শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের বিড়ম্বনা

বায়াজিদ গালিব
প্রকাশিত: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:১৯ পিএম

শেয়ার করুন:

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের বিড়ম্বনা

কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছেই না। দিন বেশ বড়। ক্যালগেরির সূর্যোদয় সকাল সাড়ে পাঁচটায়, আর সূর্যাস্ত সন্ধ্যা পৌনে দশটায়। সাধারণত তাপমাত্রা বিশের উপরে থাকে। এখন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। এ দেশের বৃষ্টির সাথে বাংলাদেশের বৃষ্টি মেলানোর চেষ্টা করি, কিন্তু সে আমেজ পাই না। বৃষ্টি নামলেই, বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছায় সবাই মিলে ফুটবল খেলতাম। শৈশবে আমাদের দুরন্তপনার সীমা ছিল না। আমরা ছিলাম সদা উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত। বৃষ্টি উপভোগের আরেকটি সুন্দর উপায় ছিল, গ্রামের বাড়ির বারান্দায় বসে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ। যদি এ বৃষ্টি হয় রাতে তখন টিনের চালে বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভেঙে না গিয়ে ঘুম গভীর থেকে গভীরতর হতো। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ, পাশ থেকে ভেসে আসা ব্যাঙের ডাক, কোনোকিছুই এখন আর নেই। সেই দিনগুলি আজ স্মৃতি হয়ে আছে। দিনগুলি স্পষ্ট দেখতে পাই, সেখানে ফিরে যেতে পারি না। অনেকটা দূর আকাশের তারার মতো দেখা যায়, ধরা যায় না।

শৈশবের স্মৃতিমধুর দিনগুলির কথা সবসময়ই মনে পড়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমাদের একজন ভিন্ন ধরনের শিক্ষক ছিলেন। তিনি গতানুগতিক শিক্ষকদের মতো কখনোই আমাদের বইয়ের পাতায় বেঁধে রাখতেন না। সেই সময় তার কাছে আমরা কুয়াশার গল্প শুনতাম। তাছাড়া আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান দিতেন। তার মধ্যে অন্যতম আমাদের ইন্দ্রিয় বিষয়ক। যেমন— চোখ, কান, নাক, ত্বক ও জিহ্বা এই পাঁচটিকে পঞ্চইন্দ্রিয় বলে। এর বাইরেও নাকি একটি ইন্দ্রিয় আছে, তাকে বলা হয় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় মানুষের মনের সাথে সম্পৃক্ত। আবার একে অনেকে তৃতীয় চক্ষুও বলে থাকেন। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দ্বারা ভবিষ্যৎ দেখা বা অনুমান করা, অশরীরীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, কথা বলা, ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থেকেও কোনো ঘটনা ঘটার সময় তা অনুভূত হওয়া ইত্যাদি। অনেকদিন পর এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ব্যবহৃত হলো নিজের অজান্তেই, তবে ভিন্ন আঙ্গিকে।


বিজ্ঞাপন


আজ সপ্তাহের ছুটির দিনে জানালার পাশে বসে বৃষ্টি উপভোগ করছি। এ সময় ঘন দুধ-চা, সাথে ঝাল মুড়ির দরকার। সেসব করার উপকরণ থাকলেও ইচ্ছে করছিলো না, তাই মগ ভর্তি কালো কফি নিয়ে বসেছি বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ শুনতে, বিদেশ বলে কথা। মাঝে মাঝে হারিয়ে যাচ্ছি অতীতের বিভিন্ন সময়ের দিনগুলিতে। মনে পড়ে, রবীন্দ্রনাথের ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়’ বিষয়ক প্রমথ চৌধুরীর লেখা একটি প্রবন্ধ ছিল আমাদের পাঠ্য। সেখানে তিনি লিখেছেন, বৃষ্টির দৃশ্যে চোখ ভর করে কানের ওপর। এ সময় সামনে দিয়ে কেউ হেঁটে গেলেও নজরে আসে না। বৃষ্টির সকল দৃশ্য যেন কানে রিনিঝিনি বেজেই চলছে। সেই সাথে আমার মুঠো ফোনও বাজছিলো, আমার কান তা শুনতে পাচ্ছিলো না। স্ত্রীর ধাক্কায় সম্বিৎ ফিরে পেলাম। সে বললো, কি ব্যাপার তোমার ফোন বাজছে, ধরছো না কেন? কার কথা মনে করে ধ্যানমগ্ন? আমি তাড়াতাড়ি ফোন ধরলাম। পল্লবের ফোন, আমার ফেসবুক বন্ধু। তার সাথে কখনো আমার দেখা হয় নাই, তবে ভিডিওকলে কথাবার্তা হয়েছে। প্রথমদিন ফোন করে বলেছিলো, আপনার লেখা আমি খুব পছন্দ করি। আমি কিছুটা বিব্রত হয়েই বলেছিলাম, ধন্যবাদ। তারপর থেকে মাঝে মাঝে কথাবার্তা হতো। একদিন বললো, আমার নিজস্ব কিছু কাহিনী আছে, আমি চাই আপনি সেগুলো নিয়ে গল্প লিখুন। আমি বললাম, আমি কেন? আপনি নয় কেন? সে বিস্ময়ের সাথে উত্তর দিলো, আমি! বললাম, সমস্যা কোথায়? সে বললো, আপনার মতো হবে না তো! আমি বললাম, না হোক, তবুও শুরু করুন। আপনি আপনার জীবনের গল্প আপনার মতো করে লিখুন, দেখবেন হয়ে গেছে। সেই থেকে তার লেখার শুরু।

পল্লব বসবাস করেন ক্যানাডার নোভাস্কোশিয়া প্রদেশের সাগর পাড়ের হ্যালিফ্যাক্সে। বন্দর নগরীর সবসময় প্রশংসা করেন। অনেকবার ওখানে বেড়িয়ে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। প্রায় প্রতিটি শহরের ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস সমৃদ্ধ স্থানে দর্শনের ইচ্ছা আমার অনেক দিনের। হ্যালিফ্যাক্সে ঘটনাটি ঘটে ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। সেদিন ফরাসি পণ্যবাহী জাহাজ এসএস মন্ট-ব্ল্যাঙ্ক, কানাডার নোভাস্কোশিয়া প্রদেশের হ্যালিফ্যাক্স বন্দরে। নরওয়ের জাহাজ এসএস ইমোর সাথে সংঘর্ষ হয়। ফরাসির জাহাজ বহন করছিলো উচ্চতর বিস্ফোরক দ্রব্যাদি। জাহাজে আগুন ধরে বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে। এই বিস্ফোরণ রিচমন্ড জেলাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলে। আনুমানিক সতেরশ মানুষের মৃত্য হয় এবং দালান ধসে পড়ায় আনুমানিক ৯ হাজার লোক আহত হয়। বিস্ফোরণটি ছিলো তৎকালীন মানবসৃষ্ট সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণ। আমি অবশ্য আরও বড় মানবসৃষ্ট বিস্ফোরণের নিদর্শন জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকি দেখেছি।

কানাডায় বসবাস করে এ দেশের পূবের প্রদেশ নোভাস্কোশিয়ার হ্যালি ফ্যাক্স দেখবো না তা কি হয়? সেই ঐতিহাসিক শহর না দেখলে চলবে না। আমরা প্রায়ই পরিকল্পনা করি টরোন্টো থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়বো ক্যানাডার পূর্ব সীমান্তে। ভ্রমণের সবচেয়ে ভালো সাথী হচ্ছে আমার বন্ধু ড. মোজাম্মেল হক খোকন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রাবাসের কক্ষসাথী। ওদের সাথে ক্যানাডা-আমেরিকাসহ অনেক ভ্রমণের স্মৃতি আছে। আমার বন্ধুকে হ্যালিফ্যাক্স বেড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সে রাজি। বলেছে, শুধু তোদের আসতে যে সময় লাগে। তবে আমাকে আগে থেকে জানালে প্রস্তুতি নিতে সুবিধা হয়। বন্ধুর আশ্বাসের ভিত্তিতে আমার ফেবু বন্ধুকে বলেছিলাম, একদিন যাবো নিশ্চয়। উনি বলেন, হ্যাঁ, আসবেন জানি, তখন তো আমি নাও থাকতে পারি। আমি বললাম, কেন? সে বললো, আমি এক জায়গায় বেশিদিন থাকি না।

এক জায়গায় বেশিদিন থাকেন না— এমন একজনের সাথে পরিচয় হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে, নাম মানিক। বিয়ে করেছেন পাঞ্জাবি মেয়েকে। দেখতে বেশ সুন্দরী। তার সুশ্রী চেহারার সাথে মিল রেখেই হয়তো বাবা মা নাম রেখেছিলেন সুদর্শনা। আমি মানিককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি এক জায়গায় বেশিদিন থাকেন না কেন? সে বলেছিলো, আরে ভাই, আমার নাম মানিক, এক জায়গায় বেশিদিন থাকলে যদি মাইনক্যা চিপায় পড়ে যাই? সবাই হেসে উঠলেও সুদর্শনা না বুঝেই হেসেছিলো। মানিক চেষ্টা করেও মাইনক্যা চিপার সঠিক অর্থ বোঝাতে পারে নাই সেদিন। আর আমি তো তখন খাঁটি বাঙালি। বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা বেড়াতে গিয়েছিলাম। মাইনক্যা চিপার কোনো সঠিক অনুবাদ তো দূরের কথা, সাধারণ ইংরেজি বলতেই দাঁত ভেঙে যাবার দশা। মাইনক্যা চিপার ইংরেজি শেষমেষ ট্র্যাপ বলেছিলো। ট্র্যাপ মাইনক্যা চিপার সঠিক অর্থ বোঝায় কি? সঠিক বোঝানো খুব জরুরি। এই অর্থের ঝামেলার জন্য আমি যখন কানাডায় বসবাস শুরু করলাম তখন খুঁজে খুঁজে বাঙালি ডাক্তার বের করতাম। আমার বন্ধুরা বললো, তুই বাঙালি ডাক্তার খুঁজিস কেন? আমি বললাম, সবই মাইনক্যার চিপা বুঝলি। ওরা বললো, মানে কি, এখানে মাইনক্যা চিপা আসলো কোত্থেকে? আমি বললাম, মাইনক্যা চিপার ইংরেজি বল। সবাই চুপ করে রইলো। আমি বললাম, মনে কর আমার শুঁটকি মাছের ভর্তা খেয়ে পেটে সমস্যা দেখা দিলো। তখন যদি এ দেশীয় ডাক্তারকে বলি আমি ড্ৰাই ফিস খেয়েছিলাম, সে কিন্তু শুঁটকি মাছের রেসিপি নিয়ে চিন্তা করবে না। কিন্তু একজন বাঙালি ডাক্তার সাথে সাথেই বুঝে যাবে আমার সমস্যা কোথায়।


বিজ্ঞাপন


আমি প্রবালকে বললাম, আপনি এক জায়গায় থাকেন আর নাই থাকেন লেখা কখনোই বন্ধ করবেন না। আমি হঠাৎ তাঁকে প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা আপনি কথা বলার সময় ঘাড় চুলকান কেন? সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, আমি খুবই অবাক! আপনি তো আমাকে দেখছেন না তাহলে বুঝলেন কিভাবে যে আমি ঘাড় চুলকাচ্ছি? আমি বললাম, বিষয় তা না। আপনি ঘাড় চুলকিয়েছেন কি না? সে এবার হেসে বললো, হা। কিন্তু আপনি কিভাবে দেখলেন। আমি বললাম, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে জানান দিয়েছে। বলেই হেসে উঠলাম। সে আরো বিস্ময়ের সাথে আমাকে জিজ্ঞেস করলো আপনি কি ধ্যান বিদ্যা চর্চা করেন? আমি হা না কিছুই না বলে তাকে একটি রহস্যের মাঝে রেখে বললাম, হায়! সর্বনাশ! আমাকে তো এক্ষনি বের হতে হবে। আচ্ছা আরেকদিন কথা হবে।

সে যখন লেখা শুরু করে সে সময় আমার রাইটার্স ব্লক চলছে। শত চেষ্টা করেও এক লাইন লিখতে পারছিলাম না। লেখা বাদ দিয়ে পড়া শুরু করলাম। প্রায় সব পত্রিকার সব ধরণের গল্প, প্রবন্ধ পড়ি। বিশেষ করে নতুন লেখকদের লেখা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ি। একদিন তরুণ লেখক বন্ধু আমাকে ফোন করে বললেন, কি ব্যাপার অনেকদিন আপনার লেখা দেখি না? আমি বললাম, লেখা আপাতত বন্ধ। আসলে লিখতে পারছি না। সে অবাক হয়ে বললো, বলেন কি এমন কি হতে পারে? আমি বললাম, হা অবশ্যই হতে পারে। একে ইংরেজিতে বলে রাইটার্স ব্লক। তবে আমি যেহেতু তেমন লেখক না তাই আমার ক্ষেত্রে হয়েছে ব্রেইন ব্লক। সে বললো, এ আবার কি? আমি বললাম, আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে যে অল্প জ্ঞান সঞ্চয় হয়েছিল তা শেষ হয়ে গেছে। তাই লেখা বের হচ্ছে না। সে বললো, আসল ঘটনা কি? বললাম, ঘটনা সত্য, রিলিফ পাবার যোগ্য। সে বললো, রিলিফ পাবার যোগ্য মানে? আমি হেসে বললাম, তাহলে আপনাকে একটি মজার ঘটনা বলি, বন্যার সময় অনুদানের জন্য সবাই গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবরে দরখাস্ত করতো, যাতে করে ত্রাণ পেতে সুবিধা হয়। এতো লোকজন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আর এত বেশি দরখাস্ত পড়েছে যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেবের লিখতে হাত ব্যাথা হয়ে গেলো। তিনি সংক্ষেপে একটি কথা লেখা শুরু করলেন, ঘটনা সত্য, রিলিফ পাবার যোগ্য। ত্রাণের দরখাস্তের সাথে একটি দরখাস্ত এলো ছেলেকে এলাকার কলেজে ভর্তি করার জন্য, তিনি সেখানেও লিখে দিলেন ঘটনা সত্য, রিলিফ পাবার যোগ্য।

এভাবেই কেটে গেলো বেশ কয় মাস, তারপর আমার লেখার দ্বার খুলে গেলো। এর মধ্যে একদিন সে বললো, ভাই ভাবছি আর লেখা হবে না। লেখালেখি বন্ধ করে দেব। বললাম, সে কি আপনার লেখার ধার তো বাড়ছে, তাহলে বন্ধ করবেন কেন? সে বিষণ্ণ মুখে বললো, না রে ভাই আমার লেখার ধার আর তেমন কি আমার স্ত্রীর মুখের ধার অনেক বেশি। আমাকে বলে, কি সব ছাই পাশ লেখো, দুই লাইনের বেশি পড়া যায় না। এসব বাজে কাজে সময় নষ্ট না করে সংসারের কাজে মন দাও। আমি বললাম, আপনি এক কাজ করেন, স্ত্রীকে নিয়ে একটি প্রেমের কবিতা লেখেন দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। সে বললো, তাই না কি? আপনি নিশ্চিত? আমি বললাম, রবীন্দ্রনাথের 'অধ্যাপক' গল্প পড়েছেন? সে বললো না। আমি বললাম, তাহলে শোনেন, রবীন্দ্রনাথ তার ‘অধ্যাপক' গল্পে লিখেছেন, ‘রাজা শিবসিংহের মহিয়সী লছিমা দেবীকে কবি বিদ্যাপতি ভালোবাসিতেন এবং তাহাকে না দেখিলে তিনি কবিতা রচনা করিতে পারিতেন না।’ শুধু বিদ্যাপতিকে বলা কেন, এমন প্রচুর কবি, ঔপন্যাসিক আছেন যারা তাঁদের ভালোবাসার জনকে কেন্দ্র করে প্রচুর লেখেন, সুন্দর লেখেন। জীবনে ভালোবাসার মানুষ নেই এমন খুব কম লেখকই আছেন। তাই আপনি হাল ছাড়বেন না চালিয়ে যান। সে বললো, ভাই আপনি মাঝে মাঝে আবোল তাবোল বকেন। আমি লিখতেই পারি না তার উপর কবিতা লিখবো। আর যদিও তাকে নিয়ে লিখি সে বিশ্বাসই করবে না যে কবিতা তাকে নিয়ে লিখেছি। তখন আবার ঝামেলা হবে, বাদ দেন।

আমি হঠাৎ তাকে বললাম, আচ্ছা আপনি এতো বিচলিত কেন, ঘন ঘন এদিক ওদিক কি দেখছেন? সে বললো, ভাই আপনি কি আধ্যাতিক জগতের লোক? আপনি কিভাবে জানলেন আমি বিচলিত হয়ে এদিক ওদিক দেখছি? আমি বললাম, না তেমন কিছু নয় সবই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ব্যাপার। আচ্ছা ভালো থাকবেন পরে কথা হবে। পরক্ষনেই সে আবার ফোন করে বললো, ভাই আমি তো কিছুই লিখতে পারছি না, আপনি আমাকে কি ভাবে দেখেন! আমি বললাম, আরে! করেন কি! আস্তে! অত জোরে চুল টানবেন না। সে প্রথমে অবাক ও পরে বিরক্ত হয়ে বললো, দূর মিয়া আপনি খুব ঝামেলা করেন। বলেই রেখে দিলো। আমি বুঝতে পারছি তার কৌতূহলের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। ওকে ষষ্ঠইন্দ্রিয় থেকে বের করে না আনলে তাঁর লেখা বন্ধ হয়ে যাবে। এরপর অনেক দিন কথা বন্ধ। মনে হয় সে ঠিক করেছে আমাকে আর ফোন করবে না। আমি একদিন নিজেই ফোন করলাম। সে বললো, কেমন আছেন ভাই? আমি বললাম, আমি তো ভালোই ছিলাম কিন্তু আপনারা কোনো ফোন না পেয়ে কিছুটা চিন্তাগ্রস্থ। সে এবার হেসে বললো, যাক তাহলে আপনিও চিন্তিত হন? বললাম, প্রাণিকূলে একমাত্র মানুষই তো সুদূরপ্রসারী চিন্তা করার ক্ষমতা রাখে। সে বললো, মানুষ সুদূরপ্রসারী চিন্তা করতে পারে আর অন্যান্য প্রাণী কি অল্প বিস্তর চিন্তা করতে পারে? আমি বললাম, ঠিক তাই। তা নির্ভর করে সে সব প্রাণীর মস্তিষ্কের ক্ষমতার ওপর। যেমন মানুষের পর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার এক ধরনের বানর নাম ওরাং-ওটান। তবে তার চিন্তা সীমিত। যেমন কোনো মানুষ পানিতে পড়ে গেলে তার জন্য সাহায্যের হাত বাড়াতে পারে এই টুকুই। এরপর হচ্ছে ডলফিন। সে বললো, বাহ্! এ তথ্য তো জানা ছিল না! আমি বললাম, ওরাং-ওটান নিয়ে লিখে ফেলুন একটি গল্প। সে হেসে বললো, মানুষ নিয়েই লিখতে পারি না আবার বানর নিয়ে লিখবো! এমনি কোনো লেখা আজকাল লিখতেই পারি না। আমি বললাম, এটা হচ্ছে রাইটার্স ব্লক। ঠিক হয়ে যাবে। সে বললো, কি যে বলেন না! আমি লেখক হলে তবেই না রাইটার্স ব্লক হবে। আমার হচ্ছে ওয়াইফস ব্লক মানে স্ত্রীর বাধা। আমি বললাম, উনি আবার কি সমস্যা করেন? সে বললো আর বলেন না ভাই, যখনই লিখতে বসি বিরক্ত হয়ে বলে, শেষ বয়সে এসে ওনার হুমায়ুন আহমেদ হবার শখ হইছে, যত্তসব আজাইরা কাজ। আচ্ছা বলেন ভাই, এইসব কথা বললে কি আর লেখার মুড থাকে? আমি বললাম, আপনি মনে হয় খুব ব্যস্ত থাকেন, ভাবীকে কোনো সময় দেন না। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললো, তা ঠিক, তবে এই বয়সে কি আর সময় দেবার দরকার হয়? আমি বললাম, স্ত্রীকে সময় দেবার কোনো বয়স লাগে না। সে এবার বললো, আপনিও কি বাধাগ্রস্থ হন? আমি বললাম, হই বৈ কি। সে বললো, তখন কি করেন? তার কথা শুনে মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেলো। মনে হলো আমি ফিরে গিয়েছি সেই দুরন্ত কৈশোরে। নানারকম দুষ্ট বুদ্ধি দিয়ে বন্ধুদের নাজেহাল করতে খুব ভালোবাসতাম। আমার শৈশবের বন্ধু না হলেও বন্ধু তো। হোক না ফেবু বন্ধু। বললাম, ভাই আমিও প্রথম দিকে বাধা পেতাম। তারপর থেকে একটি বুদ্ধি বের করলাম। তা হচ্ছে, যখন আমার লেখার ইচ্ছা হতো তখন রান্না ঘরে ঢুকে কিছু একটা খাবার ও চা বানিয়ে রান্নাঘর অগোছাল করে আসতাম। আমার স্ত্রী আবার অগোছাল পছন্দ করে না তাই সে রান্না ঘর পরিষ্কারের কাজে লেগে গেলে, আমি লিখতে বসতাম, প্রায় দু ঘণ্টা সময় এভাবেই বের করতাম লেখার জন্য। আপনিও এমন একটি পদ্ধতি বের করতে পারেন। তবে এ পদ্ধতিতে যাবার আগে আপনাকে প্রশ্ন। সে বললো, বলেন কি প্রশ্ন? আপনি কি রান্নাঘরে আপনার স্ত্রীকে সাহায্য করেন। সে বললো, না। আমি বললাম, তাহলে ভুলেও এই পদ্ধতিতে যাবে না, বিপদে পড়বেন। সে আমার কথা পাত্তা না দিয়ে বললো, ভাই যাই বলেন না কেন আপনার এই পদ্ধতি আমার খুউব পছন্দ হয়েছে। আমি বললাম, ভেবে দেখেন আরেক বার, আমি বললাম, আমার পদ্ধতিতে কিন্তু ঝুঁকি আছে। সাবধানে থাকবেন। সে বললো, আজ কিন্তু আপনি আমি কি করছি সে বিষয়ে কিছু বললেন না। আমি হেসে বললাম, আজ আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করে নাই। আমি প্রতিউত্তরে একটি অট্টহাসি দিলাম।

আমি তাকে পরামর্শ দিয়ে মনে হয় ভুল করলাম। এমন নিরীহ লোককে এমন পরামর্শ দেওয়া ঠিক না। এ নিয়ে উত্তেজনায় আমার ঘুম হারাম হয়ে গেলো। লেখা বন্ধ হয়ে গেলো। টান টান উত্তেজনা আমাকে গ্রাস করে ফেললো। তার কোনো খবর নেই অনেকদিন। এমন ভাবতে ভাবতে একদিন তার ফোনকল এলো। আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুঠোফোন হাতে নিলাম। আমার বিকাল নয়টা, আকাশের সূর্য পৃথিবীর বুকে উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে, তার মানে তার ওখানে এখন মধ্যরাত। আমি ভয়ে ভয়ে মুঠোফোন হাতে নিলাম। দুর্বল কণ্ঠে বললাম, হ্যালো! ও পাশে ঠান্ডা কণ্ঠে ভেসে এলো, ভাই কেমন আছেন। আমি বললাম, আমার থাকার চেয়ে আপনার থাকাটা জরুরী, আপনি কেমন আছেন সব ঠিক আছে তো? কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, আপনার পদ্ধতি কাজ হয় নাই। বললাম, কোন পদ্ধতি? সে বললো, রান্না ঘর অগোছালো। আমি বললাম, আরে ভাই আমি তো আপনাকে আগেই বলেছিলাম এ পদ্ধতি আপনার জন্য নয়, আপনি তো শুনলেন না। এবার বলেন কি সমস্যা? চুপ করে রইলো। আমি বললাম, শুধু মাথা নাড়লে হবে? সে এবার বললো, আচ্ছা আপনার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়ের ব্যাপারটা আগে বলুন তো! আমি মাথা নাড়লাম এটা তো অবশ্যই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় না। আমি এবার হেসে বললাম, আমার এক বন্ধু আছে যার চারিত্রিক বৈশিষ্ঠের সাথে আপনার প্রচন্ড মিল। আপনাকে আমার সব বলা অনুমানভিত্তিক। আমার মনে হলো আমার বন্ধু যেমন ভাবে আমার সাথে কথা বলে হয়তো আপনিও তেমনই হবেন। তাই প্রথমবার অনুমানের উপর ঢিল ছুঁড়লাম কাকতালীয়ভাবে লেগে গেলো। পরেরবার আবার একই অনুমান করে লেগে গেলো। আসলে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের পূর্বাভাসের কোনোই ক্ষমতা নেই। ব্যাপারটি আমার কাছেও পরিষ্কার না। মনে করতে পারেন আপনার সাথে এক ধরণের খেলা খেলেছি। কিন্তু এই খেলা যে বারবার কাকতালীয়ভাবে সত্যি হবে তা ভাবিনি। তাছাড়া আপনার সাথে যে কয়েকবার ভিডিওকলে কথা হয়েছে তা থেকেও অনুমান করে বলেছি। সে বললো, আর কয় দিন ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের খেলা চললে তো আমি আপনার মুরিদ হয়ে যেতাম!

আমি হেসে বললাম, এবার আপনার কথা বলেন। সে বললো, ভাই আমি রান্না ঘর অগোছালো করে সবে লিখতে বসেছি। আমার স্ত্রী রান্না ঘরের থালা বাসন আমার কাগজের ওপর রেখে বললো, যাও এগুলো ধুয়ে রান্না ঘর পরিষ্কার করে আসো, তা না হলে খবর আছে।

বায়াজিদ গালিব, ক্যালগেরি।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর