সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

রমজানে তাকওয়া অর্জনের উপায়

ড. হাবিবুর রহমান
প্রকাশিত: ১৯ এপ্রিল ২০২২, ০৮:০৭ পিএম

শেয়ার করুন:

রমজানে তাকওয়া অর্জনের উপায়

রমজানের রোজা একজন মুমিনকে, মুসলমানকে কীভাবে মুত্তাকি বানায় এবং কীভাবে তাকওয়া অর্জন করতে হয়—এ ব্যাপারে কোরআন ও হাদিসের আলোকে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
আল্লাহ তাআলা রমজানের রোজাকে মুসলমানদের উপর ফরজ করেছেন। পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে তিনি ইরশাদ করেছেন—

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ
‘ওহে যারা ইমান এনেছো, তোমাদের উপর রোজাকে লিপিবদ্ধ করে দেওয়া হলো, লিখে দেওয়া হলো, যেমনটি লিখে দেওয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে করে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো, তাকওয়ার অধিকারী হতে পারো।’

এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, রোজা এসেছে একজন মানুষকে মুত্তাকি বানানোর জন্য, তাকওয়ার অধিকারী বানানোর জন্য। কিন্তু তাকওয়া কাকে বলে? তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশিত ফরজগুলোকে মেনে নেওয়া এবং যেটা নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকা এবং সেটাকে প্রত্যাখ্যান করা। 

মা আয়েশা (রা.)-এর কাছে তাকওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো যে, তাকওয়া কী? তিনি বললেন, তোমরা কি কাঁটাযুক্ত রাস্তা দিয়ে কোনো সময় পথ অতিক্রম করেছ? সাহাবারা বললেন, হ্যাঁ, অতিক্রম করেছি। প্রশ্ন করলেন কীভাবে? জবাব দেওয়া হলো- অতি সতর্ক অবস্থায়, যাতে কাঁটা শরীরে বিঁধতে না পারে। তিনি বললেন, এটাই হচ্ছে তাকওয়া।

অর্থাৎ অসংখ্য গুনাহ মানুষকে বেষ্টন করে রেখেছে। প্রতিটি মুহূর্ত চলার পথে গুনাহ মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এসমস্ত গুনাহের কাজ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার নাম হচ্ছে তাকওয়া।

এখন রমজানের রোজা কীভাবে তাকওয়ার অধিকারী করে, সেবিষয়ে আমরা হাদিস থেকে জানবো। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, রোজা রাখার দুটি শর্ত। مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সঙ্গে রোজা রাখল, তার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। 
এখানে দুইটি শর্ত।


বিজ্ঞাপন


এক নম্বর হচ্ছে ঈমান থাকতে হবে, অর্থাৎ মুমিন হতে হবে। আল্লাহ তাআলা যে আয়াতে রোজা ফরজ করেছেন, সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ওহে যারা ইমান এনেছ, کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ তোমাদের ওপর রোজা ফরজ। অর্থাৎ রোজা রাখার এক নম্বর শর্ত হচ্ছে তাকে মুমিন হতে হবে। আমরা সবাই মুমিন, যদিও কারো ঈমান একটু বেশি, কারো কম।

আল্লাহর নবী (স.) আরেকটি শর্ত দিলেন সেটি হলো ইহতেসাব। এটি আরবি হিসাব শব্দ থেকে নির্গত, অর্থাৎ আমরা যখন পথ চলি বা ক্রয়-বিক্রয় করি, তখন হিসাব করি। হিসাব শব্দের সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি জড়িত। আল্লাহর রাসুল (স.) বলেন, রোজাটা রাখতে হবে হিসাব সহকারে বা ইহতেসাবের সঙ্গে। 

ইহতেসাবের আরেকটি পরিভাষা হচ্ছে সংস্কারের উদ্দেশ্যে সমালোচনা করা। অর্থাৎ সংস্কারের উদ্দেশ্যে সমালোচনার ভিত্তিতে রোজা রাখতে হবে। এখন এটি কীভাবে করবো? বুখারির আরেকটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন—

مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ للهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ 
যে ব্যক্তি রোজা রাখল, অথচ মিথ্যা পরিহার করতে পারল না, অশ্লীলতা, অপকর্ম, অন্যায়কে পরিহার করতে পারল না, ওই ব্যক্তির রোজা রাখা বা না রাখা আল্লাহর কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করবে না, অর্থাৎ ওই ব্যক্তির রোজা আল্লাহর কাছে কোনো উপকারে আসবে না। 

তাহলে আল্লাহর নবী (স.) রোজা রাখার কী বিধান দিলেন? তা হলো- রোজা রাখা অবস্থায় মিথ্যা বলা যাবে না, অন্যায় কাজ করা যাবে না, ১০টা মিনিট আমাকে সময় বের করতে হবে আত্মসমালোচনা করার জন্য। এই ১০ মিনিট আমি হিসাব করবো- রোজা অবস্থায় আমি মিথ্যা বলেছি কি না, অন্যায় করেছি কি না, অশ্লীলতা পরিহার করতে পেরেছি কি না, অন্যায়ভাবে কারো মাল আত্মসাৎ করেছি কি না, কাউকে ফাঁকি দিয়েছি কি না, এভাবে প্রত্যেকটি দিন ইহতেসাব করতে হবে পরের দিন আবার এভাবে রোজা রাখতে হবে।

এই আত্মসমালোচনা করা রোজায় প্রিয়নবী (স.) বিধান হিসেবে দিয়ে দিলেন। রাতে ঘুমানোর আগে যখন নিজের সমালোচনা করবো, দেখা যাবে, এমন অনেক কাজ করে ফেলেছি, যা রোজা রাখা অবস্থায় করা উচিত হয়নি। তখন আমার দায়িত্ব কী? তখন আমাকে দ্রুত তওবা করতে হবে। 

হে আল্লাহ! আমি অন্যায় করেছি, ভুল করেছি, অপরাধ করে ফেলেছি, এখন তোমার কাছে তওবা করছি। আল্লাহ! আমি এই অপরাধ আর করবো না, এই বলে প্রতিজ্ঞা করতে হবে। পরের দিন আবার তার রোজা রাখা শুরু হবে। ঠিক ঘুমাতে যাওয়ার আগে আবারও ইহতেসাব করতে হবে। আল্লাহর রাসুল (স.) বলেছেন, এভাবে যদি কেউ একটি মাস রোজা পালন করেন, غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ গুফিরা লাহু মা তাকাদ্দামা মিন জানবিহি, ‘আল্লাহ তার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন’। 

কিন্তু তওবাকারীদের জন্য পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা আরও বেশি প্রতিদানের কথা বলেছেন। সুরা ফুরকানের ৭০-৭১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন—

 اِلَّا مَنۡ تَابَ وَ اٰمَنَ وَ عَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا فَاُولٰٓئِکَ یُبَدِّلُ اللّٰهُ سَیِّاٰتِهِمۡ حَسَنٰتٍ ‘কেউ যদি অন্যায় করার পরে খালেস নিয়তে তাওবা করে, তাওবা করার পর আবার ঈমান আনে এবং আমলে সালেহ বা উত্তম আমল করে, আল্লাহ তাআলা বলছেন, فَاُولٰٓئِکَ یُبَدِّلُ اللّٰهُ سَیِّاٰتِهِمۡ حَسَنٰتٍ ফাউলাইকা ইবাদ্দিলিল্লাহু সাইয়িআতিহিন হাসানা, আমি তার সাইয়িয়াতগুলো বা খারাপ কাজগুলো ভালো কাজ দ্বারা পরিবর্তন করে দেবো। সুবহানাল্লাহ। 

এটাই হচ্ছে বান্দার জন্য আল্লাহ তাআলা যে রাহিম তাঁর উদাহরণ। মানুষ সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ এবং সেই বান্দার প্রতি আল্লাহর করুণা অনেক বেশি। কেউ যদি পাপ করার পর আবার আল্লাহর কাছে ফিরে আসে, তিনি সবচেয়ে খুশি হন। এই রমজান আমাদের সেই শিক্ষাটা দেয়। কাজেই আমরা যদি মুত্তাকি হতে চাই, তাহলে এই রোজার মাসে আমাদেরকে অশ্লীলতা পরিহার করতে হবে। অন্যায় অপকর্মগুলোকে পরিহার করতে হবে। তওবা করতে হবে।

রোজা আসার কারণে যে ব্যবসায়ী অন্যায়ভাবে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে, সে কখনও মুমিন হতে পারে না। এই রোজার শিক্ষা সে গ্রহণ করতে পারেনি। তারা রোজা রাখা আর না রাখা আল্লাহর কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করবে না। কারণ আল্লাহর নবী (স.) বলেছেন, كَم من صائمٍ ليسَ لهُ من صيامِهِ إلَّا الظَّمَأُ، وَكَم من قائمٍ ليسَ لهُ من قيامِهِ إلَّا السَّهرُ এমন অনেক রোজাদার আছে, ক্ষুধার কষ্ট করা ছাড়া এই রোজা তার কোনো উপকারে আসবে না। আবার এমন অনেক কিয়ামকারী আছে, যারা রাত জেগে জেগে দাঁড়িয়ে ইবাদত করে, তাদের রাতে দাঁড়ানো ছাড়া এটা তাদের কোনো উপকারে আসবে না। 

আমাদের রোজা, কিয়াম যেন সেরকম না হয় এবং প্রত্যেকটি রোজা আত্মসমালোচনার সাথে ঈমানের সাথে রাখার তাওফিক আল্লাহ আমাদের সবাইকে দান করুন। আমিন।

লেখক: বিশিষ্ট দায়ি ও মিডিয়া আলোচক, খতিব, আদ দ্বীন মেডিকেল কলেজ মসজিদ, মগবাজার

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর