মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

প্রধান উপদেষ্টার কাছে খোলা চিঠি

রহমান মৃধা
প্রকাশিত: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:০৪ পিএম

শেয়ার করুন:

তিস্তার পানির অধিকার চাইবে বাংলাদেশ: পিটিআইকে প্রধান উপদেষ্টা

মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনুস,

আপনি কেমন আছেন? আমি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা ও চেতনায় গড়ে উঠা এক শিশু মুক্তিযোদ্ধা। বাবা এবং বড় তিন ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে, মায়ের দিকনির্দেশনায় ছোট পাঁচ ভাইবোনকে নিয়ে দীর্ঘ নয় মাস নিজ দেশে শরণার্থী হয়ে জীবন-মরণের সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছি। দেশ স্বাধীনের ফেরিওয়ালা হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করেছি ও সাহায্য করেছি। চোখের সামনে দেশ স্বাধীন হতে দেখেছি, বহু আত্মীয়স্বজনের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ পেয়েছি, তবে সঙ্গে হারিয়েছি অনেক কিছু।


বিজ্ঞাপন


আমরা বর্তমানে ৯ ভাইবোন। সবাই দেশের বাইরে, শুধু একজন ছাড়া। নিজেকে, পরিবারকে, এবং দেশকে সোনার বাংলা গড়ে তুলব বলে অল্প বয়সেই দেশ ছেড়েছি। বাবা-মার নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণায় দেশের জন্য সব করতে প্রস্তুত; এমনকি এখনও মানসিকভাবে দেশের জন্য কাজ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। চল্লিশ বছর প্রবাসে থেকেও দেশের উন্নয়নে বদ্ধপরিকর হয়ে কাজ করে চলেছি। আমার গ্রামের বাড়ি মাগুরা জেলার নহাটা গ্রামে (মাগুরা-২ আসন)। আমি সুইডেন প্রবাসী প্রফেসর ড. মান্নান মৃধার ছোট ভাই এবং আমি নিজেও একজন সুইডিশ প্রবাসী। ২০২৪ সালেও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দূরপ্রবাস থেকে দেশের শিক্ষার্থীদের শতভাগ অনুপ্রেরণা ও নানাভাবে সাহায্য করেছি একজন লং ডিস্ট্যান্স মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। একটি দুর্নীতি মুক্ত বাংলাদেশ পেতে আমি দীর্ঘদিন ধরে দেশের প্রায় সব গণমাধ্যমে দূরপ্রবাসে থেকে নিয়মিত লিখি একজন কলামিস্ট হিসেবে।

আমরা খুব সহজেই পরনিন্দা ও পরচর্চা করি, অথচ নিজেদের মধ্যে যে একই সমস্যা রয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাও যে অপরিহার্য, সেটা ভুলে যাই।

আমরা বাংলাদেশে ধর্ষণ, ঘুষ, মাদক, দুর্নীতি এসবের বিরুদ্ধে সব সময় লিখি, কথা বলি, সংগ্রাম করি। কিন্তু আমরা কখনো বলি না বা বলতে চাই না যে, এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা আর কেউ নয়, আমাদের সমাজেরই পরিচিত মুখ। আমার এই খোলা চিঠির মাধ্যমে আজ আমি আমার পারিবারিক সমস্যা তুলে ধরতে চাই সরাসরি আপনার কাছে। যদিও আমি এই বিষয়টি অতীতেও লিখেছি তৎকালীন সরকারের প্রধান শেখ হাসিনাকে এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানকে, কিন্তু কোনো সাহায্য পাইনি। আমার পরিবার শিক্ষা এবং অর্থে দেশে-বিদেশে সুনামের সঙ্গে চললেও আমার পরিবারে রয়েছে ভাই-বোনদের বঞ্চনাকারী এক বা একাধিক সদস্য। আমার পারিবারিক সমস্যা আমি দুঃখের সঙ্গে তুলে ধরছি শুধুমাত্র পরিবর্তনের জন্য। কারণ, যদি এমনভাবে চলতে থাকে তবে এসব কুৎসিত চরিত্রের মানুষের জন্য পুরো দেশ এক সময় অচল হয়ে যাবে। আর এ ধরনের কুৎসিত চরিত্রের মানুষ বর্তমানে বাংলাদেশে দ্রুত বর্ধনশীল।

বাংলাদেশের যৌথ পরিবারের সংখ্যা দিন দিন কমতে শুরু করেছে। পরিবারে বড় ভাই-বোনদের সচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও বাবা-মা এবং ছোটদের ছেড়ে আলাদা হয়ে যাওয়া, খোঁজখবর না রাখা— এখন এসব ঘটনা সর্বত্র দেখা যাচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিয়ের আগে যে ভাইয়ের ওপর ছিল ভালোবাসা এবং মধুর স্মৃতি, সে ভাই পরবর্তীতে মস্ত বড় অফিসার হয়ে সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে। সে পরিবার ছেড়ে নিজেকে লোভী করে ফেলেছে আর গড়েছে তার চারপাশে এক আত্মকেন্দ্রিক প্রাচীর, যা তার মনুষ্যত্বকে দিনের পর দিন এবং বছরের পর বছর বন্ধ করে রেখেছে।


বিজ্ঞাপন


ছোট ভাই-বোনদের জন্য কিছু করলে যদি কোনো বড় ভাই-বোন তা সুদে-আসলে তুলে নেয় এবং সারাক্ষণ কঠিনভাবে মানসিক অশান্তিতে রাখে, তখন ভালোবাসার সম্পর্ক ঘৃণায় পরিণত হয়। অর্থনৈতিকভাবে ঋণগ্রস্ত ছোট ভাই-বোনের ওপর বড়দের জুলুমের পরিমাণ যখন সীমা লঙ্ঘন করে এবং তারা যখন ছোটদের প্রতি অত্যাচার ও অবিচার করতে শুরু করে, তখন ঘৃণা ছাড়া ছোটদের আর কিছু করার থাকে না। সেক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় ভালোবাসা, সেইসঙ্গে সম্পর্কেরও অবনতি ঘটে, যা আর ভাই-বোনের সম্পর্ক থাকে না।

এ ধরনের অনেকে পরিবারে সবকিছু ভোগ-দখল করে আসছে বছরের পর বছর, তারপরও খুশি নয়। এরা সেই বর্ণচোরা মুখোশধারী মানুষ নামের দানব যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুরো পরিবারকে ঠকিয়ে চলছে বহু বছর ধরে। বাংলাদেশের লাখ লাখ পরিবারে প্রতিনিয়ত এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এর একটি বিহিত করা প্রয়োজন। তবে পাছে লোকে কিছু বলে এই ভয়ে কেউ কিছু করছে না। সরাসরি কিছু করতে বা বলতে গেলে পরিবারের সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে।

আমরা সবাই দানবের সমাজে বাস করতে চাই না; মানবের সমাজ ফিরে পেতে চাই। কিন্তু এই দানবদের আলোর পথে না আনতে পারলে সমাজ এবং দেশে এদের সংখ্যা এত বাড়তে থাকবে যে, শেষ পর্যন্ত সৎ মানুষ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে। যে চরিত্রহীন, অসৎ ও দুর্নীতিগ্রস্ত তাকে লজ্জা দেয়া যায় না। যে উলঙ্গ তাকে কে লজ্জা দেবে? কী করে সে দাবি করে সবার ভালোবাসা, শ্রদ্ধা? একজন শিক্ষিত এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তি যে শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে, এমন স্বার্থপর আপনজন কেউ চায় না। সবাই সু-শিক্ষায় গড়া ভালোবাসার সমন্বয়ে ভরা সাধারণ পরিবার চায়।

প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে দুর্নীতিবাজদেরকে সৎ চরিত্রে ফিরিয়ে আনা সম্ভব? যদিও পরিবারের মধ্যে যে ক্ষতি হয়েছে সেটা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে না। তাহলে কীভাবে পরিবারে এ ধরনের মানুষদের চরিত্রের পরিবর্তন করা সম্ভব? পারবে কি এরা নতুন করে প্রমাণ করতে যে তারা পরিবার ও সমাজের সত্যিকারের আপনজন? তাহলে তাদের প্রমাণ করে দেখাতে হবে, যে অন্যায় তারা করছে, তার জন্য তারা লজ্জিত ও অনুতপ্ত।

আমি সবকিছু বিবেচনা করে আজ আপনার কাছে আমার এই বার্তাটি তুলে ধরছি। কারণ, বাংলাকে দুর্নীতি মুক্ত সোনার বাংলা করতে হলে আমাদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে এবং সে পরিবর্তন নিজ ও নিজের পরিবার দিয়ে শুরু করতে হবে। সেক্ষেত্রে এগুলো পারিবারিকভাবে বসে মীমাংসা করার উদ্যোগ নিতে হবে, এটাই সবাই বলবে। এতে সীমিত সময়ের জন্য হয়তো পরিবারের সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এটা পরিবারের তথা সমাজের জন্য সুফল বয়ে আনবে। সুশিক্ষা এবং মানবতার ধ্বংস নয়, ধ্বংস হোক তার নিজের কুশিক্ষা।

জীবনে চলার পথে কিছু লক্ষ্য থাকা দরকার যা শিক্ষণীয় এবং যা সোনার বাংলায় আদর্শ মানুষ হতে সাহায্য করবে। আমি গত চল্লিশ বছর ধরে চেষ্টা করেছি একটি সুন্দর পরিবার তৈরি করতে। আমি চল্লিশ বছর ধরে প্রাক্টিস করেছি সৎ পথে চলতে, সত্য কথা বলতে, অন্যায় না করতে এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। আমি পরিবারের ভালো-মন্দ সবকিছু জানি, জেনে শুনেও অনেক সময় চেষ্টা করেছি চুপ থাকতে, অনেক সময় সমাধানে ঢুকেছি, সমাধান করেছি। অনেকবার আমি চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিবারিক সমস্যাগুলোর পুরো সমাধান করতে পারিনি। শেষে সকলের সাথে কথা বলে এবার ভেবেছিলাম বাবা-মা মারা গেছেন, হয়তো আমরা পারব সব মিটাতে।

কথা ছিল সবাই দরকারে একটু ছাড় দিবে। আমরা সকল ভাই-বোন যা কিছু করেছি দেশে তার সমস্ত দায়ভার আমাদের একমাত্র ভাই লে. কর্নেল (অব.) হান্নান মৃধার ওপর ন্যস্ত করি। কারণ সেই শুধু দেশে থাকে। আমরা তার ছেলেকেও বিদেশে এনে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছি। তারপরও সে আমাদের বিশ্বস্ততাকে ভঙ্গ করে আমাদের দেশের প্রায় সকল সম্পদ ভোগদখল করে চলছে। বয়স এবং সময়ের সাথে যখন আমরা সবাই দেশে ফিরে নিজেদের সম্পদের অংশবিশেষ ফেরত পেতে তাকে অনুরোধ করি, ঠিক তখনই সে তার ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে আমাদের সকল ভাই-বোনকে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং ভয় দেখিয়ে সবকিছু ভোগ দখল করে চলছে।

আমরা নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি এবং তার পাওনার চেয়ে বহুগুণ বেশি দিয়েও তাকে সৎপথে আনতে ব্যর্থ হয়েছি। শেষে তাকে এও বলেছি দরকারে আপনার সাহায্য নিব তবুও দুর্নীতিকে পরিবার থেকে আজীবনের জন্য দূর করবো। লে. কর্নেল (অব.) হান্নান মৃধা কথা দিয়েও শেষে অঙ্গীকার ভঙ্গ করে ফেলেছে। এটাই আমাকে কষ্ট দিয়েছে। সে তার চাকরি জীবনে ডিজিএফআই, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ নানা দায়িত্বে কাজ করেছে। কিন্তু যখন সে নিজেই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তখন প্রশ্ন জাগে—আমরা সাধারণ মানুষ কোথায় যাব?

অবশেষে, আর কোনো উপায় না পেয়ে আমি আপনার এবং সমস্ত দেশবাসীর কাছে আমার এই লেখা তুলে ধরছি। প্রশ্ন হতে পারে, সামান্য এই সমস্যার জন্য কেন আপনাকে জড়িত হতে হবে? আসলেই, এটাই আমাদের একমাত্র সমস্যা, কারণ এই ছোট সমস্যার সমাধান হলেই পুরো বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান হবে। আপনি নিজে বড় কোনো সমস্যার সমাধানে কাজ না করে সমাজের নিঃস্ব মানুষকে ঋণ দিয়েছেন, কারণ আপনি জানতেন যে দারিদ্র্য দূর করতে হলে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সেই বিশ্বাস থেকেই এই চিঠি আপনার উদ্দেশ্যে লেখা। আশা করি আপনি আমাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। আমি বিশ্বাস করি, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রথমে পরিবার থেকে দুর্নীতি দূর করতে হবে, আর আপনি সেই পরিবর্তন আনতে পারবেন সে বিশ্বাস আমি করি।

আপনার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করি।

বিনীত,
রহমান মৃধা
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন থেকে। [email protected]

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর