রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

আশুরার দিনটি যেভাবে কাটাবেন

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৯ জুলাই ২০২৩, ০২:৫৫ পিএম

শেয়ার করুন:

আশুরার দিনটি যেভাবে কাটাবেন

মহররমের ১০ তারিখকেই আরবিতে আশুরা বলা হয়। মহররম মাসকে আল্লাহ তাআলা বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে আল্লাহর কিতাবে (অর্থাৎ লাওহে মাহফুজে) মাসের সংখ্যা ১২টি, সেই দিন থেকে, যেদিন আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। এর মধ্যে চারটি মাস মর্যাদাপূর্ণ। (সুরা তাওবা: ৩৬)

আশুরার দিনটি মুমিনের জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বিশেষ রহমত বলা যায়। এই দিনে অতীতের ছোট-বড় গুনাহসমূহ মার্জনা করানোর সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। এই দিনকে রাসুলুল্লাহ (স.) বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। আল্লাহর রাসুল (স.)-ও উম্মতকে এ সওম পালনের নির্দেশ দেন। (বুখারি: ১৮৯৩)


বিজ্ঞাপন


নিচে আশুরার দিনের ফজিলতপূর্ণ আমলগুলো এবং যেভাবে দিনটি কাটাবেন তার একটি চিত্র তুলে ধরা হলো।

রোজা রাখা
আশুরার দিনের সবচেয়ে বড় আমলটি হলো রোজা রাখা। ইহুদিরাও এই দিনে রোজা রাখত, তাদের বৈশাদৃশ্যের জন্য উম্মতে মুহাম্মদিকে দুটি রোজা রাখার আদেশ করা হয়েছে। ( (মুসনাদে আহমদ: ২১৫৪ ;সহিহ মুসলিম: ২৫৫৬; জামে তিরমিজি: ৭৫৫)
আশুরার দিনের রোজার ফজিলত সম্পর্কে আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেছেন, আল্লাহর নিকট আমি আশা পোষণ করি যে, তিনি আশুরার রোজার মাধ্যমে পূর্ববর্তী এক বছরের (গুনাহ) ক্ষমা করে দেবেন। (জামে তিরমিজি: ৭৫২)

আশুরার দিনে তাওবা 
রোজার পাশাপাশি এই দিনে তাওবার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। যদিও তাওবা-ইস্তেগফার যেকোনো সময় করা যায়। তবে কিছু সময় এমন রয়েছে, যখন তাওবার বেশি অনুকূল। বান্দার উচিত সেই প্রত্যাশিত মুহূর্তগুলোকে কাজে লাগানো। মহররমের এ মাসটি, বিশেষ করে ১০ তারিখ—এমনই এক মোক্ষম সময়। এক সাহাবি নবীজির কাছে জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসুল! রমজানের পর আপনি কোন মাসে রোজা রাখতে বলেন? নবীজি বললেন, তুমি যদি রমজানের পর রোজা রাখতে চাও তাহলে মহররমে রোজা রাখো। কেননা মহররম হচ্ছে আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন এক দিন আছে, যেদিন আল্লাহ তাআলা (অতীতে) অনেকের তাওবা কবুল করেছেন। ভবিষ্যতেও অনেকের তাওবা কবুল করবেন। (জামে তিরমিজি: ৭৪১) 

আহলে বাইতের ওপর দরুদ
আহলে বাইত বলতে মূলত প্রিয়নবী (স.)-এর স্ত্রী, বংশধর ও আত্মীয়-স্বজনদের বোঝায়। পবিত্র আশুরার দিনে সংঘটিত হয়েছিল কারবালায় ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনা। তাই এই দিনে ইমাম হোসাইন (রা.)-সহ পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি দরুদ বর্ষণ করা মুসলিম উম্মাহর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। এই আমলটি ঈমানেরই একটি অন্যতম শাখা। এটি পালনের মাধ্যমে মূলত নবীজি ও নবী-পরিবারকে সম্মানিত করা হয়। বুখারি শরিফের ব্যাখ্যাকারক আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি (রহ.) বলেন, ঈমানের ৭০টির বেশি শাখার মধ্যে ১১ নম্বর শাখা হলো রাসুল (স.)-এর বংশধরদের ভালোবাসা। (উমদাতুল কারি শরহে সহিহিল বুখারি: ১/৩৩৪)


বিজ্ঞাপন


ইসলামি শরিয়তে রাসুল (স.)-এর আহলে বাইতকে ভালোবাসা ও অনুসরণ করা জরুরি। যারা প্রিয়নবী (স.)-এর প্রতি ঈমান ও ভালোবাসার দাবিদার তাদের জন্য জরুরি যে নবীজির কারণেই আহলে বায়তকে ভালোবাসবে এবং তাঁদের অনুসরণ করবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘বলুন, আমি এর বিনিময়ে তোমাদের কাছ থেকে আত্মীয়তার সৌহার্দ্য ছাড়া অন্য কোনো প্রতিদান চাই না। যে উত্তম কাজ করে আমরা তার এতে কল্যাণ বাড়িয়ে দিই। নিশ্চয়ই আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, গুণগ্রাহী।’ (সুরা শুরা: ২৩)

আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, যখন এই আয়াত নাজিল হলো তখন সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! কারা আপনার নিকটাত্মীয়? যাঁদের মুয়াদ্দাত (ভালোবাসা) পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে ফরজ করা হয়েছে।’ জবাবে নবীজি (স.) বলেন, ‘আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসাইনের মুয়াদ্দাত (ভালোবাসা)।’ (তাফসিরে মাজহারি: ১১/৬৩)

পরিবারের জন্য ভালো খাবারের আয়োজন
আশুরার দিনে যথাসাধ্য খাবারে প্রশস্ততা প্রদর্শন করা, যথাসম্ভব ভালো খাবার খাওয়া সুন্নাহ সমর্থিত। হজরত আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী (স.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিনে পরিবারে প্রশস্ততা প্রদর্শন করবে, সে সারা বছর প্রশস্ততায় থাকবে।’ (তাবরানি, মুজামে কবির: ১০০০৭; বায়হাকি: ৩৭৯৫)
এ হাদিসের বর্ণনা সূত্রে দুর্বলতা আছে। তবে ইবনে হিব্বানের মতে, এটি ‘হাসান’ বা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের হাদিস। ইমাম আহমদ (রহ.) বলেছেন, এটি বিশুদ্ধ হাদিস নয়। তবে এ বিষয়ে একাধিক বর্ণনা থাকার কারণে ‘হাসান’ হওয়া অস্বীকার করা যাবে না। আর ‘হাসান লিগাইরিহি’ পর্যায়ের হাদিস দ্বারা আমল করা যায়। (আস-সওয়াইকুল মুহরিকা আলা আহলির রফজি ওয়াদ দালাল ওয়াজ জানদিকা: ২/৫৩৬)

বিদআত থেকে দূরে থাকা
আশুরার দিনকে কেন্দ্র করে নানারকম বিদআতি কার্যক্রম সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। এ থেকে একজন প্রকৃত মুসলমানকে সতর্ক থাকতে হবে। হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের স্মরণ করে মাতম-বিলাপ, তাজিয়া মিছিল, নিজ দেহে চাবুকের আঘাত ও ছুরিকাঘাত—এসব গর্হিত আমল। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘শোকে বিহ্বল হয়ে যে ব্যক্তি গাল চাপড়ায়, কাপড় ছেঁড়ে ও জাহেলি যুগের মতো আচরণ করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (সহিহ বুখারি: ১২৯৭)
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, রাসুল (স.) বিলাপকারিণীকে এবং তা শ্রবণকারীকে অভিসম্পাত করেছেন। (মুসনাদে আহমদ: ১১৬২২, আবু দাউদ: ৩১২৮, সুনানে সগির লিলবায়হাকি: ১১৪২)
হজরত উম্মে আতিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) আমাদের বাইয়াত গ্রহণকালে এ অঙ্গিকার নিয়েছেন যে, আমরা যেন মৃত ব্যক্তির জন্য উচ্চসরে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রন্দন না করি। (সহিহ বুখারি: ১৩০৬, ১২৪৪)

এছাড়াও কালো পতাকা উত্তোলন, দুলদুল কবর ইত্যাদির আকৃতি বানানো, মর্সিয়া করা, পুঁথি পাঠ করা, হালুয়া-রুটির হৈ-হুল্লোড় করা, শোকযাত্রা বের করা, আতশবাজি ও আলোকসজ্জা করা—এসব কোনোকিছুই সুন্নাহসমর্থিত নয়। এসবের মধ্যে এমন কাজও রয়েছে, যেগুলোতে শিরকের আশঙ্কা থাকে। অতএব এসব কর্মকাণ্ড পরিত্যাগ করা ওয়াজিব।

ফরজ নামাজ তাকবিরে উলার সঙ্গে আদায় করা
আশুরার মতো গুরুত্বপূর্ণ দিনে নামাজের প্রতি উদাসীনতা কখনও কাম্য নয়। নবীজি (স.) বলেছেন, ‘যার নামাজের হিসাব ঠিকঠাক থাকবে, তার জন্য রয়েছে মুক্তি। আর যার নামাজে অনিয়ম পাওয়া যাবে, তার জন্য রয়েছে ধ্বংস।’ (রিয়াদুস সালিহিন: ১০৮১) 
তাকবিরে উলা হচ্ছে প্রথম তাকবির। এর ফজিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (স.) এক হাদিসে বলেছেন—‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে একাধারে চল্লিশ দিন তাকবিরে উলার (ইমামের প্রথম তাকবির) সঙ্গে জামাতে নামাজ আদায় করবে, তাকে দুটি নাজাতের ছাড়পত্র দেওয়া হবে। ১. জাহান্নাম থেকে মুক্তি ২. মুনাফেকি থেকে মুক্তি।’ (তিরমিজি: ২৪১)

হাদিস থেকে বোঝা যায়, ইমামের প্রথম তাকবির বলার সঙ্গে সঙ্গে তাকবির বলে নামাজ শুরু করলে তাকবিরে উলা পাবে। সুরা ফাতেহা শেষ হওয়ার আগে জামাতে শরিক হতে পারলেও কোনো কোনো ফকিহ তাকবিরে উলার সওয়াব হাসিল হয়ে যাবে বলে উল্লেখ করেছেন। ফতোয়া শামি: ১/৫২৬; তাতারখানিয়া: ২/৫৪; আলমুহিতুল বুরহানি: ২/১০৭)

এছাড়াও এই দিনে যথাসম্ভব জিকির আজকারে কাটানো, ঝগড়া-বিবাদ ও হারাম বিষয়গুলো থেকে নিজেকে দূরে রাখা মুমিন মুসলমানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

অতএব, আশুরার দিন যেভাবে আমরা রোজা রাখার চেষ্টা করব, যথাসময়ে ফরজ নামাজের পাশাপাশি দোয়া-জিকির, নবী-পরিবারের প্রতি দরুদ ও তাওবার প্রতি মনোনিবেশ করব; একইসঙ্গে বিদআতি কাজ থেকে দূরে থাকব। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন। 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর