বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

আইএমএফের ঋণ ও বাংলাদেশের অর্থনীতি

প্রকৌশলী আব্দুল্লা রফিক
প্রকাশিত: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:২৯ পিএম

শেয়ার করুন:

আইএমএফের ঋণ ও বাংলাদেশের অর্থনীতি

বাংলাদেশ সরকার সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে আইএমএফ (IMF) কাছে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের আবেদন করেI প্রথমে স্টাফ লেভেলের প্রতিনিধি বাংলাদেশে এসে সরকারের অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে মিটিং করে প্রাথমিক সবুজ সংকেত দিয়ে যায়। ১৩ জানুয়ারি শেষ হওয়া স্টাফ মিটিং থেকে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য একটি শক্তিশালী মজবুত যুক্তিসঙ্গত ‘টেকসই ঋণ পর্যালোচনা’ রিপোর্ট তৈরি করে আইএমএফের বোর্ডে বিবেচনার জন্য দেওয়া হয়।

সেই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে জানুয়ারির মাঝামাঝি আইএমএফের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর অন্তনিয়েট সায়া বাংলাদেশে আসেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশের ব্যাংকের গভর্নরসহ আরও অনেকের সঙ্গে মিটিং করেন। এ সময় তিনি স্টাফ মিটিং থেকে দেওয়া রিপোর্টকে কার্যকর এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে পজিটিভ মন্তব্য করেন।


বিজ্ঞাপন


তিনি গত দশকের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক খাতের ব্যাপক উন্নতির প্রশংসা করেন। এর ফলে বাংলাদেশের দারিদ্র বিমোচন ও সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার উন্নতি সাধন করে, সরকারের সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি, অনেক কম ‘ঋণ-জিডিপি’ অনুপাত, পর্যাপ্ত বাহ্যিক বাফার জোনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। তখনই ধারণা করা যাচ্ছিল আইএমএফ বোর্ড বাংলাদেশ সরকারের চাওয়া ঋণ অনুমোদন দেবে।

তারপর আইএমএফ বোর্ড তাদের ৩০ জানুয়ারির মিটিংয়ে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের অনুমোদন দেয়। এই ঋণ সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে দেবেI আইএমএফের বর্ধিত তহবিল সুবিধা (Extended Fund Facility), বর্ধিত ক্রেডিট সুবিধা (Extended credit Facility) থেকে ৩.৩ বিলিয়ন ডলার এবং আইএমএফের নতুন তৈরি করা স্থিতিস্থাপকতা ও টেকসই তহবিল (Resilience and Sustainabilty Facility) থেকে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম দেশ হিসাবে ১.৪ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পায়।

এই ঋণের মধ্যে আইএমএফের ‘বর্ধিত তহবিল সুবিধা, বর্ধিত ক্রেডিট সুবিধা’ থেকে পাওয়া ৩.৩ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করবে, ভঙ্গুরতা থেকে রক্ষা করবে, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সবুজ প্রবৃদ্ধিকে মজবুত করবে। আর ‘স্থিতিস্থাপকতা ও টেকসই তহবিল’ থেকে ১.৪ বিলিয়ন ডলার পাওয়া ঋণ অতিরিক্ত তহবিল হিসাবে অর্থনীতির বিভিন্ন ছিদ্র পূরণে সাহায্য করবে।

কেন বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে ঋণের জন্য আবেদন করে


বিজ্ঞাপন


করোনা মহামারির পর বাংলাদেশ ধীরে ধীরে খুব ভালোভাবেই অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করছিল, হঠাৎ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সারা পৃথিবীর অর্থনীতিকে টালমাটাল করে তোলে, সরবরাহ চেইন নষ্ট হয়ে যায়।

এ সময় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী হয়ে যায়, বাংলাদেশি টাকার মান কমে যায়, আমদানি ব্যয় বেড়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে শুরু করে, কারেন্ট একাউন্ট ডেফিসিট শুরু হয়, সাথে সাথে রফতানি আয় কিছুটা কমে যায়, রেমিট্যান্স কমতে থাকেI তখন বাংলাদেশ সরকার সতর্কতামূলক অনেক পদক্ষেপ- যেমন ধনীদের ব্যবহার্য জিনিসপত্রের উপর আমদানি নিষেধাজ্ঞা দেয়, রফতানি বাড়ানোর জন্য প্রণোদনা তহবিল গঠন করে, রেমিটেন্স বাড়ানোর জন্য ২.৫% হারে প্রণোদনার ব্যবস্থা করে।

সরকার সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে অর্থনীতির জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঠিক রাখা, প্রাইভেট বিনিয়োগ আকর্ষণ, প্রোডাক্টিভিটি বৃদ্ধি, স্থিতিস্থাপক মজবুত পরিবেশ বজায় রাখার জন্য আইএমএফের কাছে ঋণের জন্য আবেদন করে যা প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতায় বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত।

আইএমএফের শর্তাবলী

অভ্যন্তরীণ রেভিনিউ সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য ন্যাশনাল বোর্ড অফ রেভিনিউ (NBR) বিভিন্ন নীতি এবং কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ জিডিপির তুলনায় জাতীয় রাজস্ব আয় অনেক কম, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্নI এটা আসলে একটি চলমান প্রক্রিয়া, আর্থিক খাত পুনর্গঠনের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ম্যানেজমেন্ট গঠন করতে হবে যারা অত্যন্ত দক্ষতা ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে পাবলিক ফিন্যান্স, ইনভেস্টমেন্ট, ঋণ খাত পরিচালনা করতে পারবে, এটাও একটা চলমান প্রক্রিয়া।

পাবলিক সেক্টরের ভঙ্গুরতা কমাতে হবে, তদারকি বাড়াতে হবে, শক্ত রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করতে হবে, শক্তিশালী ক্যাপিটাল মার্কেট তৈরি করতে হবেI কাঠামো পুনর্গঠনের মাধ্যমে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি ও বাণিজ্য বৃদ্ধি করতে হবে। ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (FDI) বাড়াতে হবেI ধনীদের উপর থেকে সাবসিডি কমাতে হবে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব ইনভেস্টমেন্ট করা অংশ বাদ দিয়ে করতে হবে, যেটা কোনোভাবেই সমস্যা তৈরি করবে না। কারণ এটা তো জাস্ট একটা নাম্বার যা মানুষের মনস্তত্বের উপর প্রভাব ফেলেI এর মধ্যে কোনো জটিল শর্ত আছে বলে আমার মনে হয় না।

বাংলাদেশের জন্য ভয়ের কিছু আছে কিনা

২০২৬ সালে বাংলাদেশের নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে গ্রাজুয়েশন হবে এবং ২০৩১ এর মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার টার্গেট নিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আর এর জন্য পর্যাপ্ত অর্থের দরকার।

ঋণ নেওয়াতে কোনো সমস্যা নেই, যদি যেসব প্রজেক্ট এ ঋণ নেয়া হচ্ছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সেগুলোর ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়I প্রত্যেকটা প্রজেক্ট শেষ হওয়ার পর ওই প্রজেক্টের ইনকাম দ্বারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঋণ শোধ হবে আবার ওই প্রজেক্টের মাধমে প্রচুর কর্মসংস্থান হবে, জি ডি পি আকার বেড়ে যাবে, মানুষের ইনকাম বেড়ে যাবেI এগুলো অর্থনীতির চলমান প্রক্রিয়াI কেউ কেউ হয়তো না বুঝে অথবা ইচ্ছাকৃত সাধারণ মানুষের ধারণার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলার চেষ্টা করে, তবে এগুলো খুব কার্যকর হবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়ন দৃশ্যমান।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সাহসী চিন্তার ফসল হিসেবে নেওয়া প্রজেক্টগুলোর কারণে বাংলাদেশের জিডিপি আকার আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী ৪৬০ বিলিয়ন ডলার। যেটা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার গঠনের সময় ছিল মাত্র ৯০ বিলিয়ন ডলার। এই ১৪ বছরের শাসনামলে মধ্যবিত্ত থেকে একটা বড় অংশ উচ্চবিত্তে ধাবিত হয়েছে, যেটা বাংলাদেশে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমানI আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকার মতো বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদারদের মতে এখন পর্যন্ত ‘ঋণ ও জিডিপি’র অনুপাত যেখানে আছে তাতে ‘রিস্ক’ এর কিছু নেই I কাজেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে বলেই আমার বদ্ধমূল ধারণা।

লেখক: প্রকৌশলী আব্দুল্লা রফিক, প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ কানাডা অ্যাসোসিয়েশন অফ ক্যালগেরি

/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর