শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

গ্রিসে বাংলাদেশিদের মানবেতর জীবন, বাস করেন গুদামঘরে  

ঢাকা মেইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৮ আগস্ট ২০২২, ০৩:২৭ পিএম

শেয়ার করুন:

গ্রিসে বাংলাদেশিদের মানবেতর জীবন, বাস করেন গুদামঘরে  

বাংলাদেশ থেকে কাজের খোঁজে দালালদের মাধ্যমে যারা গ্রিসে গেছেন তাদের অনেকেই এখনো দেশটিতে বসবাসের বৈধতা পাননি। ফলে তারা প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে থাকেন। জীবন-যাপনের রসদ জোগাতে অবৈধভাবে কাজ করেন। এই সুযোগে দালালচক্র তাদের কম পারিশ্রমিকে কাজে নিযুক্ত করেছেন। এরা বসবাসও করেন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। সম্প্রতি ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে উঠেছে। 

ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রিসে অনিয়মিত বাংলাদেশি অভিবাসীদের একটি দল অমানবিক পরিস্থিতিতে থাকেন পরিত্যক্ত এক গুদামঘরে৷ দেশটির কৃষি খামারে অনানুষ্ঠানিকভাবে কাজ করা এই প্রবাসীরা ডয়চে ভেলের সংবাদকর্মীদের কাছে তাদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেন৷


বিজ্ঞাপন


একতলা ভবন৷ তাতে একাধিক কক্ষ৷ একটি কক্ষে বড়জোর দুইজনের থাকার জায়গা৷ কিন্তু সেখানেই গাদাগাদি করে থাকেন ১৪ থেকে ১৬ জন৷ একজনের থাকার বিছানায় ঘুমান তিনজন৷ এমনকি রান্নাঘরেও থাকার জন্য বিছানা পাতা আছে৷ 

workerসেখানকার বাসিন্দা মোহাম্মদ সাগর বলেন, ‘মূলত আমরা জেলখানায় আছি৷ এটা যদি ভাবেন যে, ইউরোপে আমরা আছি এটা ভুল করবেন৷ আপনি ভাবতে পারেন আমি ইউরোপে আছি, কিন্তু আমি জানি যে আমি জেলখানায় আছি৷ ’ 

পশ্চিম গ্রিসের এলিস অঞ্চলের ভার্দায় এই ভবনটি আগে কী হিসেবে ব্যবহার হয়েছে তা নিশ্চিত করে জানেন না কেউ৷ কারো মতে এটি কারখানা ছিল, কেউ মনে করেন গুদামঘর৷  

তবে সাগর জানান, এক সময় নাকি এখানে দুম্বা রাখা হতো বলে শুনেছেন তিনি৷ তার ভাষ্য, ‘তারা আগে দুম্বা রাখত এখানে৷ এখন আমরাই দুম্বা হয়ে গেছি৷’ 


বিজ্ঞাপন


১০০ টাকার ৩০-৪০ টাকা নেয় ‘মাস্তুরা’ 

বর্তমানে ৩০ জন বাংলাদেশি আছেন এখানে৷ তবে কৃষি মৌসুমে ১৫০ জনের উপরেও থাকেন৷  

বাংলাদেশি মধ্যস্বত্ত্বভোগী বা দালালদের মাধ্যমে তারা কাজ নেন কৃষিখামারগুলোতে৷ যাদেরকে তারা ‘মাস্তুরা’ নামে ডাকেন৷  

এই মাস্তুরাদের বিরুদ্ধে অনিয়মিত অভিবাসীদের আছে নানা অভিযোগ৷ সাগর জানান, ‘নয়ন মাস্তুরা’ নামের এক বাংলাদেশি গ্রিকদের সঙ্গে চুক্তি করে তাদের এখানে থাকার ও কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন৷ ৩০ টাকা যদি রোজ হয় তাহলে মাস্তুরা এক টাকা কেটে ২৯ টাকা দেন তাদের৷  

তিনি বলেন, ‘মাসে কত ডিউটি করবেন তার উপরে নির্ভর করবে আপনি তাকে কত টাকা দিবেন৷ ১০ টা ডিউটি করলে মাস শেষে তাকে ১০ টাকা দিতে হবে৷ এর উপর বাসা ভাড়া দিবেন, ব্যাংকের চেকের ফি শতকরা তিন টাকা দেবেন৷ যেহেতু অবৈধ হওয়ায় আমাদের কোন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই৷ ১০০ টাকা বেতনের কাজ করলে ৭০ টাকা আমরা পাই ৷ ৩০-৪০ টাকাই মাস্তুরা নিয়ে নেয়৷’ 

workerবৈধ কাগজ না থাকায় শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো সুযোগ-সুবিধা দাবি করতে পারেন না তারা৷ কেননা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে গেলে উল্টো তাদেরই হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ সাগর বলেন, ‘বাঙালি যে জায়গায় আছে সেখানেই মাস্তুরা আছে৷ মাস্তুরা ছাড়া কাজ করা সম্ভবই না৷’ 

আরেক অভিবাসী বলেন, ‘কেউ যদি মাস্তুরাদের বাদ দিয়ে নিজে সরাসরি খামার মালিকের অধীনে কাজ করতে চায়, সে এখানে টিকতে পারে না৷ তাদের এখানে সিন্ডিকেট আছে৷ তারা এখান থেকে আপনাকে একবারে বের করে দেবে৷’

স্বপ্নের সাথে বাস্তবের মিল নেই

মোহম্মদ শাহজাহান দুই বছর ধরে আছেন এখানে৷ সিলেট থেকে ওমান আসেন তিনি৷ পরে সড়ক পথে ইরান পাড়ি জমান৷ এরপর অনেক চেষ্টার পর গ্রিসে পৌঁছান৷ এখন তিনি স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি খামারে কাজ করেন৷  

বলেন, ‘আমাদের তো আর বৈধতা নাই৷ আমরা এক বাংলাদেশির অধীনে একজন গ্রিকের জন্য কাজ করি এখানে৷ ও যেভাবে বলে সেভাবেই আমাদের বাধ্যতামূলকভাবে মেনে নিতে হয়৷ এখানে থাকার পরিস্থিতি নাই তারপরও বাধ্য হয়ে থাকতে হচ্ছে৷’  

তিনি জানান, ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে তার গ্রিসে পৌঁছাতে, যার অনেকটাই ঋণ করেছেন৷ 

২০১৯ সালে গ্রিসে এসে এথেন্সে সাত মাস জেল খেটেছেন আরেক বাসিন্দা সালাউদ্দিন৷ এরপর ছাড়া পেয়ে কয়েকদফা আবেদন করেও বৈধভাবে থাকার অনুমতি পাননি তিনি৷ বলেন, ‘আমি শহরে থেকে ধরা খেয়েছি৷ এখন যদি আবার ধরা খাই আবার জেল খাটতে হবে৷ এজন্য এদিকে চলে এসেছি৷ এখানে দুই টাকা কম আয় হলেও পুলিশের হয়রানি নেই৷’ 

আজিজুর রহমান নামে আরেকজন বলেন, ‘যে চিন্তা করে এসেছি সেই স্বপ্নের সাথে বাস্তবের মিল নাই৷ আমরা নানাবিধ সমস্যায় আছি৷ বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারছি না৷ বৈধ কার্ডের কোন ব্যবস্থাও হচ্ছে না৷’ 

ফেব্রুয়ারিতে গ্রিসের সঙ্গে বাংলাদেশ কর্মী পাঠানোর একটি চুক্তি করেছে৷ সম্প্রতি গ্রিসের পার্লামেন্ট এর অনুমোদন দিয়েছে৷ এই চুক্তি অনুযায়ী দেশটিতে বসবাসরত ১৫ হাজার অনিয়মিত বাংলাদেশিকে মৌসুমি কাজের অনুমতি দেয়ার মাধ্যমে নথিভুক্ত করার কথা রয়েছে৷  

worker

কিন্তু মোহাম্মদ শাহজাহান মনে করেন এতে তাদের খুব একটা সুবিধা হবে না৷ তিনি বলেন, ‘আমরাতো পরিবার ফেলে এসেছি ভবিষ্যতের জন্য৷ চুক্তিবদ্ধ হলে যদি পাঁচ বছর পর দেশে চলে যেতে হয় তাহলেতো আর হলো না৷ আমি এত টাকা পয়সা পরিশ্রম করে এখানে এসেছি নিজের জীবন প্রতিষ্ঠা করার জন্য৷’ 

আজিজুর বলেন, চুক্তি অনুযায়ী তাদের যদি প্রতি নয় মাস কাজের পর বাংলাদেশে ফেরত যেতে হয় তাহলে আয়ের টাকা আর অবশিষ্ট থাকবে না৷ এতে কোনো সুফল হবে না৷ 

‘বরং আগের যে কার্ডের নিয়ম সে অনুযায়ী দিলে আমরা দুই তিন বছর পর ইচ্ছামতো দেশে যেতে পারব৷... আর এত টাকা খরচ করে এসেছিই আমরা মূলত ইউরোপে স্থায়ী হওয়ার জন্য’। বলেন তিনি৷ 

কপালে যতদিন আছে ঝুঁকি নিতে হবে

এই অভিবাসীদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের সঙ্গে গ্রিসের করা চুক্তির অধীনে নিয়মিত হওয়ার আবেদন করতে ইচ্ছুক নন৷ সালাম নামের একজন বলেন, ‘এই কাগজ নেয়ার চেয়ে না নেয়া ভালো৷ আমরা ইউরোপ আসছি এত কষ্ট করে৷ আমরা এসেছি জীবনের নিরাপত্তার জন্য৷ পাঁচ বছরের জন্য যেই কাগজ দেয়ার কথা বলা হচ্ছে সেটা আমি নিব না৷ আমি ইটালি বা ফ্রান্সে চলে যাব৷’’ 

কিন্তু ইটালি বা ফ্রান্স যাওয়ার পথে আরো ঝুঁকিওতো রয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে সালাম বলেন, ‘আমরা এমন একটা দেশে জন্ম নিয়েছি আমাদের জীবনটাই ঝুঁকি৷ জন্মের পর থেকেই আমরা ঝুঁকিতে আছি৷ আমাদের কপালে যতদিন আছে ঝুঁকি নিতে হবে৷’

তিনি অভিযোগ করেন, প্রবাসী কেউ মারা গেলেও বাংলাদেশের সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয় না৷ সম্প্রতি তারা নিজেরাই এক প্রাবাসীর লাশ পাঠিয়েছেন চাঁদা তুলে৷ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও ব্যবস্থা নেয়া হয় না বলে অভিযোগ তাদের৷  

সূত্র: ডয়চে ভেলে

এজেড

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর