মানুষের মুখ এমন এক অঙ্গ, যার মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি গুনাহ সংঘটিত হয়। যে ব্যক্তি মুখ সংযত রাখতে পারে, তার পক্ষে অনেক কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হয়। শুধু মুখের কারণে পরিবার, সমাজ এমনকি একটি রাষ্ট্রও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে। এখানে ১০টি মুখের পাপ তুলে ধরা হলো—
১. মিথ্যা
মিথ্যাকে বলা হয় সকল পাপের জননী। রাসুল (স.) মিথ্যাকে বৃহত্তর গুনাহ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এই মিথ্যা মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। নবী কারিম (স.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সত্য পুণ্য ও নেক আমলের পথ দেখায়। আর নেক আমল জান্নাতের পথ দেখায়। আর ব্যক্তি সত্য বলতে বলতে আল্লাহর কাছে সিদ্দিক (মহাসত্যবাদী) হিসেবে পরিগণিত হয়। আর মিথ্যা পাপের পথ দেখায়। আর পাপ পাপীকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। ব্যক্তি মিথ্যা বলতে বলতে আল্লাহর খাতায় ‘কাযযাব’ (চরম মিথ্যুক) বলে চিহ্নিত হয়ে যায়।’ (বুখারি: ৬০৯৪)
বিজ্ঞাপন
২. গিবত বা দোষ চর্চা
মৌখিক পাপগুলোর অন্যতম হচ্ছে গিবত বা দোষচর্চা। এই ঘৃণ্য কর্ম থেকে বিরত থাকতে আদেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন কারো পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি স্বীয় মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণাই করো।’ (সুরা হুজরাত: ১২)
৩. চোগলখুরি
বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একজনের দোষ অন্যের কানে পৌঁছে দেওয়াকে চোগলখোরি বা কূটনামি বলে। যারা চোগলখুরি করে বেড়ায়, তাদের কবরে ভয়াবহ শাস্তির কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। একবার রাসুলুল্লাহ (স.) কোথাও যাচ্ছিলেন। দুটি নতুন কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে দাঁড়িয়ে দোয়া করলেন। এরপর খেজুরের একটি ডাল দুই টুকরা করে কবর দুটিতে পুঁতে দিলেন। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এর কারণ জিজ্ঞেস করলে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, কবর দুটিতে শাস্তি হচ্ছে। কিন্তু এমন কোনো গুনাহর কারণে শাস্তি হচ্ছে না, যা থেকে বেঁচে থাকা কঠিন ছিল। সহজেই তারা ওই সব থেকে বাঁচতে পারত; কিন্তু বেঁচে থাকেনি। একজন প্রস্রাবের ফোঁটা থেকে বেঁচে থাকত না, অন্যজন চোগলখুরি করে বেড়াত।’ (বুখারি: ৫৭২৮)
৪. মিথ্যা সাক্ষ্য
মিথ্যা সাক্ষ্য একটি ঘৃণিত অপরাধ। মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে মানুষকে অন্যায়ভাবে বিপদে ফেলা হয়। একজন মুমিন কখনোই মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে পারে না। একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। এ অবস্থায় তিনি সাহাবাদের বলেন, কবিরা গুনাহ সম্পর্কে কি আমি তোমাদের বলব? সাহাবারা বলল, হে আল্লাহর রাসুল, বলুন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, অন্যতম কবিরা গুনাহ হলো, কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করা (শিরক করা), মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া। এ কথা বলে নবী করিম (স.) সোজা হয়ে বসেছেন এবং বলেছেন, মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া। এ কথা তিনি তিনবার বলেছেন। (বুখারি: ২৬৫৪)
৫. মিথ্যা শপথ
আল্লাহর নামে শপথ যদি হয় মিথ্যা, তাহলে তা হবে চূড়ান্ত পর্যায়ের পাপ। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেউ যদি (মিথ্যা) কসমের মাধ্যমে কোনো মুসলিমের হক কেটে দেয় (মিথ্যা কসমের মাধ্যমে কাউকে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে)। আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত করে দেন এবং জান্নাত হারাম করে দেন। এ কথা শুনে এক সাহাবি বলেন, যদি সামান্য বস্তুর ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে? নবীজি বলেন, হ্যাঁ, যদি আরাকের (এক প্রকার গাছ) সামান্য একটি ডালও হয়।’ (মুসলিম: ১৩৭)
বিজ্ঞাপন
৬. অশ্লীল গালি
রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকি [আল্লাহর অবাধ্য আচরণ] এবং তার সঙ্গে লড়াই-ঝগড়া করা কুফরি।’ (বুখারি: ৬০৪৫)
৭. উপহাস
কাউকে উপহাস করা কিংবা মন্দ নামে ডাকা ইসলামে নিষিদ্ধ। এতে হিংসা-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়। অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। তাই এসব মন্দ নামে ডাকা থেকে বিরত থাকতে আদেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা, কোনো সম্প্রদায় যেন কোনো সম্প্রদায়কে উপহাস না করে। হতে পারে তারা তাদের চেয়ে উত্তম। আর নারীরা যেন নারীদের উপহাস না করে। হতে পারে তারা তাদের চেয়ে উত্তম। তোমরা পরস্পরের দোষ বর্ণনা করো না এবং একে অন্যকে মন্দ নামে ডেকো না। বস্তুত ঈমান আনার পর মন্দ নামে ডাকা হলো অন্যায়মূলক কাজ...।’ (সুরা হুজুরাত: ১১)
৮. খোঁটা দেওয়া
আবু জার (রা.) বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (স.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তি এমন, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা যাদের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না, তাদের পরিশুদ্ধ করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। আবু জার (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) এ কথাটি তিন-তিনবার বলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, তারা কারা, তারা তো সর্বস্বান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল? তিনি বলেন, ক. যে ব্যক্তি পরিধেয় কাপড় টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে রাখে; খ. যে ব্যক্তি উপকার করার পর খোঁটা দেয় এবং গ. যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করে।’ (মুসলিম: ১০৬)
৯ অনর্থক কথা
অনর্থক কথা সবসময় অসুন্দর। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘মানুষের জন্য ইসলামের সৌন্দর্য হচ্ছে তার অনর্থক কথাবার্তা পরিহার করা।’ (ইবনে মাজাহ: ৩৯৭৬) কেউ যখন অনর্থক কথাবার্তা বলে তখন ভদ্রভাবে তাকে এড়িয়ে চলা উচিত। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে— ‘তারা যখন অবাঞ্ছিত কথাবার্তা শোনে, তখন তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে—আমাদের জন্যে আমাদের কাজ এবং তোমাদের জন্যে তোমাদের কাজ। তোমাদের প্রতি সালাম। আমরা অজ্ঞদের সঙ্গে জড়িত হতে চাই না।’ (সুরা কাসাস: ৫৫)
বেহুদা গল্প-গুজব জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করারও বড় একটি কারণ। জাহান্নামিরা নিজেদের মুখেই সেটি স্বীকার করবে। ‘জাহান্নামিদের জিজ্ঞেস করা হবে, কোন অপরাধে তোমরা জাহান্নামে প্রবেশ করেছ? তখন তারা বলবে— আমরা নামাজ পড়তাম না, মিসকিনদের খাদ্য দিতাম না, অনর্থক গল্প-গুজবকারীদের সঙ্গে গল্প-গুজব করতাম এবং কেয়ামত দিবসকে অবিশ্বাস করতাম।’ (সুরা মুদদাসসির: ৪২-৪৬)
১০. অভিশাপ দেওয়া
কাউকে যখন-তখন অভিশাপ দেওয়া গর্হিত কাজ। হাদিসে এই অভিশাপ দেওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ‘তোমরা পরস্পর আল্লাহর লানত, তার গজব ও জাহান্নামের অভিশাপ দেবে না।’ (তিরমিজি: ১৯৮৬) কারণ এই অভিশাপ অনেক ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হয়। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যাকে অভিসম্পাত করা হয়েছে, সে যদি এর যোগ্য হয়, তাহলে তার প্রতি পতিত হয়। অন্যথায় অভিশাপকারীর দিকেই তা ধাবিত হয়।’ (আবু দাউদ: ৪৯০৭)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে নিন্দনীয় এসব মুখের পাপ থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।