রোববার, ১৬ মার্চ, ২০২৫, ঢাকা

লুত (আ.)-এর কাছে পুরুষের বেশে আসা ফেরেশতাদের ঘটনা

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০৫:০৮ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img

নবী লুত (আ.)-এর জাতি আল্লাহর অবাধ্যতার সীমা অতিক্রম করেছিল। জর্ডান ও বায়তুল মুকাদ্দাসের মধ্যবর্তী ‘সাদুম’ অঞ্চলে বসবাস করত লুত (আ.)-এর সম্প্রদায়। এখানকার ভূমি ছিল উর্বর। এখানে সবধরনের শস্য ও ফলের প্রাচুর্য ছিল। তারা একদিকে আল্লাহর বিপুল নেয়ামত ভোগ করত, অন্যদিকে অন্যায়-অনাচার ও নানাবিধ দুষ্কর্ম করে বেড়াত। এমনকি পুংমৈথুন বা সমকামিতার মতো নোংরামিতে তারা লিপ্ত হয়েছিল, যা তাদের আগে কোনো জাতির মধ্যে দেখা যায়নি। 

নিকৃষ্ট এই জাতিকে লুত (আ.) আল্লাহর পথে আহ্বান করলেন এবং সব ধরনের পাপ ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তারা আহ্বানে সাড়া দিলো না। বরং নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো পাপাচারে লিপ্ত থাকলো। পবিত্র কোরআনের বর্ণনায় লুত (আ.) স্বজাতিকে বললেন- وَ تَذَرُوۡنَ مَا خَلَقَ لَکُمۡ رَبُّکُمۡ مِّنۡ اَزۡوَاجِکُمۡ ؕ بَلۡ اَنۡتُمۡ قَوۡمٌ عٰدُوۡنَ ‘আর বর্জন করে থাক তোমাদের স্ত্রীগণকে, যাদেরকে তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন? প্রকৃতপক্ষে তোমরা এক সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়।’ (সূরা শুআরা: ১৬৬) 


বিজ্ঞাপন


জবাবে সম্প্রদায়ের নেতারা বলল- لَئِن لَّمْ تَنتَهِ يَا لُوْطُ لَتَكُوْنَنَّ مِنَ الْمُخْرَجِيْنَ، قَالَ إِنِّيْ لِعَمَلِكُم مِّنَ الْقَالِيْنَ ‘হে লুত! যদি তুমি (এসব কথাবার্তা থেকে) বিরত না হও, তাহলে তুমি অবশ্যই বহিষ্কৃত হবে’। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের এইসব কাজকে ঘৃণা করি।’ (সুরা শুআরা: ১৬৭-১৬৮)

আরও পড়ুন: কোরআনে বর্ণিত নবী-রাসুলদের দোয়া

অন্য আয়াতে এসেছে, وَلُوْطاً إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ إِنَّكُمْ لَتَأْتُوْنَ الْفَاحِشَةَ مَا سَبَقَكُمْ بِهَا مِنْ أَحَدٍ مِّنَ الْعَالَمِينَ، أَئِنَّكُمْ لَتَأْتُوْنَ الرِّجَالَ وَتَقْطَعُوْنَ السَّبِيْلَ وَتَأْتُوْنَ فِيْ نَادِيْكُمُ الْمُنْكَرَ فَمَا كَانَ جَوَابَ قَوْمِهِ إِلاَّ أَنْ قَالُوا ائْتِنَا بِعَذَابِ اللَّهِ إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِيْنَ، قَالَ رَبِّ انْصُرْنِي عَلَى الْقَوْمِ الْمُفْسِدِيْنَ

‘তোমরা এমন অশ্লীল কাজ করছ, যা তোমাদের পূর্বে পৃথিবীর কেউ কখনো করেনি’। ‘তোমরা কি পুংমৈথুনে লিপ্ত আছ, রাহাজানি করছ এবং নিজেদের মজলিসে প্রকাশ্যে গর্হিত কর্ম করছ’? জবাবে তার সম্প্রদায় কেবল একথা বলল যে, আমাদের উপর আল্লাহর গজব নিয়ে এসো, যদি তুমি সত্যবাদী হও’। (সুরা আনকাবুত: ২৯) তখন লুত (আ.) আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। দোয়াটি পরবর্তী আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


লুত (আ.)-এর দোয়া
رَبِّ انۡصُرۡنِیۡ عَلَی الۡقَوۡمِ الۡمُفۡسِدِیۡنَ ‘রাব্বিনসুরনী আলাল ক্বাওমিল মুফসিদীন’ অর্থ: ‘হে আমার রব! আমাকে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য করুন।’ (সুরা আনকাবুত: ৩০)
তাঁর আরেকটি দোয়া হলো—رَبِّ نَجِّنِي وَأَهْلِي مِمَّا يَعْمَلُونَ ‘রাব্বি নাজজিনী ওয়া আহলী মিম্মা-ইয়া‘মালূন।’ অর্থ: ‘হে আমার রব! আমাকে এবং আমার পরিবার-পরিজনকে তারা যা করে তা থেকে রক্ষা করুন।’ (সুরা শুআরা: ১৬৯)

আরও পড়ুন: বিয়েবহির্ভূত প্রেম-ভালোবাসার অনুমতি ইসলামে নেই

লুত (আ.)-এর দোয়ার ফলে যথারীতি গজব নেমে এলো তাদের ওপর। একদিন ভোরবেলা তাদের শক্তিশালী ভূমিকম্প দিয়ে ধ্বংস করে দেন আল্লাহ তাআলা। ভূমিকম্প এতো শক্তিশালী ছিল যে তাদের পুরো নগরটি সম্পূর্ণ উল্টে যায়। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, فَلَمَّا جَآءَ اَمۡرُنَا جَعَلۡنَا عَالِیَهَا سَافِلَهَا وَ اَمۡطَرۡنَا عَلَیۡهَا حِجَارَۃً مِّنۡ سِجِّیۡلٍ ۬ۙ مَّنۡضُوۡدٍ ‘অবশেষে আমার (আল্লাহর) আদেশ চলে আসলো, তখন আমি উক্ত জনপদকে ধ্বংস করে দিলাম এবং তাদের উপর স্তরে স্তরে পাথর বর্ষণ করলাম।’ (সুরা হুদ: ৮২)

পুরুষ ছদ্মবেশী ফেরেশতাদের ঘটনা
সুরা হুদের ৭৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, قَالُوۡا لَقَدۡ عَلِمۡتَ مَا لَنَا فِیۡ بَنٰتِکَ مِنۡ حَقٍّ ۚ وَ اِنَّکَ لَتَعۡلَمُ مَا نُرِیۡدُ ‘তারা বলল, (হে লুত!) তুমি নিশ্চয়ই জানো যে তোমার কন্যাদের আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা কী চাই, তা তুমি ভালোভাবেই জানো।’ (সুরা হুদ: ৭৯) 

এই আয়াতের তাফসিরে এসেছে, কয়েকজন ফেরেশতা মানব আকৃতিতে লুত (আ.)-এর বাড়িতে আসেন। ফেরেশতাদের আগমনের খবর লুত (আ.)-এর স্ত্রী গ্রামের লোকদের জানিয়ে দেয়। সুন্দর লাবণ্যময় চেহারার কয়েকজন যুবক অবস্থান করছে—এ খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকেরা বিকৃত লালসা চরিতার্থ করার জন্য তাঁর বাড়িতে ভিড় জমায়। লুত (আ.) কোনো উপায় না দেখে তাদের বললেন, আমি আমার কন্যাদের তোমাদের সঙ্গে বিয়ে দেব, তবু এই যুবকদের তোমাদের কাছে কখনো সোপর্দ করব না। লুত (আ.)-এর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে তারা বলেছিল, তুমি তো ভালো করেই জানো যে তোমার কন্যাদের প্রতি আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। আমরা চাই যুবকদের আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হোক। এ অবস্থায় লুত (আ.) আক্ষেপ করে বলেছিলেন, হায়! আমার যদি শক্তি থাকত, তাহলে এই পাপাচারী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারতাম! কোরআনের ভাষায়- قَالَ لَوۡ اَنَّ لِیۡ بِکُمۡ قُوَّۃً اَوۡ اٰوِیۡۤ اِلٰی رُکۡنٍ شَدِیۡدٍ ‘সে বলল, ‘তোমাদের প্রতিরোধে যদি আমার কোনো শক্তি থাকত অথবা আমি কোন সুদৃঢ় স্তম্ভের আশ্রয় নিতে পারতাম!’ (সুরা হুদ: ৮০) এই আয়াতের তাফসিরে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা লুত (আ.)-এর উপর রহমত করুন। তিনি নিরুপায় হয়ে সুদৃঢ় জামাতের আশ্রয় কামনা করেছিলেন।’ (বুখারি: ৩৩৮৭, মুসলিম: ১৫১) আর তাই লুত (আ)-এর পরবর্তী প্রত্যেক নবী সম্ভ্রান্ত শক্তিশালী বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

আরও পড়ুন: ১১ শ্রেণির মানুষের জন্য ফেরেশতারা দোয়া করেন

পবিত্র কোরআনের বর্ণনায় তখন ফেরেশতারা বললেন, قَالُوۡا یٰلُوۡطُ اِنَّا رُسُلُ رَبِّکَ لَنۡ یَّصِلُوۡۤا اِلَیۡکَ فَاَسۡرِ بِاَہۡلِکَ بِقِطۡعٍ مِّنَ الَّیۡلِ وَلَا یَلۡتَفِتۡ مِنۡکُمۡ اَحَدٌ اِلَّا امۡرَاَتَکَ ؕ اِنَّہٗ مُصِیۡبُہَا مَاۤ اَصَابَہُمۡ ؕ اِنَّ مَوۡعِدَہُمُ الصُّبۡحُ ؕ اَلَـیۡسَ الصُّبۡحُ بِقَرِیۡبٍ ‘তারা বলল, ‘হে লুত, আমরা আপনার রবের প্রেরিত ফেরেশতা, তারা কখনও আপনার কাছে পৌঁছতে পারবে না। সুতরাং আপনি আপনার পরিবার নিয়ে রাতের কোনো এক অংশে রওনা হন, আর আপনাদের কেউ পিছে তাকাবেন না। তবে আপনার স্ত্রী (রওনা হবে না), কেননা তাকে তা-ই আক্রান্ত করবে যা তাদেরকে আক্রান্ত করবে। নিশ্চয় তাদের (আজাবের) নির্ধারিত সময় হচ্ছে সকাল। সকাল কি নিকটে নয়’? (সুরা হুদ: ৮১)

মুফাসসিরগণ বলেন, যথারীতি সকাল শুরু হতেই লুত (আ.)-এর সম্প্রদায়কে হজরত জিব্রাইল (আ.) নিজের ডানা দিয়ে হালকা আঘাত করেন। এতেই সকল পাপাচারী অন্ধ হয়ে যায়। এরপর ডানা দিয়ে পুরো সাদুম নগরীকেই গোড়াসহ তুলে ফেলেন, এত উঁচুতে নিয়ে যান যে প্রথম আসমানের রক্ষী ফেরেশতারাও সাদুম নগরীর কুকুর আর মোরগের ডাক শুনতে পেয়েছিলেন। ঘুমন্ত মানুষের ওপর তাদের ঘরবাড়ি আছড়ে পড়ে। পাশাপাশি আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো কঙ্কর নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। এবার পুরো জনপদকে উল্টো করে সজোরে জমিনে ধসিয়ে দেওয়া হয়। এবার আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রত্যেক পাপীর নাম লেখা পাথর বর্ষণ করা হয়। এরপর আল্লাহ সে স্থানে দূষিত পানির জলাধারা প্রবাহিত করে দেন।

ইসলামের দৃষ্টিতে সমকাম ব্যভিচারের চেয়েও জঘন্য অপরাধ। তাদের শাস্তি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমরা যাদের লুতের জাতির মতো কাজে (সমকামে) লিপ্ত দেখবে, তাদের উভয়কেই হত্যা করো।’ (তিরমিজি: ৪/৫৭, আবু দাউদ: ৪/২৬৯) এই নিকৃষ্ট যৌনাচারে ভয়াবহ রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ারও আশংকা রয়েছে। মহানবী (স.) বলেন, ‘যখন কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে তারা প্রকাশ্যে অপকর্মে লিপ্ত হয়, তখন তাদের মধ্যে এমন রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়বে, যা তাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে ছিল না।’ (ইবনে মাজাহ: ২/১৩৩২)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাওফিক দান করুন। কোরআন হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন