রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

আহলে কিতাব নারীকে বিয়ে করা জায়েজ, অন্যদের নয় কেন?

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮ এপ্রিল ২০২২, ০৩:৩৫ পিএম

শেয়ার করুন:

আহলে কিতাব নারীকে বিয়ে করা জায়েজ, অন্যদের নয় কেন?

খ্রিস্টান বা ইহুদি নারীকে (কিতাবধারী) বিয়ে করার অনুমতি ইসলামে আছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘... মুমিন সতীসাধ্বী নারী ও আহলে কিতাবের সতীসাধ্বী নারী তোমাদের জন্য বৈধ করা হলো...।’ (সুরা মায়েদা: ৫) 

কিন্তু আহলে কিতাব কোনো পুরুষের সঙ্গে মুসলিম নারীর বিয়ে বৈধ নয়। এ প্রসঙ্গে সুরা মুমতাহিনার ১০ নম্বর আয়াতে এসেছে, ‘হে মুমিনরা! যখন তোমাদের কাছে মুমিন নারীরা হিজরত করে আসে, তখন তোমরা তাদের পরীক্ষা করে নাও, তাদের ঈমান সম্পর্কে আল্লাহই ভালো জানেন। অতঃপর যদি তাদের মুমিন বলে জানতে পারো, তাহলে তাদের কাফিরদের কাছে ফিরিয়ে দিয়ো না। মুমিন নারীরা কাফিরদের জন্য হালাল নয়। আর কাফিররাও তাদের জন্য হালাল নয়...।’ (সুরা মুমতাহিনা: ১০)


বিজ্ঞাপন


ইমাম বুখারি (রহ.)-এর শিক্ষক ইমাম আবদুর রাজ্জাক (রহ.) লিখেছেন, আবু জুবায়ের (রা.) বলেন, আমি জাবের (রা.)-কে বলতে শুনেছি, আহলে কিতাবের নারীরা আমাদের (মুসলমানদের) জন্য হালাল। কিন্তু আমাদের নারীরা তাদের জন্য হারাম।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৬/৪৩)

এ বিষয়ে খলিফা ওমর (রা.)-এর কর্মপন্থা কী ছিল—সে সম্পর্কে জায়েদ বিন ওয়াহাব (রা.) বলেন, ‘ওমর (রা.) এই মর্মে পত্র পাঠিয়েছেন যে, মুসলিম পুরুষ খ্রিস্টান নারীকে বিবাহ করতে পারবে। কিন্তু কোনো খ্রিস্টান পুরুষ কোনো মুসলিম নারীকে বিবাহ করতে পারবে না।’ (কানযুলউম্মাল: ১৬/৫৪৮)

কুয়েতের ওয়াকফ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ইসলামি আইন বিশ্বকোষে বলা হয়েছে, ‘মুসলমানের জন্য এমন নারীকে বিবাহ করা হারাম, যার কোনো কিতাব নেই (অর্থাৎ যে কোনো আসমানি গ্রন্থে বিশ্বাসী নয়)।’ (আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা আল কুয়েতিয়্যাহ: ৩৫/২৬)

কেন আহলে কিতাব নারীকে বিয়ে করা যাবে—এ প্রসঙ্গে শাহ ওয়ালি উল্লাহ (রহ.) লিখেছেন, ‘বৈবাহিক জীবনে স্বামীর ভূমিকা প্রভাব বিস্তারকারী হয়। স্ত্রীরা স্বামীদের তত্ত্বাবধানে চলে আসে। ফলে কোনো মুসলিম আহলে কিতাবের নারীকে বিয়ে করলে মুসলিম পুরুষের ধর্মীয় জীবনে প্রভাব বিস্তারের অবকাশ কম থাকে। তাই এ বিয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা: ২/১৩৩)

কোনো পরিস্থিতিতে মুসলিম নারীকে অন্য ধর্মাবলম্বীর কাছে বিয়ে দেওয়া বৈধ নয়। এ বিধান কোথাও কোথাও কার্যকর না হলেও বিয়ে বৈধ নয়। কেননা এ ধরনের বিয়ে অবৈধ হওয়ার মূল কারণ তো মহান আল্লাহই এমন বিয়ের অনুমতি দেননি।

ইমাম আলাউদ্দিন কাসানি (রহ.) লিখেছেন, ‘অমুসলিম নারীদের বিয়ে করা বৈধ করা হয়েছে ইসলাম গ্রহণের উদ্দেশ্যে। এর আগে তারা পূর্ববর্তী নবী ও আসমানি কিতাবে ঈমান এনেছে। মুসলমানের সঙ্গে তাদের বিয়ে হলে মুসলিম ব্যক্তি তাদের ইসলামের প্রতি আহ্বান করতে পারবে।’ (বাদায়িউস সানায়ি: ২/২৭০)

আবার আহলে কিতাব ছাড়া অন্য ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে কোনো ধরনের বৈবাহিক সম্পর্ক বৈধ নয়। সুতরাং প্রচলিত হিন্দু, বৌদ্ধ, বাহায়ি, শিখ ও কনফুসীয় ধর্ম আসমানি ধর্ম হওয়ার বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় এসব ধর্মের অনুসারীরা আহলে কিতাব হিসেবে গণ্য হবে না। তাই তাদের সঙ্গে মুসলিম নারী ও পুরুষের কোনো ধরনের বিয়ে বৈধ নয়।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘ঈমান না আনা পর্যন্ত তোমরা মুশরিক (বহু স্রষ্টায় বিশ্বাসী) নারীকে বিয়ে করো না, যদিও মুশরিক নারী তোমাদের মুগ্ধ করে...। ঈমান না আনা পর্যন্ত তোমরা মুশরিক পুরুষের সঙ্গে (তোমাদের নারীদের) বিয়ে দিয়ো না, যদিও মুশরিক পুরুষ তোমাদের মুগ্ধ করে...। ’ (সুরা বাকারা: ২২১)

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘...তোমরা কাফির নারীদের সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রেখো না...।’ (সুরা মুমতাহিনা: ১০)

উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভি (রহ.) এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘এরকম বিয়ের মাধ্যমে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে কুফর অন্তরে প্রবেশ করে (তাই আহলে কিতাব ছাড়া অন্যদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ নয়)। কিন্তু আহলে কিতাব তথা ইহুদি ও খ্রিস্টানরা আসমানি কিতাবে বিশ্বাসী। তারা শরিয়তের মৌলিক বিষয় (অর্থাৎ একত্ববাদ, নবুয়ত ও আখেরাত) স্বীকার করে। ফলে তাদের সংস্পর্শে ধর্মীয় মূল্যবোধ বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা অন্য ধর্মের তুলনায় কম। কিন্তু অগ্নিপূজারি, মূর্তিপূজারি ও মুশরেকদের বিষয়টি এর ব্যতিক্রম।’

স্মরণ রাখতে হবে, আহলে কিতাবদের বিয়েও শর্তহীন নয়। পাকিস্তানের শরিয়াহ বেঞ্চের সাবেক বিচারপতি ও ওআইসির ফতোয়া বোর্ডের সদস্য মুফতি তাকি উসমানি লিখেছেন—

‘ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী নারীর সঙ্গে মুসলিম পুরুষের বিয়ে হতে পারে। তবে শর্ত হলো, নারী বাস্তবেই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী হতে হবে। বর্তমান যুগের খ্রিস্টানদের মতো হলে চলবে না, যারা নামেমাত্র খ্রিস্টান। আকিদা-বিশ্বাসের দিক থেকে এরা নাস্তিক। দ্বিতীয় শর্ত হলো, বিবাহ ইসলামী শরিয়তসম্মত পন্থায় দুজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে হতে হবে।’ (ফতোয়া উসমানি: ২/২৫৭)

এছাড়া আরো কিছু শর্ত আছে। যেমন—আহলে কিতাবের নারী সতীসাধ্বী হতে হবে। ইসলামবিদ্বেষী হতে পারবে না। এ বিয়ের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলমানের কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা না থাকা নিশ্চিত হতে হবে। আর দারুল কুফরের আহলে কিতাবের নারীকে বিয়ে করা যাবে না ইত্যাদি।

এ দীর্ঘ আলোচনার পর কিছু প্রশ্ন আসে, যেমন- কোনো মুসলিম নারীর যদি ইতিপূর্বে অন্য ধর্মাবলম্বীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গিয়ে থাকে, তার করণীয় কী? এর জবাব হলো- স্বামীকে মুসলিম বানিয়ে নতুনভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবে। সেটা সম্ভব না হলে অতিদ্রুত তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। (আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল: ৬/১৪৩)

আর ইসলাম অনুমোদিত নয়, এমন বিয়ের মাধ্যমে সন্তান জন্ম নিলে নাবালেগ থাকা পর্যন্ত মুসলিম হিসেবে গণ্য হবে। এ বিষয়ে ইসলামী আইনের গ্রন্থ ‘হেদায়া’য় রয়েছে, ‘স্বামী ও স্ত্রীর কোনো একজন যদি মুসলিম হয়, তাহলে সন্তান তাঁর ধর্ম—অর্থাৎ ইসলাম ধর্মাবলম্বী বলে গণ্য হবে।’(হেদায়া: ২/৩৪৬)

সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর, সে নিজেই সত্যপথ খুঁজে নেবে। সে-ই তার গন্তব্য স্থির করে নেবে। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘দ্বীন গ্রহণে জোর-জবরদস্তি নেই। সত্যপথ ভ্রান্তপথ থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে...।’ (সুরা বাকারা: ২৫৬)

উল্লেখ্য, ইসলামে বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও ধর্মীয় বন্ধন। এখানে ধর্মীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। মহানবী (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘বিয়ে আমার সুন্নত (আদর্শ)। আর যে ব্যক্তি আমার সুন্নতের অনুসরণ করে না,  সে আমার দলভুক্ত (মুসলমান) নয়।’(ইবনে মাজাহ: ১৯৪৬)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বিয়েসহ সকল বিষয়ে দ্বীনের অনুগামী করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর