মহাগ্রন্থ আল কোরআনের দুই নম্বর সুরার (সুরা বাকারা) ১৮৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সিয়াম (রমজানের রোজা) পালনকে ফরজ ঘোষণা করেছেন। সিয়াম সাধনার এই গুরুত্বপূর্ণ মাসটি আমরা যদি যথাযথ ব্যবহার করতে পারি, মর্যাদাবান এই মাসকে কাজে লাগাতে পারি, তবেই পাথেয় সংগ্রহের মাস হিসেবে ধরা দেবে এই রমজান।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সাওম পালনের যে নির্দেশনা দিয়েছেন, সেখানে আয়াতের শেষাংশে তিনি বলেছেন, ‘লাআল্লাকুম তাত্তাকুন’ যাতে সিয়াম পালনের মধ্য দিয়ে তোমরা তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত হতে পারো, তাকওয়া অর্জন করতে পারো। সম্ভবত তোমাদের তাকওয়া অর্জিত হবে।
বিজ্ঞাপন
অনেকে না খেয়ে থাকবেন, পানাহার বন্ধ করবেন কিন্তু জৈবিক চাহিদা থেকে বিরত থাকবেন না, তার সাওম পালন আল্লাহর কাছে কখনও কবুল হবে না। এজন্য দরকার-সিয়াম সাধনাকে কোরআনিক লেসন অনুযায়ী এবং মহানবী (স.)-এর হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী পালন করা। তখনই সাওম মুমিনের জীবনে নাজাতের জারিয়া হিসেবে এবং মুমিনের পাথেয় সংগ্রহের মাসে পরিগণিত হবে।
প্রত্যেকটি কাজের বা পরিশ্রমের প্রতিদান আছে। সাওমেরও প্রতিদান আছে। কিন্তু সাওম এমন একটি ইবাদত, যার প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজেই দেওয়ার ঘোষণা দেন। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আস সাওমু লি, ওয়াআনা আজঝি বিহি’ অর্থাৎ রোজা আমার জন্য এবং এর প্রতিদান আমি নিজেই দেবো। আর ‘মান লাহুল মাওলা ফালাহুল কুল’ আল্লাহ যদি কারো হয়ে যান, তাহলে তার কোনো চিন্তা নেই।
আমরা আমাদের বৈশ্বিক জীবনে দেখি, সামান্য স্বাবলম্বী কোনো ব্যক্তি অথবা স্থানীয় সরকারের কোনো প্রতিনিধি কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের কোনো সদস্য বা সংসদ সদস্য অথবা বিশিষ্ট বা বিত্তবান কোনো ব্যক্তি যদি আমাদেরকে বলেন যে, তোমার জন্য আমি আছি, তাহলে আমাদের কেমন লাগবে? যদি রাষ্ট্রপ্রধান বলেন যে, ‘তোমার কোনো চিন্তা নেই। তোমার জন্য আমি আছি।’ তাহলে কেমন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করার কথা। এধরণের বিষয়গুলোতে তীব্র এক সুখানুভূতিতে আমরা বিমোহিত হই। তখন আমরা মনে করি, দ্যাটস গুড, আমার একটি উত্তম আশ্রয়স্থল হয়ে গেলো।
আর যিনি এই কায়েনাতের এই মাখলুকাতের স্রষ্টা, যিনি আমাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন, স্বয়ং তিনি যদি আমাদেরকে বলেন যে, সাওম আমার জন্য এবং এর প্রতিদান আমি নিজেই দেবো। তাহলে মুমিনদের চিন্তার জগতে কেমন ঝড় উঠতে পারে! কতটা খুশিতে তারা বিমোহিত হতে পারে। এরপর কী হবে, না হবে, কোনোকিছু নিয়েই চিন্তা করার আর কোনো কারণ থাকে না তার।
বিজ্ঞাপন
সুতরাং সাওমকে যথাযথভাবে পালন করাটাই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে আছেন, সারাদিন না খেয়ে থাকেন। হাদিসের ভাষায়, তাদের না খেয়ে থাকায় সাওম পালন হয় না। অনেকে সারারাত ইবাদত বন্দেগী করেন, অথচ তাদের ইবাদত বন্দেগী আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। তাদের রাত জাগাটাই নিষ্ফল হয়। তাদের শুধু ক্ষুধার্থই থাকা হয়। এর মানে হচ্ছে, সাওমকে যথাযথভাবে আমাদের পালন করতে হবে।
সুতরাং হাদিস অনুযায়ী, সাওম পালনরত ব্যক্তি অশ্লীল কথা বলবেন না, অন্য হাদিসে এসেছে, চিৎকার করবে না, হাঙ্গামা করবে না এবং মুর্খের মতো আচরণ করবে না। যদি অন্য কেউ তার সামনে এমন করেন, তাহলে তিনি বলবেন, ইন্নি সায়িমুন অর্থাৎ আমি রোজাদার।
স্বাভাবিক জীবন যাপনে ব্যক্তি যে আচরণ করেন, রোজাদার তা করতে পারেন না, রিপুর তাড়নায় অশ্লীলতায় জড়াতে পারেন না। কারণ, তাকে মনে করতে হবে যে, প্রতিনিয়ত সৃষ্টিকর্তা তাকে দেখছেন এবং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তিনি না খেয়ে আছেন, পানাহার বর্জন করেছেন, জৈবিক চাহিদা মেটানোর সুযোগ থাকার পরও তা বর্জন করেছেন।
এই যদি হয় কোনো ব্যক্তির চেতনা, তাহলে তাঁর ব্যক্তিজীবনে, পারিবারিক, সামাজিক কিংবা সামগ্রিক জীবনে যেখানেই তিনি থাকুন, নিজেকে শুদ্ধতম ব্যক্তি হিসেবে গড়তে পারবেন। তার যদি এই বোধ বা চেতনা থাকে যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলা দেখছেন, সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখছেন, তাহলে তিনি যেখানেই থাকুন, তিনি আলোকিত থাকবেন। অন্যের জন্য তিনি মডেল হবেন। মানুষ তাকে বিশ্বাস করবেন। মানুষের আপনজন হবেন। সুতরাং দয়াময় আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সুসম্পর্ক নির্মাণের অনবদ্য একটি সিস্টেমের নাম হলো সিয়াম সাধনা।
আমরা যদি যথাযথভাবে সিয়াম পালন করি, হাদিসের ভাষায় পূর্ববর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। অন্য হাদিসে এসেছে, শাহরুস সাবার বা ধৈর্যের মাস রমজান। আর সবরের যে প্রতিদান দেওয়া হবে, সেটা হচ্ছে জান্নাত।
আল্লাহ ও রাসুল (স.) যেভাবে প্রত্যাশা করেন, সেভাবে সিয়াম সাধনা পালন করলে তার সাওমই তার পরকালের নাজাতের জারিয়া হবে। এজন্য বলা হয়েছে, আসসাওমু জুন্নাতুন, সাওম হলো ঢালস্বরূপ। যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য সেনারা যেমন ঢাল ব্যবহার করে, ঠিক সাওম ব্যক্তির যাবতীয় কামনা বাসনা ও রিপুর তাড়না ও অনাকাঙ্খিত অপ্রত্যাশিত কার্যক্রম থেকে দূরে রাখে। এতে তাঁর আত্মিক শুদ্ধতা নিশ্চিত হয়, আল্লাহর নেক বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হন।
আসুন, আমরা সবাই গুরুত্বপূর্ণ এই বিধানকে যথাযথভাবে পালন করি। আমরা জানি না, কখন আমাদের জীবন প্রদীপ নিভে যাবে। হতে পারে সাওম পালনের এটাই আমাদের জীবনের শেষ সুযোগ। আমরা ফেলে আসা জীবনে যত পঙ্খীলতায় কলবকে অন্ধকার করে রেখেছি, জাহান্নামি লোকদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছি, আমরা নিজেও জানি না। সুতরাং সর্বোৎকৃষ্ট ও মহিমান্বিত এই মাসে আমরা নিজেদেরকে পবিত্র করি। তাওবা-ইস্তেগফার করি। সাওমকে আমাদের নাজাতের জারিয়া হিসেবে পরিণত করি।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে যথাযথভাবে সাওম পালনের তাওফিক দান করুন। মহান আল্লাহ আমাদের এই সাওমের মধ্য দিয়ে যাবতীয় কল্যাণ নসিব করুন। আমিন।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

