শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ইসলামে মায়ের মর্যাদা ও অধিকার

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮ মে ২০২২, ০২:৩২ পিএম

শেয়ার করুন:

ইসলামে মায়ের মর্যাদা ও অধিকার

সবচেয়ে মধুর শব্দ ‘মা’। মায়ের চেয়ে বড় আপন পৃথিবীতে কেউ নেই। সন্তানকে গর্ভে ধারণ করা থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে মায়ের নিশ্বাসজুড়ে থাকে সন্তান। পৃথিবীর আলো আঁধারে সন্তানের বেড়ে ওঠার পেছনে প্রধান ভূমিকা যাঁর, তিনি মা। ‘কত করি উৎপাত, আবদার দিন রাত, সব স’ন হাসি মুখে, ওরে সে যে মা! আমাদের মুখ চেয়ে, নিজে র’ন নাহি খেয়ে, শত দোষে দোষী তবু মা তো ত্যাজে না।’ মায়ের চেয়ে বেশি ত্যাগ করার সুযোগ নেই কারো। তাই মায়ের তুলনা অন্য কারো সঙ্গে চলে না।

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘মা-বাবাই হলো তোমার জান্নাত ও জাহান্নাম’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪২১)। শুধু মানুষ কেনো? পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণিই তার মায়ের কাছে ঋণী। সে ঋণ শোধ করার কোনো উপায় উপকরণ আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেননি। আল্লাহ তাআলার মহান কুদরত, তিনিই মায়ের অন্তরে সন্তানের জন্য পরম মায়া-মমতা সৃষ্টি করেছেন।


বিজ্ঞাপন


মাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে ইসলাম। তাঁর মর্যাদা নিয়ে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি মানুষকে তার মা-বাবার সঙ্গে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্ট ভোগ করতে করতে তাকে গর্ভধারণ করে। তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। সুতরাং আমার শুকরিয়া ও তোমার মা-বাবার শোকরিয়া আদায় করো।’ (সুরা লোকমান: ১৪)

আজ আন্তর্জাতিক ‘মা দিবস’। মা-কে যথাযথ সম্মান ভালোবাসা দেয়ার প্রত্যয়ে প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার পালিত হয় আন্তর্জাতিক ‘মা দিবস’। ধারণা করা হয়, এই দিনটি মায়ের প্রতি ভালোবাসার কথা বেশি স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু মায়ের ভালোবাসা ও সম্মান কোনো নির্দিষ্ট দিনে পালন করার বিষয় নয়। মায়ের ভালোবাসা থাকবে জীবনভর প্রতিটি মুহূর্তে। রাসুল (স.) ও তাঁর সাহাবীদের মাঝে এরূপ দিবস পালনের প্রমাণ নেই। বরং রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন—

مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ 

‘যে ব্যক্তি আমাদের এ ধর্মে নতুন কিছুর প্রচলন করবে, যার প্রতি আমাদের নির্দেশনা নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।’ (বুখারি ও মুসলিম, মেশকাত: ১৪০)

ইসলামে মায়ের সম্মান অকল্পনীয়। হাদিস থেকে জানা যায়, সেই সম্মান বাবার চেয়ে তিনগুণ বেশি। একবার এক লোক এসে রাসুল (স.)-কে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমার কাছ থেকে সদাচরণ পাওয়ার সর্বাধিক অধিকার কার?’ তিনি বললেন, ‘তোমার মায়ের।’ সে আবারও একই প্রশ্ন করলো। তিনি দ্বিতীয়বারও উত্তরে বললেন, ‘তোমার মায়ের।’ সে আবারও একই প্রশ্ন করলে তিনি তৃতীয়বারও উত্তর দিলেন, ‘তোমার মায়ের।’ সে আবারও একই প্রশ্ন করলে রাসুল (স.) চতুর্থবার বললেন, ‘তোমার পিতার’ (বুখারি: ৫৬২৬)।


বিজ্ঞাপন


কারো কারো মতে উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যা—মা স্বর্ণপদক নিলেন, এরপর রৌপ্যপদকও নিলেন। এমনকি ব্রোঞ্জ পদকও দেওয়া হলো মাকে। বাবাকে সান্ত্বনা পুরস্কার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হলো। মায়ের সাথে অসম্মানজনক আচরণ ইসলামে কঠিনভাবে নিষেধ। রাসুল (স.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা মায়ের অবাধ্য হওয়াকে তোমাদের জন্য হারাম করে দিয়েছেন’ (মুসলিম: ৪৫৮০)।

নবজাতক হজরত ঈসা (আ.)-এর মুখে মায়ের পবিত্রতা বর্ণনা করার জন্য আল্লাহ তাআলা ভাষা ফুটিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তো আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়াছেন, আমাকে নবী করেছেন। যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি ততদিন সালাত ও জাকাত আদায় করতে। আর আমাকে আমার মাতার প্রতি অনুগত করেছেন এবং তিনি আমাকে করেননি উদ্ধত ও হতভাগ্য; আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্মলাভ করেছি, যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমি উত্থিত হব।” এই-ই হলো মরিয়ম তনয় ঈসা (আ.)। আমি বললাম সত্য কথা, যে বিষয়ে উহারা বিতর্ক করে।’ (সুরা মরিয়ম: ১৬-৪০)

বায়হাকির এক বর্ণনায় এসেছে, ‘যখন কোনো অনুগত সন্তান নিজের মা-বাবার দিকে অনুগ্রহের নজরে দেখে, আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রতিটি দৃষ্টির বিনিময়ে একটি করে কবুল হজের সওয়াব দান করেন।’ (সুনানে বায়হাকি: ৪২১)

সন্তানের সম্পদে মায়ের অধিকার রয়েছে। মায়ের যাবতীয় ব্যয়ভার, খোরপোষ ও দেখভাল সন্তানের ওপর আবশ্যক। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মৃতের সন্তান থাকলে পিতামাতার জন্য (সন্তানের) সম্পদের এক-ষষ্ঠাংশ; আর সন্তান না থাকলে পিতামাতাই ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী হবে। এমতাবস্থায় মায়ের জন্য এক-তৃতীয়াংশ’ (সুরা নিসা: ১১)। মায়ের সেবা করা, মায়ের যত্ন নেওয়া এবং মাকে খুশি করার গুরুত্ব বোঝাতে রাসুল (স.) আরেক হাদিসে ইরশাদ করেন, ‘জান্নাত মায়ের পদতলে।’ (কানজুল উম্মাল: ৪৫৪৩৯)

বৃদ্ধা হয়ে গেলেও মায়ের সেবা জরুরি। একবার রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, ‘সে দুর্ভাগা! সে দুর্ভাগা! সে দুর্ভাগা!’ উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘সে কে?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি মাতাপিতা উভয়কে অথবা যেকোনো একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেয়েও (তাদের সেবা করে) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারলো না।’ (মুসলিম: ৬২৭৯)

শিরকের পর বড় অপরাধ মায়ের অবাধ্য হওয়া। তাই আল্লাহ তাআলা নিজের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গেই উল্লেখ করেছেন মা-বাবার অধিকারের কথা। বলেন, ‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন, তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং মাতাপিতার সঙ্গে সদাচরণ করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ে যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের ‘উফ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। তাদের সঙ্গে আদবের সঙ্গে কথা বলো।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ২৩)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘(হে নবী, বলে দিন!) এসো, তোমাদের ওপর তোমাদের রব যা হারাম করেছেন, তা পাঠ করি- তোমরা তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করবে না এবং মা-বাবার প্রতি অনুগ্রহ করবে।’ (সুরা আনআম: ১৫২)

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান সমাজে মা-বাবা তুলে গালাগালের সংস্কৃতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কথা কাটাকাটির মধ্যে মা তুলে গালাগালি কেন? কোন যুক্তিতে? দুঃখের বিষয় হলো, মানুষ যে অশ্লীল গালিগুলো দেয়, তার বেশির ভাগই মা-বাবাকেন্দ্রিক। মা দিবসে ওসব গালিদাতাদের চিহ্নিত করে শাস্তি কার্যকর করার শপথ নেওয়া উচিত। এছাড়াও মনে রাখতে হবে, গালাগাল কোনো মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘কবিরা গুনাহগুলোর একটি হলো নিজের মা-বাবাকে অভিশাপ দেওয়া। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর রাসুল! মানুষ নিজের মা-বাবাকে কীভাবে অভিশাপ করে? তিনি বললেন, যখন সে অন্যের বাবাকে গালাগাল করে, তখন সে নিজের বাবাকেও গালাগাল করে থাকে। আর যে অন্যের মাকে গালি দেয়, বিনিময়ে সে তার মাকেও গালি দেয়।’(সহিহ বুখারি: ৫৯৭৩)

আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার সকল সন্তানকে তাদের মা-বাবার প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ ও যথাযথ সম্মান দেয়ার তাওফিক দান করুন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর