দোষে-গুণে মানুষ। আল্লাহর বিশেষ বান্দারা ছাড়া কেউ দোষের ঊর্ধ্বে নয়। তাই অন্যের দোষ অনুসন্ধান করা ও প্রচার করা মুমিনের জন্য শোভনীয় নয়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোনো বান্দার দোষ গোপন রাখে, আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তার দোষ গোপন রাখবেন।’ (মুসলিম: ২৫১০, আহমদ: ২৭৪৮৪, ৮৯৯৫)
কিন্তু আমাদের সমাজে অধিকাংশ মানুষের চারিত্রিক প্রবণতা হলো কারো গোপনীয় বিষয়ের পেছনে লাগা এবং ফাঁস করে দেওয়া। অনেকে তো যাচাই-বাছাই না করেই প্রচার করে বেড়ায়। এসব জঘন্য গুনাহের কাজ এবং এতে নিজেরই ক্ষতি হয়। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘তোমরা মুসলমানদের দোষ-ত্রুটি, ভুলভ্রান্তি খুঁজে বের করো না। যে ব্যক্তি অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ায় ও প্রকাশ করে দেয়, স্বয়ং আল্লাহ তার দোষ প্রকাশ করে দেন। আর আল্লাহ যার দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করেন তাকে নিজের বাড়িতেই লাঞ্ছিত করেন।’ (আবু দাউদ: ৪৮৮০)
বিজ্ঞাপন
শুধু অন্যের নয়, নিজের গোপনীয় বিষয়ও ফাঁস করা যাবে না। কারণ আল্লাহর কাছে তাওবা করে ক্ষমা চাইলে তিনি তা ক্ষমা করবেন। কিন্তু প্রকাশ করে দিলে আল্লাহর আবৃত পর্দা খুলে ফেলা হয়। ফলে গোপন রাখার সুযোগ তাঁর থাকে না। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, ‘আমার সব উম্মত মাফ পাবে, পাপ-প্রকাশকারী ব্যতীত। আর একপ্রকার প্রকাশ এই যে, কোনো ব্যক্তি রাতে কোনো পাপকাজ করে, যা আল্লাহ গোপন রাখেন। কিন্তু সকাল হলে সে বলে বেড়ায়, হে অমুক! আমি আজ রাতে এই এই কাজ করেছি।’ অথচ সে এমন অবস্থায় রাত্রি অতিবাহিত করেছিল যে আল্লাহ তার পাপ গোপন রেখেছিলেন। কিন্তু সে সকালে উঠে তার ওপর আল্লাহর আবৃত পর্দা খুলে ফেলে।’ (বুখারি: ৬০৬৯, মুসলিম: ২৯৯০)
আরও পড়ুন: যেসব মিথ্যা নিয়ে মানুষ অসতর্ক
তাই নিজের হোক বা অন্যের—কারো ব্যক্তিগত ত্রুটি প্রকাশ করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়। কোরআনুল কারিমে অন্যের গোপন বিষয় অনুসন্ধান করতে নিষেধ করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয়ই কিছু ধারণা গুনাহ। আর গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়া পছন্দ করবে? বস্তুত: তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’ (সুরা হুজরাত: ১২)
অন্তত কেয়ামতের দীর্ঘস্থায়ী বিপদের কথা স্মরণ করে মানুষের পেছনে লাগা থেকে বিরত থাকা উচিত। মন বেশি অনুসন্ধানী হলে নিজের ভুল-ত্রুটিগুলো নিয়ে ভাবা উচিত। হজরত আলী (রা.) বর্ণনা করেন, ব্যতিব্যস্ত হয়ো না এবং কারো গোপন তথ্য ফাঁস করো না। কেননা তোমাদের পেছনে রয়েছে কেয়ামতের ভীষণ কষ্টদায়ক এবং দীর্ঘস্থায়ী বিপদসমূহ’ (আদাবুল মুফরাদ)। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যখন তোমার সঙ্গীর দোষ চর্চা করতে ইচ্ছা করে, তখন তোমার নিজের দোষ স্মরণ করো।’ (আদাবুল মুফরাদ)
বিজ্ঞাপন
মেরাজের রাতে রাসুলুল্লাহ (স.)-কে কিছু পাপের শাস্তি দেখানো হয়েছে। ‘তিনি জাহান্নামে একদল লোককে দেখলেন, যারা তামার তৈরি নখ দিয়ে অনবরত নিজেদের মুখমণ্ডল ও বুকে আঁচড় মারছে। জিবরাইল (আ.) বললেন, এরা মানুষের গোশত খেতো (গিবত ও পরনিন্দা করত)। (আবু দাউদ: ৪৮৭৮, মুসনাদে আহমদ: ৩/২২৪, তাফসিরে ইবনে কাসির: ৫/৯)
আরও পড়ুন: গিবতের গুনাহ থেকে মুক্তি পেতে এই ৫টি কাজ করুন
রাসুল (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের কথা গুপ্তভাবে শুনল; অথচ সে তাদের কথাগুলো শুনুক তারা তা পছন্দ করছে না অথবা তারা তার অবস্থান টের পেয়ে তার থেকে দূরে পালিয়ে যাচ্ছে, কেয়ামতের দিন এজন্য তার কানে সিসা ঢেলে দেওয়া হবে।’ (বুখারি: ৭০৪২)
গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান বলতে মানুষের ব্যক্তিগত গুনাহ অনুসন্ধান করা, ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে পেছনে লাগা, ব্যক্তিগত স্বার্থ অর্জনের জন্য কারো পেছনে লেগে থাকা ও গোয়েন্দাগিরি করা, লুকিয়ে কারো কথা শোনা, ঘরের ভেতর উঁকি দেওয়া, ফেসবুকের আইডি হ্যাক করা, পাসওয়ার্ড চুরি করা, ইনবক্স চেক করা, গোপনীয়ভাবে কারো ছবি তোলা, ভিডিও ধারণ করা, কথা রেকর্ড করা ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে। এসব সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। তবে দেশ, সমাজ ও মানুষের নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত করতে, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার স্বার্থে, চোর-ডাকাত, খুনি, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, মাদক কারবারি, ঋণখেলাপি, প্রতারক ও ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত লোকদের খোঁজে বের করতে গোয়েন্দাগিরি করা যাবে। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় গোয়েন্দা নিযুক্ত করতেও কোনো অসুবিধে নেই।
আজ থেকে আমরা প্রতিজ্ঞা করি, কারো দোষ-ত্রুটি অন্যদের কাছে প্রকাশ করব না, পরচর্চা ও পরনিন্দা করব না। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সেই তাওফিক দান করুন। আমিন।