রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ইসলামে শিক্ষার্থীদের প্রহারের সীমারেখা

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৫ নভেম্বর ২০২৩, ০৩:৩০ পিএম

শেয়ার করুন:

ইসলামে শিক্ষার্থীদের প্রহারের সীমারেখা

ইসলাম শিক্ষককে পড়ালেখার উন্নয়ন ও শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য শিক্ষার্থীদের শাসন করার অনুমতি দিলেও শিশুদের শাসনের ব্যাপারে কঠোর শর্তারোপ করেছে। ইসলামি নির্দেশনা হলো- শিক্ষক পিতার মতো স্নেহ ও মমতা দিয়ে শিক্ষার্থীকে পাঠদান করবেন। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য পিতার মতো, আমি তোমাদের শিক্ষা দিই। তোমাদের কেউ শৌচাগারে গেলে কেবলার দিকে মুখ করে বা পিঠ করে বসবে না, ডান হাত দিয়ে ইস্তিঞ্জা করবে না।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৮)

শিক্ষকের দায়িত্ব শুধু পড়ালেখা করানো নয়, বরং শিক্ষার্থীকে আদর্শ মানুষ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্বও শিক্ষকের। আল্লামা আশরাফ আলী থানভি (রহ.) বলেন, ‘শিক্ষার্থীর অধিকার হলো শিক্ষক শুধু আক্ষরিক পাঠদান করবে না; বরং শিক্ষার্থীর আমল ও স্বভাব-চরিত্রের প্রতিও লক্ষ্য রাখবে, যেদিকে এখন খুব কম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই লক্ষ্য রাখা হয়। শিক্ষকরা শুধু পাঠদানকে যথেষ্ট মনে করেন।’ (তাজদিদে তালিম ওয়া তাবলিগ, পৃষ্ঠা-১২৬)


বিজ্ঞাপন


শিক্ষার্থীর শিশুসুলভ দুষ্টুমি, নিয়মভঙ্গ ও শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠনের প্রয়োজনে শিশুকে শাসন করা যেতে পারে। তবে শাসনের অর্থ শুধু প্রহার নয়। ইসলামি আইনজ্ঞদের অভিমত হলো, ‘ছাত্রদের আদর-যত্নের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে পড়াশোনা ও সচ্চরিত্র গঠনে উৎসাহিত করাই শিক্ষা ও দীক্ষার উত্তম পন্থা। এ ক্ষেত্রে সাজা দেওয়ার প্রয়োজন হলে প্রহার ছাড়া অন্যকোনো পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে।’ (ফতোয়ায়ে ফকিহুল মিল্লাত: ৭/৫০০)

আরও পড়ুন: ইসলামে সুন্দর নাম রাখার গুরুত্ব

ইসলামে শিক্ষার্থীদের জন্য সাধারণ শাসন হলো- মুখের শাসন। সুন্দরভাবে বোঝানো বা ভয় দেখানো। বেশি প্রয়োজন হলে বিশেষ করে শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য মৃদু প্রহারের অনুমতি দেয় ইসলাম। তবে, তা-ও অবশ্যই ১০ বছরের কম বয়সী শিশুদের নয়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘সাত বছর বয়সে উপনীত হলে তোমরা তোমাদের সন্তানদের নামাজের নির্দেশ দাও এবং তাদের বয়স ১০ বছর হলে তাদের নামাজের জন্য প্রহার করো এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দাও।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৪৯৫)

উল্লেখিত হাদিসের আলোকে ইসলামি আইনজ্ঞরা বলেন, শিশুর চরিত্র গঠনের জন্য অভিভাবকের জন্য এবং অভিভাবকের প্রতিনিধি হিসেবে শিক্ষকের জন্য মৃদু প্রহার করা বৈধ। তবে তারা কিছু শর্তারোপ করেন। তাহলো—


বিজ্ঞাপন


১.   সাত বছর বয়স তথা শাসন বোঝার মতো বয়স হওয়ার আগে শিশুর সঙ্গে সব ধরনের কঠোর ব্যবহার পরিহার করতে হবে।

২.   শিশুর বয়স ১০ অতিক্রম করলে নামাজ ছেড়ে দেওয়ার মতো অন্যায় করলে তাকে শাসন করা যাবে।

৩.   হাত দ্বারা শাস্তি দেওয়া, লাঠি, বেত ইত্যাদি দ্বারা শাস্তি দেওয়া যাবে না। কেননা বেতের ব্যবহার ইসলামি শরিয়ত হদ-তাজির বাস্তবায়নের ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।

৪.   টানা তিনের বেশি প্রহার না করা। কেননা রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘তুমি তিনের বেশি আঘাত করা থেকে বিরত থাকো। তুমি যদি তিনের বেশি প্রহার করো, তবে আল্লাহ তোমার কাছ থেকে হিসাব নেবেন।’ (তাজরিদু আসমায়িস-সাহাবাতি: ২/৬৯)

আরও পড়ুন: ইসলামে জ্ঞানী লোক চেনার উপায়

৫.   শরীরের স্পর্শকাতর স্থানগুলো, যেমন—মাথা, চেহারা ইত্যাদিতে শাস্তি দেওয়া যাবে না।

৬.   শরীরে ক্ষত বা দাগ পড়া কিংবা হাড়ে আঘাত লাগার মতো শাস্তি দেওয়া যাবে না।

উল্লেখ্য, শিক্ষার্থীর অভিভাবক অথবা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো শিক্ষার্থীকে প্রহার করতে নিষেধ করা হলে উল্লিখিত শর্ত সাপেক্ষেও প্রহার করার অনুমতি নেই। (বিস্তারিত দেখুন: ফতোয়ায়ে ফকিহুল মিল্লাত: ৭/৫০১)

বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীর প্রহার করার ব্যাপারে শিক্ষকদের জন্য সবচেয়ে উত্তম পন্থা হচ্ছে- অভিভাবককে জানানো। এ বিষয়ে আল্লামা জাফর আহমদ উসমানি (রহ.) বলেন, ‘..বর্তমানে সাধারণ মানুষের ভেতর আগের মতো দ্বীনি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ নেই। এজন্য বেশির ভাগ অভিভাবক শিক্ষকের শাস্তি প্রদান পছন্দ করেন না। এছাড়া বর্তমানের শিক্ষকরাও শরিয়তের বিধি-বিধান জানা ও চারিত্রিক উৎকর্ষে পিছিয়ে। ফলে তাঁরা শরিয়তের সীমার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেন না। এসব বিবেচনায় শিক্ষার্থীকে প্রহার করা যাবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে বলা হবে, শিক্ষক শিশুর লেখাপড়ায় অমনোযোগ ও ত্রুটির বিষয়ে তার মা-বাবাকে অবগত করবেন। বলবেন, এই শিশু ঠিকমতো লেখাপড়া করছে না। এখন মা-বাবা চাইলে তাকে শাস্তি দেবেন অথবা দেবেন না।’ (ইমদাদুল আহকাম: ৪/১৩৪)

শিক্ষার্থীর সঙ্গে কঠোর আচরণের অনেক কুফল রয়েছে। আল্লামা ইবনে খালদুন (রহ.) বলেন, ‘সেবক ও শিক্ষকদের মধ্যে কঠোরভাবে লালন-পালন করলে ছাত্রদের মনও কঠোর ও রূঢ় হয়ে পড়ে। অতঃপর অলসতা ও মিথ্যা বলার অভ্যাস গড়ে ওঠে। এমনিভাবে প্রাথমিক অবস্থায় কঠোরতা ও রূঢ়তার ফলে ধীরে ধীরে একটি জাতির মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।’ (আল মুকাদ্দিমা, অধ্যায়: শিক্ষার্থীদের প্রতি কঠোরতা ক্ষতি, পৃষ্ঠা-৭৪৩)

আরও পড়ুন: সন্তানের প্রতি মা-বাবার ১১ দায়িত্ব

তাছাড়া কঠোরতা নবীজির আদর্শ নয়। ইসলামি শরিয়তে শিক্ষার্থীকে সামান্য শাসনের অনুমতি দিলেও নিঃসন্দেহে তা মহানবী (স.)-এর অনুসৃত পথ ছিল না। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) কখনো তার কোনো সেবক বা কোনো স্ত্রীকে প্রহার করেননি।’ (আবু দাউদ: ৪৭৮৬)

মূলত শিক্ষার্থীর জীবন ও সময় শিক্ষকের কাছে আমানত। সুতরাং একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর জীবনোন্নয়নে ও সময়ের মূল্য নিশ্চিতে সচেষ্ট হবেন। এমন যেকোনো কাজ থেকে বিরত থাকবেন যাতে শিক্ষার্থী শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা প্রত্যেকেই রক্ষক এবং তোমরা প্রত্যেকেই (তার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিষয়ে) জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সহিহ বুখারি:  ৫১৮৮)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে শিশুর প্রতি কোমল আচরণ করার তাওফিক দান করুন। সব বিষয়ে ইসলামের দিক-নির্দেশনা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর