রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার উপায় ও প্রতিদান

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:৪১ পিএম

শেয়ার করুন:

আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার উপায় ও প্রতিদান

আল্লাহ তাআলা বান্দাকে সুখ-দুঃখ দুই অবস্থা দিয়েই পরীক্ষা করেন। এরপর তিনি আমাদের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমি তোমাদের মন্দ ও ভালো দিয়ে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সুরা আম্বিয়া: ৩৫)

আল্লাহ তাআলা ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যে বান্দাদের পরীক্ষা নেন। কাউকে গুনাহ ক্ষমার উদ্দেশ্যে বা মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য কষ্ট দিয়ে পরীক্ষা করেন। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘মুসলমানের ওপর যে কষ্ট-ক্লেশ, রোগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানি আপতিত হয়, এমনকি তার দেহে যে কাঁটা ফোটে, এসবের বিনিময়ে আল্লাহ তার গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’ (বুখারি: ৫৬৪১; মুসলিম: ২৫৭৩) 


বিজ্ঞাপন


আবার কাউকে সুখ দিয়ে পরীক্ষা করেন শোকরগুজার কি না কিংবা দায়িত্বশীলতা কি না তা পরখ করার জন্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘...শিগগিরই আল্লাহ শোকর আদায়কারীদের প্রতিদান দেবেন।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৪৪) অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘..আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, তাহলে আমার আজাব অবশ্যই কঠিন।’ (সুরা ইবরাহিম: ৭) সুখের সময় বান্দার দায়িত্বশীলতা বেড়ে যায়। আল্লাহ দায়িত্বের হিসাব নেবেন। যেমন- কেয়ামতের দিন প্রত্যেক মানুষকে চারটি বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে। তা হলো জীবন সে কোন কাজে ব্যয় করেছে? যৌবন কোন কাজে শেষ করেছে? কোন পথে আয় ও ব্যয় করেছে? যেটুকু ইলম শিখেছে, সে অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে? (তিরমিজি: ২৪১৬)

আরও পড়ুন: মহান আল্লাহর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার ১৭ আমল
 
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, জেনে রেখো! তোমাদের প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল; আর তোমরা প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব ইমাম, যিনি জনগণের দায়িত্বশীল তিনি তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ গৃহকর্তা তার পরিবারের দায়িত্বশীল; সে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর পরিবার, সন্তান-সন্ততির ওপর দায়িত্বশীল, সে এসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। কোনো ব্যক্তির দাস স্বীয় মালিকের সম্পদের দায়িত্বশীল; সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব জেনে রাখ, প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্বাধীন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (সহিহ বুখারি: ৬৬৫৩)

পরীক্ষা নেওয়া শেষ হলে আল্লাহ তাআলা সীমালঙ্ঘনের দায়ে কাউকে আজাব দিয়ে ধ্বংস করে দেন। অর্থাৎ তাদেরকে আর পরীক্ষা করার প্রয়োজন নেই। তারা চূড়ান্তভাবেই অকৃতকার্য। তাদের ধ্বংস করার মাধ্যমে অন্যদের সতর্ক করা আল্লাহ তাআলার হেকমত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কঠিন শাস্তির পূর্বে আমি তাদেরকে হালকা শাস্তি আস্বাদন করাবো, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে।’ (সুরা সাজদাহ: ২১)

উল্লেখিত আয়াতগুলো এই কথা প্রমাণ করছে যে পরীক্ষা জীবনেরই একটি অংশ। প্রত্যেককেই মাঝেমাঝে পরীক্ষা করা হবে যাতে আল্লাহ দেখতে পান কোন বান্দা তাঁর প্রতি সত্যিকারের বিশ্বাস ও ভরসা রাখেন। অন্য কথায়, তিনি দেখবেন কে সবসময় সৎকাজ করে এবং কে সুবিধাজনক হলেই ভালো কাজ করে।


বিজ্ঞাপন


পরীক্ষার সম্মুখীন হলে মনোভাব কেমন হওয়া উচিত? পরীক্ষার সম্মুখীন হলেই মুসলমান হিসেবে আমাদের যে বিষয়ের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে সেটি হলো— আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আল্লাহ কাউকে সাধ্যাতীত বোঝা চাপিয়ে দেন না।’ (সুরা বাকারা: ২৮৬) অর্থাৎ কোনো বান্দাই এমন কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি জীবনেও হবে না, যা বহন করার শক্তি তার থাকবে না। সুতরাং আমাদের কখনোই নিরাশ হওয়া উচিত হবে না বা ধৈর্য হারানো উচিত নয়। কারণ আমরা ইতোমধ্যেই জানি যে আমরা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাব এবং পরীক্ষায় আমাদের উত্তীর্ণ হতে হবে।

আরও পড়ুন: যে ৩টি আমল সারাজীবন আঁকড়ে ধরার অসিয়ত করেছেন নবীজি

মনে রাখতে হবে আল্লাহ সর্বদা মুমিন বান্দার জন্য ভালোটাই করেন। পরীক্ষা একটু কষ্টদায়ক হলে আল্লাহর এই কথাটি মনে রাখতে হবে যে, পবিত্র কোরআনে তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘..হতে পারে, তুমি একটি জিনিস অপছন্দ করো যা তোমার জন্য ভালো এবং তুমি একটি জিনিস পছন্দ করো যা তোমার জন্য খারাপ। আল্লাহ জানেন কিন্তু তোমরা জানো না।’ (সুরা বাকারা: ২১৬)

আল্লাহ আমাদেরকে কখনোই বিনা কারণে পরীক্ষায় ফেলবেন না। বেশ কিছু সহিহ হাদিস রয়েছে যেখানে নবী (স.) উল্লেখ করেছেন যে আল্লাহ আমাদের নিজেদের মায়েদের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। যেমন এক হাদিসে এসেছে, ‘মা তার সন্তানের উপর যতটুকু দয়ালু, আল্লাহ তাঁর বান্দার উপর তদাপেক্ষা অধিক দয়ালু।’ (সহিহ বুখারি: ৭/৭৫, কিতাবুল আদাব, হাদিস: ৫৯৯৯; সহিহ মুসলিম, ৪/২১০৯, কিতাবুত তাওবা, হাদিস: ২৭৫৪)

একজন মা কখনোই স্বেচ্ছায় তাদের সন্তানকে কোনো কারণ ছাড়াই কষ্টের মধ্যে ফেলেন না। অতএব, আল্লাহর প্রতিটি পরীক্ষার পেছনে একটি উদ্দেশ্য থাকে, যদিও আমরা অনেকসময় তা বুঝতে পারি না। উদাহরণস্বরূপ, ছোটকালে মা-বাবা আমাদের অনেক কিছুই খেতে দিতেন না অসুস্থতার ভয়ে অথবা বড় কোনো ক্ষতির আশংকায় অনেক কিছুতে বারণ করতেন। মনে হতো উনারা অবিচার করছেন। পরে বড় হওয়ার পরে বুঝতে পারি- মা-বাবার ওসব নিষেধাজ্ঞার পেছনে উপযুক্ত কারণ ছিল। ঠিক একইভাবে আল্লাহ তাআলার প্রত্যেকটি পরীক্ষার উদ্দেশ্য বান্দার জন্য কল্যাণজনক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমি তোমাদের অবশ্যই পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পত্তি, জীবন ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা। আর আপনি সুসংবাদ দিন ধৈর্যশীলদের।’ (সুরা বাকারা: ১৫৫)

তাই সবসময় ধৈর্যের গুরুত্ব মনে রাখতে হবে। বিপদরূপী পরীক্ষার মাধ্যমে আল্লাহ মূলত তাঁর ধৈর্যশীল বান্দাদের বেছে নেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমি তোমাদের অবশ্যই পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পত্তি, জীবন ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা। আর আপনি সুসংবাদ দিন ধৈর্যশীলদের।’ (সুরা বাকারা: ১৫৫)

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘মুমিনের বিষয়টি কতইনা চমৎকার! তার জন্য কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই নেই। তার জন্য যদি কোনো খুশির ব্যাপার হয় এবং সে কৃতজ্ঞতা আদায় করে তাহলে সেটি তার জন্য কল্যাণকর। আর যদি কোনো দুঃখের বিষয় হয় এবং সে ধৈর্য ধারণ করে, সেটিও তার জন্য কল্যাণকর।’ (সহিহ মুসলিম: ২৯৯৯)

অতএব, যেকোনো পরীক্ষায় মনোভাব রাখতে হবে ইতিবাচক। তাহলে পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাবে। নেতিবাচক মনোভাব পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলবে। যেমনটি সুরা ইবরাহিমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আর স্মরণ করো, যখন তোমাদের রব ঘোষণা করেন, তোমরা কৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমি তোমাদেরকে আরো বেশি দেব আর অকৃতজ্ঞ হলে নিশ্চয় আমার শাস্তি কঠোর।’ (সুরা ইবরাহিম: ০৭)

যেহেতু আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আমরা যেকোনো পরিস্থিতিতে কৃতজ্ঞ থাকব, তিনি আমাদের আরও দেবেন, ইনশাআল্লাহ। অর্থাৎ আমরা যদি খারাপ পরিস্থিতিতে ধৈর্য্যের সাথে দায়িত্ব পালন করি, আল্লাহ তাআলা ওই পরিস্থিতি থেকে কিছু কল্যাণ বের করে আনবেন এবং পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত প্রশমিত হবে।

কষ্টকর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রতিদান বড়। কষ্টকর পরীক্ষায়ও যারা শুকরিয়া করতে পারে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে বিস্ময়কর প্রতিদান। হাদিসে এসেছে, জাবের (রা.) বলেন, রাসুল (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘কেয়ামতের দিন বিপদে পতিত ব্যক্তিদের যখন প্রতিদান দেওয়া হবে, তখন (পৃথিবীর) বিপদমুক্ত মানুষেরা আফসোস করে বলবে, হায়! দুনিয়াতে যদি কাঁচি দ্বারা তাদের শরীরের চামড়া কেটে টুকরো টুকরো করে দেওয়া হতো!’ (তিরমিজি: ২৪০২)

পুরস্কার সর্বদা পরীক্ষার তুলনায় বেশি। একটি পরীক্ষার পুরষ্কার সবসময় পরীক্ষার চেয়ে বেশিই হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘সুতরাং কষ্টের সাথেই তো স্বস্তি আছে, নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে। (সুরা ইনশিরাহ: ৫-৬)
এখানে আল্লাহ আমাদের বলছেন যে যতটা পরীক্ষার মধ্য দিয়েই আমরা যাই না কেন, যদি পরীক্ষায় আমাদের মনোভাব সঠিক থাকে, তাহলে পুরস্কার হবে পরীক্ষার চেয়েও বড়!

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহ তাআলার প্রত্যেকটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর