বুধবার, ৮ মে, ২০২৪, ঢাকা

লিবিয়ায় ১১ লাখ টাকা ছাড়া মুক্তি মিলছে না ওয়াহিদের

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ২৯ আগস্ট ২০২২, ০৯:০১ এএম

শেয়ার করুন:

লিবিয়ায় ১১ লাখ টাকা ছাড়া মুক্তি মিলছে না ওয়াহিদের
ছবি: সংগৃহীত

‘ভাই, তুমি আমারে বাঁচাও। তোমরা যেভাবেই পারো ১১ লাখ টাকা পাঠিয়ে দাও। আমারে মুক্ত করো ভাই। না হইলে ওরা আমারে মাইরা ফেলবো। তোমরা দ্রুত ব্যবস্থা করো।’-এভাবেই লিবিয়ার অজ্ঞাত স্থানে বন্দী থাকা বাংলাদেশের স্বজনদের ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছিলেন আব্দুল ওয়াহিদ (৩০)। 

তার কথা শেষ না হতেই আরেকজন ফোনটি কেড়ে নিয়ে অজ্ঞাত পুরুষ কণ্ঠে বলতে থাকেন, ‘আগামী দু’এক দিনের মধ্যে ১১ লাখ টাকা পাঠিয়ে দিবি, না হলে কিন্তু দিন বাড়লে এক লাখ করে বাড়বে। তোর ভাইকে আর জীবিত পাবি না। কথাটা যেন মনে থাকে। ফোনের এই প্রান্ত অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে কথাগুলো শুনে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন ভাই সোলায়মান। 


বিজ্ঞাপন


ওয়াহিদের পরিবার জানিয়েছে, চলতি বছরের গেল রজমানে ওয়াহিদকে ইতালি নিয়ে যাওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় পাচার করা হয়। পরে সেখানে নিয়ে বাংলাদেশি দালালের হাতে বিক্রি করা হয়েছে। সেই দালাল এখন প্রতিদিন তার ওপর অমানবিক নির্যাতন চালাচ্ছে। সেই নির্যাতন সইতে না পেরে বারবার স্বজনদের ফোন করে টাকা পাঠানোর চাপ দিচ্ছে ওয়াহিদ। সেই সঙ্গে তাকে মেরে ফেলারও হুমকি দিচ্ছে দালালরা। 

লিবিয়ায় দালালদের হাতে বন্দী ওয়াহিদের বড় ভাই সোলায়মান রহমান ঢাকা মেইলকে জানান, ওয়াহিদ রাজধানীর মতিঝিলের ঘরোয়া হোটেলে কাজ করতেন। সেখানে তার সঙ্গে পরিচয় হয় নুরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। ওই ব্যক্তি তাকে ৯ লাখ টাকায় ইতালি নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তাকে বলেন, সেখানে তার ছোট ভাই থাকেন এবং তিনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন। এজন্য তাকে প্রথমে দুবাই যেতে হবে। পরে সেখান থেকে লিবিয়ার সীমান্ত দিয়ে তাকে ইতালি পাঠানো হবে। তার বেতন হবে লাখ টাকা। সেই কথা শুনে প্রলোভনে পড়ে যান ওয়াহিদ। ঢাকা থেকে ছুটের যান বরিশালে। বিষয়টি পরিবারের কাছে জানান। তারাও এমন খবর শুনে বেশ খুশি হন। কিন্তু সেই খুশি এখন কান্নায় রূপ নিয়েছে। পরিবারটি ওয়াহিদকে আর জীবিত ফিরে পাবেন কি না তা নিয়ে সন্দিহান।  

তিনি আরও জানান, বাংলাদেশে থাকা নুরুল ইসলাম তার ভাইয়ের কাছে পাঠান ওয়াহিদকে। লিবিয়ায় থাকা নুরুলের ছোট ভাই রফিক তাকে বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে তার কাছে কয়েকদিন রাখেন। এরপর এক দিন একটি গাড়িতে তুলে কয়েক কিলোমিটার রাস্তা ঘুরিয়ে এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেন। সেখানে কয়েকদিন থাকার পর ওয়াহিদ বুঝতে পারেন তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। ওয়াহিদকে যেখানে বন্দী রাখা হয়েছে সেখানে নিয়মিত চলছে শারীরিক নির্যাতন। প্রায় প্রতিদিন দিনই তার গ্রামের বাড়িতে ফোন করে টাকা পাঠানোর কথা বলে দালালরা। 

তিনি বলেন, ভাইটাকে ইতালি পাঠাব বলে নুরুলকে বিভিন্ন সময়ে ৯ লাখ টাকা দিয়েছি। এখন শুনছি ভাইরে তার (নুরুল) ছোট ভাই বিক্রি করে দিয়েছে। আমি আমার ভাইকে জীবিত ফেরত চাই। বিষয়টি র‌্যাবকে জানানো হলে নুরুলকে তারা গ্রেফতার করেছিল। তার নামে মানবপাচার আইনে মামলা হয়েছে। 


বিজ্ঞাপন


এদিকে ওয়াহিদকে বন্দী রেখে মুক্তিপণ চাওয়া হচ্ছে এমন কথা শুনে গ্রামে থাকা মা-বাবা কান্নাকাটি করে পাগল প্রায়। তার দুই ভাই সোলায়মান ও আকাশ বিভিন্নস্থানে ছুটছেন। কিন্তু কোথাও থেকে কোনো ধরনের আশ্বাস পাচ্ছেন না। লিবিয়ায় দালালের হাতে বন্দী ওয়াহিদের তিন বছরের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে এবং স্ত্রী গর্ভবতী। স্বামীর বন্দীর খবর শুনে তার স্ত্রী ও সন্তান সারাক্ষণ কান্নাকাটি করছে বলে জানান তার ভাই সোলায়মান।  

পুলিশ বলছে, নুরুল লিবিয়ায় থাকা তার ভাই রফিকের মাধ্যমে একটি মানবপাচার করে বিক্রির সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। দুই ভাই মিলেই তারা মানবপাচার করে। তাদের মূল টার্গেট থাকে সেখানে নিয়ে সেই ব্যক্তিকে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা। নুরুল মূলত বাংলাদেশ থেকে বিভিন্নজনকে ইতালি পাঠানোর প্রলোভন দেখান। এরপর কেউ রাজি হলেই তাকে প্রথমে দুবাই পরে সেখান থেকে লিবিয়া পাঠানো হয়। সেখানে তার ভাই রফিক সেই ব্যক্তিকে গ্রহণ করে কয়েকদিন রাখেন, এরপর লিবিয়া ও বাংলাদেশি দালালের কাছে বিক্রি করে দেন। 

এ ঘটনায় সূত্রাপুর থানায় মানবপাচার আইনে ওয়াহিদের বাবা খলিল হাওলাদার একটি মামলা করেছেন। সেই মামলায় নুরুল ইসলামকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সূত্রাপুর থানার এসআই মাসুদ আল মামুন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা ওয়াহিদকে দেশে ফেরানোর জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছি। হয়তো একটু সময় লাগবে। তাকে উদ্ধারেরও চেষ্টা চলছে। এ মামলায় নুরুল ছাড়াও তার ভাইকে আসামি করা হয়েছে। নুরুল দাবি করেছেন— তিনি এসব বিষয়ে জানেন না। মূলত তার ভাই ওয়াহিদকে বিক্রি করে দিয়েছে। আমরা ওয়াহিদকে উদ্ধার করে দেশে ফেরানোর চেষ্টা করছি। 

মানবপাচারকারী নুরুল ও রফিকের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। তারা দুই ভাই মিলে দীর্ঘদিন ধরে এই কাজ করে আসছেন। নুরুল ইসলাম এখন ওয়াহিদের ভাইয়ের করা মামলায় কারাগারে আছেন। কিন্তু এখনও হদিস মেলেনি ওয়াহিদের। তাকে কোথায় রাখা হয়েছে এবং কার কাছে বিক্রি করা হয়েছে সেই ব্যাপারে পুলিশের কাছে কোনো মুখ খুলেননি নুরুল ইসলাম। 

এমআইকে/এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর