সালফে সালেহিন অর্থ পুণ্যবান পূর্বসূরি। সালফে সালেহিন বা সালাফ বলা হয়, পূর্ববর্তী এমন মুসলিম ব্যক্তিত্বদের, যারা নবী কারিম (স.)-এর নির্দেশিত পন্থা আমৃত্যু অনুসরণ করেছেন। যাদেরকে রাসুলুল্লাহ (স.) উম্মতের ‘শ্রেষ্ঠ মানুষ’ হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে- خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِي ثُمَّ الَّذيِنَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذيِنَ يَلُونَهُمْ সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ হলো- আমার যুগের মানুষ, অতঃপর তাদের পরবর্তী যুগের মানুষ, অতঃপর তাদের পরবর্তী যুগের মানুষ। (বুখারি: ৬৬৫৮)
সালফে সালেহিনের যুগ বলতে সাহাবা, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনদের যুগকে বলা হয়। ওই যুগের মুসলমানরা সব বিষয়ে সব ক্ষেত্রে পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে প্রিয়নবী (স.)-এর অনুসরণ করেছেন। কোরআনের ভাষায়- ‘যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসুলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা আছে।’ (সুরা আহজাব: ২১)
বিজ্ঞাপন
রাসুলুল্লাহ (স.) মুসলমানদেরকে তাঁদের অনুসরণ করার আদেশ দিয়ে বলেন, তোমরা (ইবাদতের ক্ষেত্রে) নতুন নতুন বিষয় আবিষ্কার করা থেকে দূরে থাকবে। কেননা তা গোমরাহি। তোমাদের মধ্যে কেউ সে যুগ পেলে সে যেন আমার সুন্নতে ও সৎপথপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশিদিনের সুন্নতে দৃঢ়ভাবে অবিচল থাকে। তোমরা এসব সুন্নতকে চোয়ালের দাঁতের সাহায্যে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো। (তিরমিজি: ২৬৭৬)
সালফে সালেহিনের অনন্য গুণাবলী
উত্তম আখলাক ও সচ্চরিত্রে সালফে সালেহিন ছিলেন সর্বাগ্রে। দয়া-অনুগ্রহ, নম্রতা-বিনয় এবং ভদ্রতা ইত্যাদি গুণে ছিলেন অনন্য। অসৎ আচার-আচরণ থেকে বিরত থাকা ছিল তাঁদের সৌন্দর্য। তাঁরা নিফাক থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতেন। আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় ইবাদতের প্রতি অত্যধিক আগ্রহ, বিভিন্ন নফল আমলের জন্য আলাদা সময় নির্ধারণ এবং যেসব জিনিস ইবাদতে অমনোযোগিতা সৃষ্টি করে তা থেকে নিজেকে দূরে রাখা ছিল সালাফদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য।
তাঁরা অত্যধিক গুরুত্বের সঙ্গে জামাতে নামাজ পড়তেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)-এর জীবনীতে দেখা যায়, কোনোদিন জামাত ছুটে গেলে তিনি সারাদিন রোজা রাখতেন, সারারাত ইবাদত করতেন এবং একজন গোলাম আজাদ করতেন। রাত জেগে ইবাদতের প্রতি সালাফদের অন্যরকম উৎসাহ ছিল। আমের ইবনে আবদুল্লাহ (রহ.)-কে তাঁর রাতজাগার পরিমাণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আমি শুধু দিনে রাত পর্যন্ত রোজা রাখি আর রাতে দিন পর্যন্ত সজাগ থাকি। এটা তেমন বিরাট কিছু তো নয়। (সিলসিলাতু উলুউল হিম্মাহ: ১৬/১০)
তুচ্ছ দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার অনন্য উদাহরণ হলেন আমাদের পূর্ববর্তী সালাফগণ। জান্নাতি নারীদের নেত্রী ফাতিমা (রা.)-এর একবার একটি খাদেম প্রয়োজন ছিল। নবীজি (স.) জানালেন, শয়নকালে ৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’, ৩৩ বার ‘আল হামদুলিল্লাহ’ এবং ৩৪ বার ‘আল্লাহু আকবার’ বলা খাদেমের চেয়ে শ্রেয়। আলী (রা.) বলেন, অতঃপর কখনো আমি এই আমলগুলো ছাড়িনি। জিজ্ঞেস করা হলো সিফফিনের রাতেও না? তিনি (আলী রা.) বলেন, সিফফিনের রাতেও না। (বুখারি: ৫৩৬২)
বিজ্ঞাপন
তাঁরা নবীজির মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলেই সে কথার ওপর আমল করা শুরু করে দিতেন। সারা জীবন তা ছাড়তেন না। এরপরও আমল কবুল না হওয়ার ভয়ে ভীত থাকা সালফে সালেহিনদের অন্যতম গুণ ছিল। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে সুরা মুমিনুনের নিচের আয়াত, অর্থ: ‘এবং যারা যা কিছু দান করে, তা ভীত ও কম্পিত হৃদয়ে দান করে। কেননা তাদের আপন রবের কাছেই ফিরে যেতে হবে।’ এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম যে তারা কি মদপায়ী বা চোর হবে? তিনি উত্তর দিলেন, না, হে সিদ্দিক তনয়া! তারা নিয়মিত নামাজ আদায় করবে, রোজা রাখবে, দান-সদকাও করবে আবার এই ভেবে ভীত থাকত যে (কোনো ভুলের কারণে) তাদের আমল কবুল করা হবে না। তারাই কল্যাণ দ্রুত অর্জন করে এবং তারা তাতে অগ্রগামী। (তিরমিজি: ৩২৭৫)
প্রতিটি মুসলমানের উচিত জীবনের সর্বক্ষেত্রে সালফে সালেহিনের পদাঙ্ক অনুসরণ করা। আল্লাহ তাআলা আমাদের সেই তাওফিক দান করুন। আমিন।

