মগ্রহণ করত (কেবল শীস আ. একা জন্মেছিলেন)। আল্লাহ তাআলা প্রয়োজনের খাতিরে আদম (আ.) এর শরীয়তে এ নির্দেশ জারি করেন যে—একই গর্ভ থেকে যে যমজ পুত্র ও কন্যা জন্মগ্রহণ করবে, তারা পরস্পর সহোদর ভাই-বোন হিসেবে গণ্য হবে। তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম। কিন্তু পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারী পুত্রের জন্য প্রথম গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারীনি কন্যা সহোদরা বোন হিসেবে গণ্য হবে না। তাদের মধ্যে পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ।
বিজ্ঞাপন
সুতরাং সেসময় আদম (আ.) একটি মেয়ের সাথে অন্য জোড়ার ছেলের বিয়ে দিতেন। ঘটনাক্রমে কাবিলের সাথে যে সহোদরা জন্ম নিয়েছিল সে ছিল পরমা সুন্দরী। তার নাম আকলিমা। অপরদিকে হাবিলের সাথে যে সহোদরা জন্ম নিয়েছিল সে দেখতে অতটা সুন্দরী ছিল না। তার নাম ছিল লিওযা। বিয়ের সময় হলে শরয়ী নিয়মানুযায়ী হাবিলের সহোদরা কাবিলের জন্য নির্ধারিত হলো আর হাবিলের জন্য নির্ধারিত হলো কাবিলের বোন আকলিমা। কিন্তু তাতে কাবিল রাজি হলো না। আদম (আ.) শরীয়তের পরিপ্রেক্ষিতে কাবিলের আবদার প্রত্যাখ্যান করলেন এবং তাকে তাঁর নির্দেশ মানতে বললেন। কিন্তু সে মানল না।
অবশেষে আদম (আ.) হাবিল ও কাবিলের মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমরা উভয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানি পেশ করো, যার কোরবানি গৃহীত হবে, তার সাথেই আকলিমার বিয়ে দেওয়া হবে।’ সেসময় কোরবানি গৃহীত হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল যে আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে সে কোরবানিকে ভস্মীভূত করে ফেলত। আর যার কোরবানি কবুল হত না, তারটা পড়ে থকত।
আরও পড়ুন: হজ দ্রুত আদায় না করার ক্ষতি
হাবিল-কাবিলের কোরবানির বস্তু
কাবিল ছিল চাষি। তাই তিনি গমের শীষ থেকে ভাল ভালগুলো বের করে নিয়ে খারাপগুলোর একটি আটি কোরবানির জন্য পেশ করল। আর হাবিল ছিল পশুপালনকারী। তাই সে তার জন্তুর মধ্যে থেকে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট একটি দুম্বা কোরবানির জন্য পেশ করল। এরপর নিয়মানুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নিশিখা এসে হাবিলের কোরবানিটি ভস্মীভূত করে দিলো। (ফতহুল কাদিরের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, হাবিলের পেশকৃত দুম্বাটি জান্নাতে উঠিয়ে নেওয়া হয় এবং তা জান্নাতে বিচরণ করতে থাকে। অবশেষে ইসমাইল জাবিহুল্লাহ (আ.)-কে ওই দুম্বাটি পাঠিয়ে বাঁচিয়ে দেওয়া হয়।) আর কাবিলের কোরবানি যথাস্থানেই পড়ে থাকল।
আল্লাহর সন্তুষ্টির ইচ্ছা ছাড়া কোরবানি কবুল হয় না
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হাবিল ও কাবিল কর্তৃক সম্পাদিত কোরবানির এ ঘটনা থেকেই মূলত কোরবানির ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছে। এ ঘটনায় আমরা দেখতে পেলাম যে, কোরবানিদাতা ‘হাবিল’, যিনি মনের ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের জন্যে একটি সুন্দর দুম্বা কোরবানি হিসেবে পেশ করেন। ফলে তার কোরবানি কবুল হয়। পক্ষান্তরে কাবিল, সে অমনোযোগী অবস্থায় কিছু খাদ্যশস্য কোরবানি হিসেবে পেশ করে। ফলে তার কোরবানি কবুল হয়নি। সুতরাং প্রমাণিত হলো- কোরবানি মনের ঐকান্তিক আগ্রহ ছাড়া কবুল হয় না। তারপর থেকে বিগত সকল উম্মতের ওপরে এটা জারি ছিল।
আরও পড়ুন: আকিকা না দিলে কি বাচ্চার বিপদ লেগে থাকে?
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কোরবানি নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ কারার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। অতএব তোমাদের আল্লাহ তো একমাত্র আল্লাহ সুতরাং তাঁরই আজ্ঞাধীন থাকো এবং বিনয়ীগণকে সুসংবাদ দাও।’ (সুরা হজ:৩৪)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা নাসাফি ও জামাখশারি বলেন, ‘আদম (আ.) থেকে মুহাম্মদ (স.) পর্যন্ত প্রত্যেক জাতিকে আল্লাহ তাআলা তার নৈকট্য লাভের জন্য কোরবানির বিধান দিয়েছেন। (তাফসিরে নাসাফি: ৩/৭৯; কাশশাফ: ২/৩৩)
আদম (আ.)-এর যুগে তাঁরই পুত্র কাবিল ও হাবিলের কোরবানির পর থেকে ইব্রাহিম (আ.) পর্যন্ত কোরবানি চলতে থাকে। মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে যত শরিয়ত নাজিল হয়েছে, প্রত্যেক শরিয়তের মধ্যে কোরবানির বিধান জারি ছিল। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতের এ ছিল একটি অপরিহার্য অংশ। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সাধ্যের মধ্যে উৎকৃষ্ট পশু দিয়ে কোরবানি করতে হয়।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বিশুদ্ধ নিয়তে সঠিক পদ্ধতিতে সুন্দর পশু কোরবানি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

