শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

কোনো এক একুশে ফেব্রুয়ারিতে

ক খ হাসান
প্রকাশিত: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:৪১ পিএম

শেয়ার করুন:

কোনো এক একুশে ফেব্রুয়ারিতে

এবারের শীতটা যেন যেতেই চাচ্ছে না যদিও বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী মাঘ মাস প্রায় শেষই বলা চলে। তপু ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে মাঘের শেষ দুই সপ্তাহ বা ইংরেজি পঞ্জিকায় ফেব্রুয়ারি এলেই সমগ্র দেশ উঠে পড়ে লাগে 'বাংলা মাতৃভাষা দিবস' বা ইদানীংকালের 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' পালনে কে কতটা বাংলা ভাষাকে ভালোবাসে তা জনসম্মুখে প্রমাণ করতে। কিন্তু এবারের শীতের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি তরুণ যুবাদেরকে পাঞ্জাবী আর তরুণীদেরকে শাড়ী পরিধানে কেন যে বেরসিকের মত আচরণ করছে কে জানে! তবুও যথাসময়ে ৮ই ফাল্গুন বা একুশে ফেব্রুয়ারি জাতির জীবনে দিনক্ষণ মেপে আবারো উপস্থিত হলো। দিনের প্রথম প্রহর থেকে চলছে শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হাজারো নারী-পুরুষের আসা-যাওয়া আর '৫২'র ভাষা শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে পুষ্প অর্পণ। যদিও তপু সবসময়ই চেষ্টা করে শহীদ মিনারে প্রথম প্রহরে যেতে কিন্তু রিমার সাথে সম্পর্কের পর থেকে ওর সময়সূচিতে বেশ পরিবর্তন হয়েছে। সাম্প্রতিক বছর গুলোতে ও রিমার সাথী হয়ে সূর্য উদয়ের পরপরই শহীদ মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করে থাকে। আজ শহীদ মিনারের কার্যক্রম শেষে রিমা বলল-

'তপু, যদি তোমার হাতে কোনো কাজ না থাকে তবে চল না নদীর ধার দিয়ে ফাগুনের এই শিশির ভেজা ঘাসে একটু হাঁটি?'


বিজ্ঞাপন


এর আগে তপু কখনই রিমার সাথে সাতসকালে হাঁটার সুযোগ পেয়েছে কিনা মনে করতে পারল না। আর তাই এ সুযোগ সে সাথে সাথে লুফে নিয়ে বলল-

'আরে কি যে বল? আমার সময়ের কোনো অভাব নেই। তবে আজ আমি মানিব্যাগ আনতে ভুলে গেছি- তাই প্রাতঃভ্রমণ শেষে আমাকে কিন্তু ক্যান্টিনে নাস্তা করাতে হবে।'

ওরা দু'জনে নিঃশব্দে হেঁটে চলেছে। এরই মাঝে রিমা বলল-

'তপু, আজ দেখছি তুমি খুবই চুপচাপ। কিছু কি ভাবছ?'


বিজ্ঞাপন


রিমার প্রশ্নে মনে হল তপু যেন ঋষির ধ্যান থেকে উঠে এল। ও বলল-

'জান, আজ আমার মনে পড়ছে আমার বড় চাচা যিনি একজন ভাষা সৈনিকও ছিলেন তার কথা। আমার ছেলেবেলায় উনার সাথে প্রতিটি ভাষা দিবসে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করার পর ঠিক আজকের মতই আমরা দু'জনা এমনই এই নদীর তীর ধরে হাঁটতাম। উনার মৃত্যুর শেষ কয়েক বছর উনি আমায় প্রায়ই বলতেন আমরা শুধু ভাষা দিবসের মাস এলেই বাংলা বাংলা করে মুখে ফেনা তুলি। অথচ আমরা আজও কুদরত-ই-খুদা কমিশন-এর ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত রিপোর্ট-এর সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষার সকল স্তরে বাংলা চালু করতে পারিনি। আরো পারিনি ১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-এর যথাযোগ্য প্রয়োগ করতে।’

'তোমার বড় চাচাতো দেখছি সত্য কথাই বলতেন। তবে তুমি কি জান কুদরত-ই-খুদা কমিশন উনাদের রিপোর্ট বাংলার পরিবর্তে ইংরেজিতে লিখেছিলেন?’

'আমার এটা জানা ছিল না। কিন্তু তুমি কি জান কেন রিপোর্টটি বাংলায় লেখা হয়নি?’

'আমি জানি না। তবে আমি মনে করি রিপোর্টটি অবশ্যই ইংরেজির পরিবর্তে বাংলায় লেখা হলে ভাল হতো। কারণ এতে করে কমিশনের বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান প্রকাশ পেত।’

‘তবে যে ভাষাতেই রিপোর্ট লেখা হোক না কেন এটা তো আমাদেরকে মানতে হবে যে মাতৃ ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।'

'আমি তোমার সাথে একমত। কিন্তু ১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-এর প্রয়োগের ব্যাপারে তোমার বড় চাচা বোধ হয়'… আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হবে। এই ধারা মোতাবেক কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তাহা হইলে উহা বেআইনি ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।’- এই বিষয়টার ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করতেন, তোমার কি মনে হয়?'

'আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু আমার চাচা আজও জীবিত থাকলে দেখতে পেতেন নিম্ন আদালতে ব্যাপকভাবে বাংলা ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু কি তাই, ইদানীংকালে উচ্চ আদালত একটি আলাদা শাখাও তৈরি করেছে যার প্রধান কাজ হলো বাংলা ভাষায় রায় লেখার পূর্ণ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। এ ছাড়াও তারা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নির্ভর সফটওয়্যার 'আমার বাংলা' প্রবর্তন করেছে যেটা দিয়ে ইংরেজিতে লেখা রায় বাংলায় ভাষান্তর করা যাবে যাতে করে সর্ব স্তরের মানুষ অতি সহজেই বুঝতে সক্ষম হবে।'

'আরে এ সবই তো ভাল উদ্যোগ। তা ভালো কথা, আজ বিকালে তুমি কি করছ?'

'কেন বলতো?'

'আমি ভাবছি আজ বিকালে কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে যে আলোচনা হবে সেখানে যাব। আমি চাই তুমিও আমার সাথে সেখানে যাবে।'

'দেখ রিমা, প্রতি বছরই এ ধরণের অনুষ্ঠানে যাওয়া - আর বক্তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বড় বড় বক্তৃতা শুনতে আমার আর ভাল লাগে না।'

'তুমি দেখছি অল্পতেই হতাশ। এবারের অনুষ্ঠান কিন্তু ভিন্ন রকম হবে।'

'তাই নাকি! তা সেটা কেমন?'

'এবারে মোট পাঁচ জন মূল বক্তা যেমন - আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সাংবাদিক সমিতির সভাপতি, গত বছরের একুশের পদকপ্রাপ্ত একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, স্থানীয় সংসদ সদস্য, আর জেলা প্রশাসক। উনারা প্রত্যেকেই সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট করে বক্তৃতা করবেন। আর উনাদেরকে নিয়েই প্যানেল গঠন করা হবে যেখানে উপস্থিত জনসাধারণ যেকোনো প্যানেল সদস্যকে প্রশ্ন বা মতামত দিতে পারবে আর একজন সঞ্চালক থাকবে সভা সুন্দরভাবে পরিচালনা করবার জন্য।'

'তাহলে তো আমাকেও সেখানে যেতে হবে। এক কাজ করা যাক আমি বিকাল সাড়ে তিনটায় তোমার হলের সামনে থাকব। তুমি নেমে এলেই দু'জনা একসাথে অনুষ্ঠানে যাব- ঠিক আছে?'

ঠিক সময়ে তপু রিমার হলের সামনের গাছতলায় দাড়িয়ে। ও জানে রিমা সময়ের ব্যাপারে খুবই সচেতন। আর তাই ওর দেরী দেখে এক অজানা শঙ্কায় মনটা দুলে উঠল। তবু ভাবল অন্তত মিনিট পাঁচেক তো দেখা যাক - তারপরই না হয় রিমাকে মোবাইল করা যাবে। এরই মাঝে তপু দেখল রিমা ওর দিকে এগিয়ে আসছে এক ভিন্নতর রূপে যা কিনা সে আগে দেখেনি। ওর পরনে সুতি আর সিল্কের মিশ্রণে তৈরি সাদাপাড় লাল জমিন শাড়ি যার সারা জমিনে কালো হরফে লেখা অ-আ-ক-খ সহ বর্ণসমূহ যা তপুকে মুহূর্তের মধ্যে শিশুকালে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। রিমা একেবারে তপু কাছে এসে পৌঁছে ওকে হালকা একটা ধাক্কা দিয়ে বলল-

'কি ব্যাপার, তুমিতো দেখছি মাছের মতো পলকহীন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছো?'

'আসলে, তোমাকে দেখে আমি মুহূর্তেই প্রাথমিক স্কুলের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র হয়ে গিয়েছিলাম।'

'শোন, ফাজলামি বাদ দাও। চল এবারে যাওয়া যাক।'

'অবশ্যই, আমাদের তাড়াতাড়ি রওনা হওয়া দরকার। কিন্তু তার আগে বল, তুমি যদি আগে আমায় বলতে আমিও তোমার মত একটা বর্ণমালাময় পাঞ্জাবি কিনতে পারতাম!'

'সব কথা আমাকে কেন বলতে হবে? ভাষা দিবসের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তো তুমি এটা করতে পারতে, তাই না?'

'যাক বাবা, আমায় মাফ করো। তোমার সাথে কথায় পেরে ওঠা খুব কঠিন কাজ! আর আমিতো ভেবেছিলাম হেটেই মিলনায়তনে যাব। কিন্তু তোমার সাজ দেখে মনে হয় না তুমি হেটে যেতে পারবে।'

'তুমি ঠিকই বলেছ, চল একটা রিকশা নিয়ে নেই।'

রিমা আর তপু যথাসময়ে সভাস্থলে পৌঁছে দেখল মিলনায়তন লোক সমাগমে ভরপুর। রিমাদেরকে অবাক করে দিয়ে মূল বক্তারা সভা শুরুর মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যেই তাদের বক্তব্য শেষ করে ফেলল। তাই শুরু হয়ে গেল উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের প্রশ্ন আর মতামতের পালা। আজকের সভার এই ধরণটা প্রায় প্রতিটি প্রশ্ন ও মতামতদানকারীই প্রশংসা করেই কথা প্রকাশ করছিল। আলোচনার এক পর্যায়ে একজন প্রশ্নকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়কে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করলেন-

'স্যার, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞান, চিকিৎসা, কৃষি, আর প্রকৌশল শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগই ইংরেজি ভাষায় রচিত পাঠ্যপুস্তক ব্যবহার করা হয়। এ সমস্যার কি কোনো সমাধানই নেই?'

উত্তরে উপাচার্য মহোদয় বললেন-

'বাংলা ভাষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তক ব্যবহারে বেশ কতগুলো বাধা রয়েছে। প্রথমত, উপযুক্ত শব্দকোষ গঠন - এ ক্ষেত্রে আমরা বাংলা প্রতিশব্দের খোঁজাখুঁজি বাদ দিয়ে বৈজ্ঞানিক শব্দাবলী সরাসরি গ্রহণ করতে পারি। যেমন আমরা গ্রহণ করেছি ম্যালেরিয়া বাটাইফাইড -এর মত শব্দ। এটা করতে পারলে আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক জার্নালগুলো থেকে তথ্য আর উপাত্ত যাচাই-বাছাই করা সহজ হবে। এছাড়াও তারা পরবর্তীতে উচ্চতর শিক্ষা বা গবেষণায় বিদেশে গেলে মূল শব্দের ভাষান্তরের পিছনে সময় ব্যয় করতে হবে না। দ্বিতীয়ত, আমাদের উচিত আমাদের অধ্যাপক বা বিজ্ঞানীদেরকে বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনায় উদ্বুদ্ধ করা। যেমন বেতন বৃদ্ধি বা পদোন্নতিতে এ ধরণের কার্যকলাপকে মূল্যায়ন করা। তৃতীয়ত, প্রকাশকদেরকে উৎসাহিত করা পাঠ্যপুস্তক প্রকাশে- তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে কপিরাইট আইন সঠিকভাবে মানতে হবে। যেমন ব্যাপকভাবে বই ফটোকপি করা যাবে না। কারণ, এটা করলে বই প্রকাশনার ব্যয় প্রকাশকেরা উঠাতে ব্যর্থ হবে।'

আলোচনার এ পর্যায়ে একজন সাংবাদিক উপাচার্য মহোদয়কে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বললেন-

'আমার মনে হয় আমরা বর্তমান সময়ের বই প্রকাশনার মডেল যেমন 'ওপেন এডুকেশনাল রিসোর্সেস'কেও গ্রহণ করতে পারি। এ ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বই প্রকাশের প্রাথমিক ব্যয় বহন করতে পারে। আর এরপর অনলাইন সংস্করণ প্রকাশ করলে আর কোনো অর্থের দরকার হবে না।'

সভায় অনেকেই কথা বলতে চাই সেই সাথে রিমাও। তবে রিমাকে অবশ্যই ভাগ্যবতী বলতে হয়। কারণ, সে 'ওপেন এডুকেশনাল রিসোর্সেস' সম্পর্কে একটা সম্পূরক প্রশ্ন করবার সুযোগ পেল। সে বলল-

'সাংবাদিক সাহেব, আপনার মতামতটি মনে হচ্ছে আমাদের জন্যে উপকারী হতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে যদি আপনি আর একটু খোলসা করে বলতেন?'

উত্তরে সাংবাদিক সাহেব বললেন-

'এ ব্যাপারে সবচেয়ে দরকারি বিষয় হল কপিরাইট লাইসেন্স। যেকোনো ওপেন এডুকেশনাল রিসোর্সেস-এর ক্ষেত্রে ক্রিয়েটিভ কমন্স নামের এক ধরণের পাবলিক কপিরাইট লাইসেন্স ব্যবহার করা হয় যা কিনা অন্যদেরকে কারো লেখার কপি, বিতরণ, পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং ক্ষেত্র বিশেষে বাণিজ্যিক উৎপাদন করবার অনুমতি দেয়। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে হলে আমি আপনাদেরকে ক্রিয়েটিভ কমন্স-এর ওয়েবসাইট পড়তে অনুরোধ করব।'

সামনের দিকের সারিতে বসা একজন বিদেশী মাঝবয়সী সালোয়ার কামিজ পরিহিতা নারী বেশ কিছুক্ষণ ধরেই চেষ্টা করছিল সঞ্চালকের দৃষ্টি আকর্ষণের। তাকে বলবার সুযোগ দিতেই ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন-

'আমি একজন জাপানিজ নাগরিক। আপনাদের দেশে একটা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় জাপানিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কাজ করছি গত কয়েক বছর ধরে। এ দেশে আপনাদের মাতৃভাষার প্রতি সম্মান দেখে আমার ভীষণ ভাল লাগে। সত্যি বলতে কি মাতৃভাষায় জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা করেই পৃথিবীর অনেক দেশই শিল্পোন্নত হয়েছে - যেমন জাপান, জার্মানী, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ আরো অনেক দেশ। তাই আমি বলব আপনারা মাতৃভাষায় জোর দিবেন - আপনারাও একদিন উন্নত জাতি বা দেশ হিসাবে পৃথিবীর বুকে আত্মপ্রকাশ করতে পারবেন বলে আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি।'

জাপানিজ নারীর মতামতের পরই সঞ্চালক জানতে চাইলেন এ ব্যাপারে আর কারো কোনো বক্তব্য বা মন্তব্য আছে কিনা। কেউ কিছু বলছে না দেখে তপু কথা বলবার এই সুযোগটা গ্রহণ করল। ও জাপানিজ নারীর উদ্দেশে বলল-

'আপনার আমাদের দেশীয় ধরণের পোশাক আর মাতৃভাষার প্রতি আপনার ভালোবাসা দেখে আমার ভাল লেগেছে। তবে আপনারা কি বিদেশী অন্য কোনো ভাষা যেমন ইংরেজি শেখেন না?'

উত্তরে জাপানিজ নারী আবারো ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন-

'কি যে বলেন না? বেশ কিছু বছর হল জাপানের স্কুল গুলোতে ইংরেজি বাধ্যতামূলক বিষয় হিসাবে পড়ানো হয়ে থাকে।'

আলোচনা সভা শেষে ওরা বাহিরে বেরিয়ে আসতেই দেখল সূর্য পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়তে শুরু করেছে। তপু রিমাকে কিছু একটা বলতে যাবে আর তখনই রিমা বলে উঠল-

'আচ্ছা, তপু আজ সভাতে আমাদের উপাচার্য মহোদয় আর বিজ্ঞ সাংবাদিক যা বললেন আমার তো মনে হয় খুব সহজেই আমরা এগুলোর বাস্তব রূপ দিতে পারি, তাই না?'

'অবশ্যই, আর সেটাইতো দেশমাতৃকার কাছে আমাদের আজকের দিনের প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত' - ধীর কিন্তু স্থির কণ্ঠে তপু বলে উঠল।

মিনিট কয়েক হাটতেই ওরা মিলনায়তনের পশ্চিম পাশের খোলা ময়দানের প্রান্তে এসে পৌঁছাল। আর রিমা কিশোরী বালিকার মত বলে উঠল-

'দেখো দেখো- ময়দানের মাঝখানটাতে আমাদের ক্যাম্পাসের নিয়মিত চটপটির বুড়ো চাচা আজ এখানে চটপটি বিক্রি করছে।'

'তাই তো। তুমি নিশ্চয় চটপটি খেতে চাও, তাই না?'

'সেটা কি আর বলতে?'

ওরা মনোযোগ সহকারে চটপটি খেয়ে চলেছে। হঠাৎই রিমা বলল-

'আমার না মাথায় একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আচ্ছা, আমরাও কি ঢাকার 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা'র মতো প্রতি বছর ভাষার এই মাসে আমাদের ক্যাম্পাসে ছোট পরিসরে বইমেলার আয়োজন করতে পারি না?'

'অবশ্যই, কিন্তু একই মাসে বইমেলার আয়োজন করলে আমার মনে হয় না ঢাকা থেকে কোনো প্রকাশনা সংস্থা এখানে আসবে।'

'তাহলে কিছুই কি করার নেই?'

'আমার মনে হয় আমরা ফেব্রুয়ারি মাসকে বাদ দিয়ে মার্চ মাসের শেষ দুই সপ্তাহে 'ভাষা ও স্বাধীনতা বইমেলা' নামে একটা উদ্যোগ নিতে পারি।'

'এটা খুবই ভাল প্রস্তাব। আমরা আমাদের ছাত্র সংসদের সদস্যদের সাথে এটা নিয়ে আলোচনা করতে পারি, তাই না?'

ওদের চটপটি খাওয়া শেষ হতে না হতেই রিমা তপুকে বলল-

'আমার না কেন জানি এখনই হলে ফিরতে ইচ্ছা করছে না। চল না ঘাসের উপর একটু বসি।'

তপুও মনে মনে এমনটাই ভাবছিল আর ওরা উভয়েই ঘাসের উপর বসে পড়ল। এরই মাঝে ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বন্ধু-বান্ধবী যেন হাওয়া থেকে উদয় হয়ে গোল হয়ে একত্রে বসে পড়ল। তপু ওদের উদ্দেশে বলল-

'আমরা কিন্তু তোদেরকে আজকের আলোচনা সভায় দেখেছি। কিন্তু বাহিরে বেরিয়ে তোদের কাউকেই আর দেখলাম না।'

ওদের মাঝ থেকে একজন বান্ধবী হাসতে হাসতে বলল-

'তোমারতো নিজেদের মাঝে ভাবের আদান-প্রদানে ব্যস্ত ছিলে তাই অন্য কাউকেই তোমাদের চোখে পড়েনি।'

এবারে ভাব-গম্ভীর স্বভাবের এক বন্ধু বলল-

'আজেবাজে কথা তোরা রাখ তো। তা এবারে বলতো সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের ব্যাপারে দেশে আইন-কানুন আছে কিন্তু ভাষা আন্দোলনের এত বছর পরেও কেন আমরা এর সঠিক প্রয়োগ করতে পারিনি?'

এ প্রশ্নের পর ওদের আড্ডায় কেন জানি ছন্দপতন ঘটল। একটু উসখুস করে রিমা বলল –

'দেখ, এটা সত্যি যে ভাষা আন্দোলনের পর অনেক গুলো বছর পঞ্জিকার পাতা থেকে ঝরে গেছে। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে ওই আন্দোলনের সফলতাই আমাদের স্বাধীনতার মূলভিত্তি। আর আইন-কানুনের কথা বলছ - আমাদের দেশে এটার কোনো অভাব কোনোকালেই ছিল না, হয়ত হবেও না। আমার মনে হয় আমাদের অভাব হল আইনের যথাযোগ্য প্রয়োগের আর জনগণের বিশেষ করে শিক্ষিত সমাজের সদিচ্ছার।'

রিমার কথা পিঠে কেউ যে কিছু বলবে তার আর কোনো লক্ষণই আড্ডার কারো মাঝেই দেখা গেল না।

লেখক: অধ্যাপক ক খ হাসান, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালগারি, কানাডা।

এমএইচটি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর