জানালায় বসে মনের মাধুরী মিশিয়ে তুষারপাতের দৃশ্য দেখছি। রাতের তুষারপাতের দৃশ্য অপূর্ব। পেজা পেজা তুলার মতো আকাশ থেকে তুষার পড়ছে। চারিদিক শুভ্রতায় ছেয়ে গিয়েছে। বাড়িগুলো মনে হচ্ছে শ্বেতপাথর দিয়ে বানানো হয়েছে। শুভ্র তুষার থেকে আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে, অনেকটা জ্যোৎস্নার মতো। এমন পরিবেশে আমার মনে গুনগুনিয়ে বেজে উঠে ‘এমন দিনে তারে বলা যায়.. এমন ঘন বরষায়’। তুষারপাত তো বৃষ্টিই। এ হচ্ছে বৃষ্টির কঠিন রূপ যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে স্ফটিকের আকারে বিরাজ করে। মেঘ হতে নিঃসরিত পানি বায়ুমন্ডলের ওপরের স্তরে নিম্ন তাপমাত্রায় জমে বরফে পরিণত হয় এবং তুষারের আকার ধারণ করে অঝোর ধারায় ভূমিতে পতিত হয়। এমন সুন্দর পরিবেশে ‘উচাটন মন ঘরে রয় না’। উড়ু উড়ু মন, স্ত্রীর ঘুমের ব্যাঘাত হয়, তাই দুরু দুরু বুক নিয়ে এমন সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করছি। ঠিক তখনই বেজে উঠলো মুঠোফোন। ইস! আজ ফোন বন্ধ করতে ভুলেই গিয়েছি। সাধারণত আমি রাত দশটার পর ফোন বন্ধ করে দেই, আজ কিভাবে ভুলে গেলাম?
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের নম্বর। আমাদের এখানে রাত প্রায় বারোটা, তাহলে নিউইয়র্কে তো রাত দুটো। এত রাতে আবার কে ফোন করল! ফোন ধরলাম, ওপার থেকে ভেসে এলো, ভাই কি ঘুমাইবার লইছিলেন? লালমিয়ার কণ্ঠ চিনতে আমার এক মুহূর্ত দেরি হলো না। আমি বললাম, এত রাতে! কোথায় আপনি? সে বলল, অহন নিউইয়র্ক এয়ারপোর্টে, ক্যান এত রাইতে এই হানে হেইডা জিগাইয়েন না। আগে কন আমি অহন কি করুম আর কই যামু! আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, কি করবেন মানে? সে বলল, যারা আমগো এয়ারপোর্ট থন নিয়া যাওনের কথা হ্যারা আহে নাইক্কা, ফোন ভি ধরে না। কিল্লাই মরতে এইহানে আইছিলাম বউ পোলাপান লগে লইয়া। আমি তার বিপদ টের পেলাম বললাম, চিন্তা কইরেন না, এয়ারপোর্ট ও তার আশপাশে অনেক হোটেল আছে। সেখানে রাত কাটিয়ে দেন। যদি হোটেল পেতে কোনো সমস্যা হয় তাহলে আমাকে ফোন করবেন, আর পেয়ে গেলে ফোন করার দরকার নেই। সে বলল, মর জ্বালা। আপ্নে এতদূর থাইক্যা কি করবার পারবেন? উপায় বাৎলাইছেন আপনার কাম ফিনিস অইয়া গ্যাছে গা। অহন ঘুমান।
বিজ্ঞাপন
আমি জানি সে হোটেল পেলেও আবার ফোন করবে। লালমিয়া কথা না বলে এক মুহূর্ত থাকতে পারে না। ফোন করলে করবে, সে নিয়ে আমি মোটেও চিন্তিত না। তার পরোপকারী একটি সুন্দর মন আছে, এমন একজন মানুষের জন্য না হয় কিছুটা রাত জাগলাম।
অনেক আগের কথা। কোনো এক বিশেষ কাজে যাচ্ছিলাম নবাবপুর লালমিয়ার কাছে। পুরোনো ঢাকার আগা-মাথা আমি কিছুই বুঝি না। এত অলিগলি, কোন রাস্তা কোথায় গিয়েছে, আমার কাছে তা এক বিরাট রহস্যই রয়ে গেছে। তবে নবাবপুর, ইসলামপুর এই এলাকাটি আমার পরিচিত। পুরোনো ঢাকার হাজির বিরিয়ানির মতই এ এলাকার রাস্তার যানজট বিখ্যাত। যথারীতি নবাবপুর ঢোকার আগে নবাবপুর রোডে বেশ যানজটের মধ্যে পড়ে গেলাম। এটা ঢাকার নৈমিত্তিক ব্যাপার। ঢাকা শহরে যানজট না থাকলেই ভয় লাগে, মনে হয় কোথাও হয় তো ভাঙচুর হয়েছে, তাই লোকজনের রাস্তায় চলাচল বন্ধ। অনেকক্ষণ রিকশায় বসে থেকে অলসভাবে দোকানের ওপর দিয়ে হাঁটছি, দোকান মানে ফুটপাত। ঢাকায় তো আর ফুটপাত নেই, সবই ভাসমান দোকান। ব্যাঙের মতো লাফ মারতে হচ্ছে মাঝে মাঝে। লম্ফঝম্ফ করতে গিয়ে এক দোকানের পণ্য অসাবধানবশত পা দিয়ে মাড়িয়ে দিয়েছি, অমনি তার খিস্তি শুরু হলো। কানে তুলো গুঁজে হাঁটতে শুরু করলাম। ভাবলাম পথিকের চলার পথ আটকিয়ে তুমি পসরা সাজিয়েছো, এখন পথিকের উপরই চোটপাট!
লালমিয়ার আড়তের কাছাকাছি পৌঁছাতেই কিসের যেন শোরগোল শুনতে পেলাম। বেশ হৈচৈ। গোলাগুলি না হলেও, গালাগালি যে হচ্ছে তা বুঝতে বাকি রইল না। লালমিয়ার সাথে চলতে চলতে এমন অশালীন ভাষা শুনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। এরকম গালাগালির চরম প্রতিযোগিতা অনেকবার শুনেছি। এখন আমার কান আর আপত্তি করে না। বলতে গেলে এটা তারই এলাকা। তারই এক লোক আমাকে চিনতে পেরে দৌড়ে এসে বলল, বাই আহেন, তাত্তারি আহেন। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, কেন? কি হয়েছে? কোনো সমস্যা? সে বলল, আর কইয়েন না, মিঞার মাথা গরম, আপনারে দেখলেই তার মেজাজ ঠান্ডা অইব, বলেই দৌড়ে ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেল। ভিড়ের মধ্যে লালমিয়া গলা উঁচিয়ে কি যেন বলছে। বেশ অকথ্য ভাষায়। এটা ওদের স্বাভাবিক ভাষা। আমাদের কাছে যেটা গালি, লালমিয়াদের কাছে সেটাই বুলি। লোকটি লালমিয়ার কানে কি যেন বলল, সাথে সাথে লাল মিয়ার মেজাজ একেবারে নরম। আমারে দেখে বলল, ভাইজান আইছেন? আপনার লাইগ্যাই তো বইয়া রইছি, আহেন আহেন। তারপর লোকজনের উদ্দেশে বলল, এই মিয়ারা, যার যার কামে যাও। আমি কিছুটা বিব্রত, আমি কি তার কোনো কাজে ব্যাঘাত ঘটালাম?
আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, আর কইয়েন না ভাই। বহুত বিপদের ভিত্রে আছি।
বিজ্ঞাপন
আমি বললাম, আবার কি বিপদ হলো ভাই।
তার বর্ণনায় যা বুঝলাম, তার বেশকিছু পাইকারি ক্রেতা আছে। তাদের মধ্যে জর্জ মিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। তাকে কিছু ব্যংকের ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সে পণ্যের অর্ধেক দাম বাকিতে আর বাকি দাম নগদে পরিশোধ করে বিভিন্ন দোকানে মালামাল যোগান দিত। এভাবে বেশ ভালোই চলছিল। সমস্যা দেখা দিলো তার কিছু দোকান মালিক ব্যবসায় লোকসান খেয়ে রাতের অন্ধকারে ব্যবসা গুটিয়ে চলে যায়। সেখানে জর্জ মিয়া বেশ কিছু টাকার ক্ষতি হয়। তারপরও সে চেষ্টা করছিল যাতে অন্তত ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করতে পারে। কিন্তু কালক্রমে ব্যাংকের ঋণ বেড়ে যাওয়ায় তার অর্থনৈতিক অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। বেশকিছু কিস্তি বাকি পড়ে যায়। ব্যাংক থেকে বেশ কয়েকবার চিঠি দেওয়ার পরও সে চিঠির কোনো জবাব মেলেনি। ব্যাংক থেকে তার সাথে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু সে ফোনের কোনো উত্তর দেয় নাই। সম্ভবত: ভয়ে বা ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করার লজ্জায়। ব্যাংক উপায়ান্তর না দেখে ঋণখেলাপির মামলা করে। আজ পুলিশ এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। সে খবর পেয়ে লালমিয়া দৌড়ে থানায় যায়। হাজত থেকে নিজে জামিন হয়ে তাকে মুক্ত করে আনে।
তারপরের ঘটনা সে বর্ণনা করলো। বলল, ব্যাংকে যাইয়া দেহি সুদে-আসলে বিশ লক্ষ টাকার ঋণ। ম্যানেজাররে এক চোট লইলাম। কইলাম, বড়োলোক চোরেরা আপনাগো শ’ শ’ কোটি টেকা লুটপাট করতাছে, হ্যাগো হ্যাডাম দেহানোর মুরোদ নাইক্কা, খামাখা গরিবের উপ্রে চোটপাট। হ্যার একাউন্ট খোলার সুময় আমিই তো রেফারেন্স আছিলাম, তয় আমারে না জিগাইয়া ক্যান কেস দিলেন? তারপর দেন দরবার কইরা, আমি কিছু টাকা পরিশোধ কইরা আবার কিস্তির ব্যবস্থা কইরা কেইস তোলার ব্যবস্থা কইরা হবায় আইলাম। পাড়ার মান-ইজ্জত আছে না। লাল মিয়ার অন্তর যে কত বড় তা সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম।
নিউইয়র্কে আসার পর থেকে প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেলো লালমিয়ার কোনো ফোন নেই। তার ফোন না পেয়ে ভাবলাম আমার সাথে হয়তো অভিমান করেছে। আমি তার ফোনের অপেক্ষায় থাকি। আমি নিশাচর, তাই মোটামুটি রাত জেগে বই পড়ি। ছেলেবেলায় পড়েছিলাম শিবরাম চক্রবর্তীর রম্যগল্প। ভাবলাম আবার একবার পড়ে দেখি। আমি তার ‘অশ্ব ত্থমা হতঃ ইতি’ রম্যগল্পের পটল রহস্য উদ্ঘাটন করছি, এমন সময় আমার পিলে চমকে উঠল ফোনের কর্কশ শব্দে। টরেন্টোর নম্বর। ওপার থেকে পরিচিত কণ্ঠ, ভাই কি ঘুমাইবার লইছিলেন? বললাম, না। আপনার খবর কি? তারপর তো আর ফোন করলেন না? আপনি ঠিক আছেন তো? আমার কথা শুনে ভানুর মতই লালমিয়া বলে উঠলো, আরে ভাই দম লন, এত্ত প্রশ্নের উত্তর এক লগে ক্যাম্নে দিমু। তারপর বলল, নিউইয়র্ক এয়ারপোর্ট হোটেল বিচরাইবার লাইগ্যা যাইবার লৈছিলাম এমন সময় ফোনে পাইলাম যারা আমগো উঠাইবার আইছিল। তাগো লগে চইল্যা গেছিলাম। সমস্যা অয় নাইক্কা, তাই আপনারে আর বিছরাই নাইক্কা।
বললাম, ঠিক আছে বুঝলাম, কি করছিলেন? সে বলল, আর কইয়েন না বাই, গোসল করমু হেইডাও করবার পারতেছি না। আমি বললাম, কেন, কোনো সমস্যা? এইহানে এমনিতেই গোসল করতে বেজ্জুত ঠ্যাকে, তাও আজ করবার পারলাম না। বললাম, কেন? সে বলল, বেজ্জুত ঠ্যাকে, কারণ আমি বালতিতে গরম পানি কইরা গায়ে ডালি, এই হানে ঝর্ণা দিয়া পানি বাইর অয়, দেখবেন গরম পানি বাইর হইতাছে আবার হঠাৎ ঠান্ডা পানি আইয়া পরে। আবার ঝর্ণার নিচে খাড়াইলে দম বন্দ ওইয়া যায়গা। আর ক্যান করবার পারি নাইক্যা হেইডা পরে কমুনি। ওর কথা মাঝে মাঝে অস্পষ্ট, অনেক লোকজনের কণ্ঠ ভেসে আসছে।
তারপর সে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, একটু খাঁড়ান, আমার একটা জরুরি ফোন আইছে, আমি আপনারে আবার ফোন করতাছি। আমি তার কথায় নিজের অজানতেই বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। লালমিয়ার জরুরি ফোন ব্যাপার কি!
লালমিয়া বেশি সময় নিলো না। ফোন করে বলল, আপ্নে কি যে একখান নেশা ধরাইছিলেন, হেই নেশা আর ছাড়বারই পারলাম না। আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি আবার কি নেশা ধরাইলাম? সে বলল, শেয়ারের কতা বুইল্যা গ্যাছেন গা? আমি বললাম, ও তাই বলেন। তা শেয়ারের অবস্থা কি? সে বললো, লাভ-লোকসান লইয়া বালাই আছি, ছাড়বার পারতাছি না, ফুটবল খেলার নেশার মতন।
সে বলল, যাউকগা, যে বিষয় লইয়া আপনার লগে কতা কইবার চাই তা হলো, আইচ্যা একটা বিষয় আমার মগজে কিছুদিন হয় ঘুরপাক খাইতাছে। আমি বললাম, কি বিষয়? সে বলল, আইচ্যা আপনি এইহানের সিটিজেনশিপ লৈছেন, আপনি ওইলেন গিয়া বাংলাদেশি কেনেডিয়ান। যারা আম্রিকায় থাহে, হ্যারা বাংলাদেশি আম্রিকান। আইচ্যা, কনসেন দেহি কোন বাঙালি হ্যারা জিন্দেগিতে বিদেশ যাই নাইক্যা তারা ক্যামতে অন্য দ্যাশের নাগরিক? তার প্রশ্নের আগামাথা কিছুই বুঝলাম না। বললাম, পরিষ্কার করে বলেন কি বুঝাতে চাচ্ছেন? সে বলল, আইচ্যা, জিমুন মনে করেন বাংলাদেশি আর্জেন্টিয়ান, বাংলাদেশি ব্রাজিলিয়ান হ্যাগো কথা কইতাছি।
আমি বললাম, এবারও বুঝলাম না আপনার কথা, বুঝিয়ে বলুন। এইবার সে বলল, যে হগল বাঙালি বিশ্বকাপ ফুটবল খেলায় আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল কয়া চিল্লাইবার পারে হ্যাগো কথা কইতাছি। হ্যাগো গাইটের পয়সা খরচ কইরা আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের ফেলাগ বানাইয়া ফাল পারতাছে হ্যাগো কথা কইতাছি। ইমন আহাম্মক আমি জিন্দেগিতে দেহি নাই ক্যা। আমি বললাম, এটা তো তাদের একটা আনন্দ। চার বছর পর পর একটু আনন্দ উল্লাস করা। আমার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল, বুঝলাম, তয় হ্যাগো পতাকা লইয়া ফাল্লানের কি অইছে। হ্যারা যে দ্যাশ সাপোর্ট করতাছে হজ্ঞল পেলেয়ার গো নাম ভি কইবার পারব না। আমাগো দ্যাশে একখান কতা আছে, আহাম্মক লম্বর দুই, অন্যের পুকুরে ছাড়ে রুই।
এই আম্রিকা ক্যানাডায় আইসাও দেখতাছি হ্যারাই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা কইয়া ফাল পারতাছে। হ্যাগো নিজেদের দ্যাশ ক্যানাডা -আম্রিকা কইলাম খেলতাছে, তারপরও হ্যারা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা কইয়া লাফাইতাছে, কিমুন লাগে কনচেন দেহি। হ্যাগো পিরানের ভিত্রে মনে কয় চোটকার পাতা হান্দাইয়া দিচে। তাই খাওজানির চোটে খালি ফাল পারতাছে। তার কথায় প্রাণ খুলে হেসে উঠলাম।
হ্যাগো ফাইগানি দেইখ্যা আমার গায়ে জ্বালা করে, কনছেন দেহি কি করন যায়? তার কথা শুনে অতীতে ফিরে গেলাম, বিশ্বকাপ খেলার সময় আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পতাকায় বাংলাদেশ ছেঁয়ে যায়। প্রতিটি বাড়ির ছাদে দুই দেশের পতাকা। অথচ কোনোদিন ভুলেও তাদের বাংলাদেশি পতাকা টাঙাতে দেখিনি। আমার চোখের সামনে সে দৃশ্য স্পষ্ট হলো। লালমিয়া বলল, আছেন না গ্যাছেনগা ভাই। আমি বললাম, হা আছি, আপনার কথাগুলিই ভাবছিলাম। আচ্ছা আপনি ফুটবল পছন্দ করেন না? সে বলল, আবার জিগায়, করুম না কিল্লাই, খুব পছন্দ করি তয় যে ভালো খেল দেহাইব আমি কইলাম তারই দলে। আমি বললাম, তাহলে কাতার গিয়ে খেলা দেখে তারপর নর্থ আমেরিকা বেড়াইয়ে যেতে পারতেন। সে বলল, ভাইরে, কাতার নিয়া আমার সংসারে যে হিস্টরি পয়দা অইছে, হেই হিস্টরি কইবার সুরু করলে এ জিন্দেগি পার ওইয়া যাইবগা। বাদ দ্যান।
তারপর বলল, ভাবনের কাম কি? কিছু একটা করণের দরকার। আমি বললাম, যাদের চেতনা নাই তাদেরকে কিভাবে বোঝানো যাবে বলেন? সে বললো, চলেন এক কাম করি, ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা গুইরা আহি। আমি বললাম, হঠাৎ ওখানে যাবার শখ হলো কেন?
সে বলল, হুনেন এই লালমিয়া বিনা কামে কুনোহানে যায় না। আমি বললাম, তাহলে সে দেশে কি কাজে যাবেন, ব্যবসার কাজে? সে উৎফুল্ল হয়ে বলল, হ এক্কেরে ঠিক কৈছেন ব্যবসা করুম।
বললাম, ওদের দেশে কিসের ব্যবসা করবেন। সে বলল, আদম ব্যবসা। আমি অবাক হয়ে বললাম, ওরা তো নিজেরাই বেকার সমস্যায় আছে, বাহির থেকে শ্রমিক আমদানি করার তো কোনো দরকার নাই। সে বলল, হুনেন বুদ্ধি খাটাইতে হইব। ওই দ্যাশের সরকারদের বুজাইতে অইব, আমাগো দ্যাশে কিছু উজবুক জনগণ আছে, হ্যাগো যদি তোমাগো দ্যাশে লইয়া আইবার পারো তয় কেল্লাফতে। আমি বললাম, কেল্লাফতে মানে?
সে বললো, এই সব ব্যাকুবরা যাগো সাপোর্ট করে হ্যারা তো হেইডা জানে না। তাই হ্যাগো নাগরিকত্ব দিব হ্যাগো দ্যাশের, তাইলে হ্যাগো পেলেয়ারদের মনোবল আরো বাইরা যাইবগা। আর তাগো চ্যাম্পিয়ন কেহই ঠেকাইবার পারবনা কইলাম। হ্যাগো সাপোর্টাররা যাইতে পারলে আমাগোও কিছু ব্যবসা অইলো, কি কন? আমি বললাম, আমরা মানে? আপনার কি আরও কোনো পার্টনার আছে না কি! সে বলল, কি যে কন মিয়াবাই, জিন্দেগিতে পার্টনারশিপে ব্যবসা করি নাইক্কা। আপনারে লগে লমু চিন্তা করছিলাম। টাকা-পয়সা আমার আর বুদ্ধি পরামর্শ আইপনের। আমি বললাম, ভাইরে আমার এমন ব্যবসার কোনো ইচ্ছা নাই। লালমিয়ার সাথে কথা বলার শুরুতেই, তার ফোনে অনেক মানুষজনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল। অনেকক্ষণ ধরে ভাবছিলাম তার কারণ জিজ্ঞেস করব কিন্তু সে এত কথা বলছে যে আমি সুযোগই পাচ্ছি না।
আমি বললাম, আপনার বাড়িতে কি অনেক মেহমান? এত লোকজনের কথা শোনা যায়? সে বলল, না রে ভাই আমি লিফ্টের সামনের করিডোর থাইক্যা আপনের লগে কতা কইতাছি। আমি বললাম, এতক্ষণ ওখান থেকেই কথা বলতেছেন! তা ওখানে কেন? তার কণ্ঠ প্রায় বাষ্পরুদ্ধ, বলল, আর কইয়েন না ভাই। গিন্নির লগে ক্যাচাল বাজছে। আমি কোনো কথা বললাম না, নাজুক পরিস্থিতিতে চুপ থাকাই ভালো।
আইজ সক্কালে নাস্তার পর চা খাইতে খাইতে টেলিভিশনে নজরুল সংগীত হুনতাছিলাম। ইমুন সুময় আমার গিন্নি কইতাছিল নজরুল ইসলাম কি সুন্দর পেরেমের গান লিখছে। হুনছি তিনি নরম দিলের মানুষ আছিলেন, তাই অনেক পেরেম ভি করছেন। আমি কইলাম, কি কও গিন্নী! তয় তো দেখতাছি আমার লগে তার মিল আছে, আমিও কইলাম নরম দিলের মানুষ। ব্যাস, আমার মুখেত্থন কতা বাইর অয় নাইক্কা, আমার আতকা ধাক্কা মাইরা বাইর কইরা দরজা বন্দ কইরা দিচে।
জেএম/আইএইচ

