মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

কানাডায় বাংলা বইয়ের প্রসারে নিবেদিতপ্রাণ আনোয়ার দোহা

ফারজানা নাজ শম্পা 
প্রকাশিত: ০১ জুন ২০২৩, ১০:৩৩ পিএম

শেয়ার করুন:

কানাডায় বাংলা বইয়ের প্রসারে নিবেদিতপ্রাণ আনোয়ার দোহা

আনোয়ার দোহা একজন অমায়িক সদালাপী ব্যক্তিত্ব যিনি দীর্ঘ সময় ধরে কানাডায় মূলধারায় বাংলা বইয়ের প্রসার ও বাণিজ্যিকীকরণে নিবেদিত থেকেছেন। বেঁচে থাকার ছককাটা জীবন থেকে একটু দুরে থেকে স্বতন্ত্র ধারায় চিন্তা করেছেন আর হৃদয়ে ধারণ করেন দেশাত্মবোধ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। কানাডায় মূলধারায় বাংলা বইয়ের অভাব তাকে তাড়িত করত। সেই অদম্য বাসনা থেকে কানাডায় বাংলাদেশি বিভিন্ন সংগঠন অধ্যুষিত ২৯৭২ ড্যানফোর্থ এভিনিউতে নিজের শেষ সম্বল পুঁজি করে গড়ে তোলেন ‘এটিএন মেগা স্টোর’ (atnmegastore@gmai।.com)।

কানাডা প্রবাসী বাঙালি ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও কৃষ্টির উপকরণ সম্ভারে পূর্ণ তার এই প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে আলাপচারিতায় তিনি বলেন, ২০০১ সালে নিউইয়র্ক হতে কানাডায় আসি আমি। বাংলাদেশের দেশাত্মবোধ হৃদয়ে লালন করে ২০০২ সালে প্রাথমিকভাবে ধ্রপদী ও আধুনিক বাংলা গান, চলচ্চিত্রের অডিও ও ভিডিও ক্যাসেট, সিডি ইত্যাদি নিয়ে যাত্রা শুরু করি। পরবর্তীতেতে স্থানীয় বাংলা বইপ্রেমী কানাডাপ্রবাসী কয়েকজনের বিশেষ উৎসাহ কানাডায় বাংলা ভাষা সাহিত্য বিকাশের নিরিখে হৃদয়ে লালিত আমার অদম্য সুপ্ত ইচ্ছার সফল বাস্তবায়ন ঘটে ২০০৬ সাল হতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সব ধরনের বই, অভিধান, বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন উৎসব সাময়িকী, যেমন- ঈদ ও পূজাসহ অন্যান্য উৎসব সংখ্যা, ইত্যাদি নিয়ে যাত্রা শুরু করে এখন পর্যন্ত পথ চলছি।


বিজ্ঞাপন


কোন আদর্শ তাকে এই উদ্যোগে অনুপ্রাণিত করেছিল- এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি মূলত হিসাব বিজ্ঞান নিয়ে আমেরিকা ও কানাডায় কয়েকটি উচ্চতর ডিপ্লোমা ডিগ্রি নেই। কানাডায় হিসাব বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষক হিসেবে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলাম। তবে কানাডায় মূলধারায় ও অভিবাসী বাঙালি অঙ্গনে বাংলা ভাষার প্রসার অব্যাহত রাখার তাগিদ ও বাংলা বইয় প্রাপ্তির শূন্যতা আমাকে বাংলাদেশের স্বকীয় পরিচয়সমৃদ্ধ এবং স্বতন্ত্র পরিচয়ে লালিত বাংলা বইয়ের দোকান করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার শক্তি দেয়।

সাহিত্যের মাধ্যমেই সুন্দর জীবনবোধসম্পন্ন জাতি গড়ে তোলা সম্ভব। তাই কানাডাপ্রবাসী ও পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, ইতিহাস লালিত ক্ষেত্র সমুন্নত রাখার নিরিখে এই উদ্যোগ।

অনুকরণীয় জীবন দর্শন ও আদর্শে বিশ্বাস প্রসঙ্গে তিনি জানান, একজন বাঙালি হিসেবে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিসত্তার প্রতি দায়বদ্ধতা ছোটবেলা থেকে। বইয়ের সাথে আমার গভীর সম্পৃক্ততা ও অপরকে ভালো বই পড়ানোর মানসিক তৃপ্তি এবং এই প্রক্রিয়ায় সুকুমার বিকাশ- এই দর্শনেই কানাডায় বাংলা বই বিপণন ও সম্প্রসারণে আগ্রহী হয়েছি। আলোকিত মানুষগড়ার কারিগর শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবু সায়ীদের জীবন বোধ আমার অনুকরণীয় আদর্শ।

তার প্রতিষ্ঠানের বাংলা বইয়ের সংগ্রহ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুই বাংলার বরণীয় লেখকদের স্মরণীয় ও জনপ্রিয় উপন্যাস, কবিতা, অনুবাদ গল্প, সব বয়সের পাঠক উপযোগী বই আমাদের সংগ্রহে আছে। শিশুদের জন্য বাংলা বর্ণ শেখা, গণিত ও সংখ্যা গণনা, ছড়া, কবিতা ও গল্পের বই এবং কিশোরদের জন্য ফিক্শান, ননফিকশান, সব ধরনের উপন্যাস, গল্প ও কবিতাসহ বাংলা ভাষায় রচিত বিভিন্ন ধর্মীয় বই সংগ্রহে রয়েছে। পাঠকদের চাহিদা অনুসারে অর্ডার নেওয়া হয়। বাংলা সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য লালন করে যেমন- মৃৎশিল্প, পোড়ামাটি, বাঁশ, বেত ও কাঠজাত মনকাড়া গৃহসজ্জা, চিত্র ও উপহার সামগ্রী, বাংলাদেশের পতাকা ও পতাকা খচিত টিশার্ট, সুভেনির, লুঙ্গি, গামছা ইত্যাদি। বাংলাদেশের ঐতিহ্য-ইতিহাস ধারণ বা লালন করে না- এমন পণ্যসামগ্রী আমি সংগ্রহে রাখি না।


বিজ্ঞাপন


নিজের জন্ম, পরিবার, শিক্ষাজীবন ও স্মরণীয় মুহূর্ত প্রসঙ্গে বলেন, আমার জন্ম ১৯৫৪ সালের আগস্ট মাসে বৃহত্তর কুমিল্লার চাঁদপুর জেলায়। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পন্ন করি। আমার পড়ালেখার বিষয়ের সাথে যদিও ভাষা-সংস্কৃতির সাথে যোগাযোগ কম তথাপি আমার বাংলা ভাষা ও ঐতিহ্যের প্রতি অদম্য নেশা আমাকে আকৃষ্ট রাখতো। কর্মদক্ষতার প্রসারে দেশ-বিদেশে হিসাববিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক একাধিক পেশাভিত্তিক ডিপ্লোমা নিয়ে আমার অধ্যায়ন জীবনের পরিধি প্রায় ৩৫ বছর।

৪৩ বছরের বিবাহিত জীবনে তিন কন্যা সন্তানের গর্বিত পিতা আমি। কন্যারা সবাই বিবাহিত এবং স্বামী-সন্তানদের নিয়ে টরন্টোতে আছেন। আমার স্ত্রী শুধু আমার জীবনেরই নয়, আমার ব্যবসার সার্বক্ষণিক সঙ্গিনী। আমার স্মরণীয় মুহূর্ত যখন বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করি এবং ‘কাজীর সামনে কবুল বলা।’ আরেকটি স্মরণীয় ঘটনা ‘পিতা-মাতার মৃ্ত্যু শোক।’

আমার অবসর মেলে খুব কম। আমার মতে অবসর হলো এককথায় আগামীকালের জন্য মগজ ধোলাই। পছন্দের সাহিত্যিকদের বিষয়ে বলেন, দুই বাংলার প্রায় সব লেখকই আমার প্রিয়। তবে সবার লেখাই যে আমার সমান ভালো লাগে এমন নয়। রম্য লেখা বেশি আকৃষ্ট করে। আগ্রহের তালিকায় আছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, জসিমউদ্দিন, আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ প্রমুখ। ভ্রমণ, শপিং আর ভালো কোনো বই সংগ্রহ করে অন্যকে পড়ানো আমার শখ বলতে পারেন। অদূর ভবিষ্যতে কানাডার বাংলা সাহিত্য অনুরাগী এবং সংস্কৃতি প্রেমীদের সহযোগিতায় টরেন্টোতে একটি বাংলা পাঠগার প্রতিষ্ঠা করা আগামীর কর্ম পরিকল্পনা। 

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রকাশনা এবং গবেষণা সম্পর্কে তার মতামত ‘মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গবেষণা অবশ্যই হচ্ছে। তবে বাস্তবতা হলো এক্ষেত্রে প্রকৃত গবেষণার চেয়ে অনেক লোক দেখানো বা রাজনৈতিক প্রভাবযুক্ত হয়ে পড়ছে। যা আমার বিবেচনায় সঠিক দিক নির্দেশনা বিহীনউদ্যোগ। মহান মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নিরপেক্ষ এবং নির্মোহ দেশাত্মবোধের অবস্থান হতে কাজ করতে হবে। 

প্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, আমার প্রাপ্তির অভিজ্ঞতায় কঠোর বাধা এবং উৎসাহ দুটোই ছিল। বাংলা বইকে কানাডায় মূলধারায় বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে আজকের গ্রহণযোগ্য স্থানে নেবার অভিপ্রায়ে আমাকে প্রচুর কাঠখড়ি পোড়াতে হয়েছে। কানাডায় হাজার হাজার ডলার ভর্তূকি দিতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। তবে আমার শখ বা দেশপ্রেম দুই কারণে কোনো বাধাই আমাকে দমিয়ে রাখতে পারছে না এবং হাল ছাড়িনি। 

একটি ভালো বই আমাদের পরিশুদ্ধ মনন গঠন এবং বিশুদ্ধ চিন্তা করতে শেখায়। এই বোধকে সামনে রেখেই আনোয়ার দোহা টরেন্টোতে অগ্রসর হয়েছেন। টরেন্টো সংক্ষিপ্ত সফর এবং আনোয়ার দোহার দোকানে যখনই গিয়েছি, তিনি উষ্ণ আন্তরিকতায় ও পারিবারিক আতিথ্য আমাদের ভরিয়ে রেখেছেন। আমি লিখি তা অবগত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের পাঠ ও কেনার নির্দেশনা ও বই উপহার দিয়েছেন। 

আমাদের আলাপচারিতায় অমায়িক সদালাপী এবং দেশপ্রেমিক এই প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব অনর্গল বলেছিলেন বাংলাদেশের অশ্রুত ইতিহাসের মূল্যবান বিভিন্ন দিক। কানাডায় বাংলা ভাষা ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে হৃদয়ে ধারণ করে শ্রদ্ধাভাজন আত্মপ্রত্যয় দীপ্ত এই ব্যক্তিত্বের উদ্যোগ সুদীর্ঘ সফলতা লাভকরুক। আনোয়ার দোহার কানাডার মূলধারায় বাংলা বইয়ের দীর্ঘ পথযাত্রায় মাঝে মধ্যেই এটিএন মেগাস্টোর গ্রন্থনীড়ে কানাডায় বসবাসরত এবং কানাডায় সফরকারী বাংলা ভাষা সাহিত্যের অনেক কালজয়ী সাহিত্যক, সাংষ্কৃতিক ও গুণীজনের মিলন মেলায় পরিণত হয়। আর কানাডার বাংলা সাহিত্য, ইতিহাস অনুরাগী পরবাসী পাঠক-লেখকসহ অভিবাসী পাঠক খুঁজে পায় দেশের স্বকীয় আত্মপরিচয় সমৃদ্ধ চিন্তার আনন্দেলোক। কোভিড মহামারিকালীন কানাডায় বাংলা বইয়ের ক্রেতা সংখ্যা কিছুটা হ্রাস পেলেও আনোয়ার দোহা দমে জাননি।

কানাডা ও উত্তর আমেরিকার প্রবাসী বাঙালিরা তার প্রতিষ্ঠান থেকে বই কিনে বাংলা ভাষী ও বাংলাদেশিরা তাদের জাতিগত আত্মপরিচয় জাত চিন্তার উত্তরণ ঘটিয়ে আনোয়ার দোহার অনন্য উদ্যোগের পাশে থাকবেন সেই প্রত্যাশা আমাদের সবার। 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর