কানাডা প্রবাসী লেখক মোস্তফা আকন্দ ও নেসার আহমেদ প্রণীত ‘ফারাক’ গ্রন্থটির মোড়ক উম্মোচন করেছেন অন্টারিওর প্রভেন্সিয়াল পার্লামেন্টের বিরোধী দলীয় উপনেতা বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত এমপিপি ডলি বেগম।
টরন্টোর স্থানীয় একটি হোটেলে শনিবার মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন জনপ্রিয় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও কানাডা প্রবাসী আসমা আহমেদ।
বিজ্ঞাপন
এমপিপি ডলি বেগম বলেন, টরন্টোতে বাংলাদেশিদের মধ্যে প্যারেন্টিং একটি জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘ফারাক’ বইটির লেখকদের আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তারা কমিউনিটির জন্য নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলায় লিখিত ফারাক বইটি টরন্টোর বাঙালি কমিউনিটির প্যারেন্টসদের প্যারেন্টিং সমস্যা সমাধানে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি। কমিউনিটির সবার বইটি পড়া উচিত।
‘ফারাক’ গ্রন্থটির ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে টরন্টো-ভিত্তিক অনলাইন পত্রিকা নতুন দেশের সম্পাদক শওগাত আলী সাগর বলেন, গল্পগুলো সুখপাঠ্য। পড়তে পড়তে মনে হবে আমি এই শহরেরই কোনো গল্পের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি আর মানসিক স্বাস্থ্য ও প্যারেন্টিং শিখছি। এই শিক্ষণটা আমাদের ও সন্তানদের মধ্যকার দূরত্ব কমাতে সাহায্য করবে।
টরন্টো প্রবাসী কবি, গল্পকার ও শিক্ষিকা সঙ্গীতা ইয়াসমিন বলেন, শুধু সন্তান জন্ম দিলেই বাবা-মা হওয়া যায় না। বাবা-মা হতে গেলেও কিছু দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ থাকা দরকার হয়। ‘ফারাক’ গবেষণাধর্মী তথ্য সম্বলিত ও বাস্তব ঘটনার প্রতিচ্ছবি নিয়ে রচিত গ্রন্থ। সেসব ঘটনা বিশ্লেষণ করলেই আমাদের মতো হাজারো বাবা-মা অন্তত নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে শিখবেন।
আইনজীবী ব্যারিস্টার জাকির হোসেন বলেন, কোনো বই যে এভাবে লেখা যায়, আমি কখনো দেখিনি। বইটি পড়া শুরু করলে আপনি শেষ না করে ছাড়তে পারবেন না। কমিউনিটির মানুষদের বইটি পড়া উচিৎ।
বিজ্ঞাপন
চিকিৎসক ডা. নিলাঞ্জনা দত্ত বলেন, মোস্তফা আকন্দ আমাদের সমাজের সমস্যাগুলোকে এমন সুন্দরভাবে তার লেখা গল্পে তুলে ধরেন যে, মনেই হয় না এটা কোনো তথ্যবহুল আলোচনা। আর বইটির সহ-লেখক নেসার আহমেদের প্রফেশনাল লেবেল অনেক উঁচু। ফারাক বইটি সবাইকে পড়ার আহবান করছি।
অন্টারিওর গুয়েলফ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মাহতাব শাওন বলেন, ফারাক নামটাই একটা সার্থক নাম। আপনারা বইটি পড়লেই বুঝতে পারবেন যে কেন এই নামটি রাখা হয়েছে।
আমরা বাংলাদেশি ক্যানাডিয়ান ফেসবুক গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও সমাজসেবামূলক কাজের উদ্যোক্তা ড্যানিয়েল হাকিম (ড্যান ড্যান) সবাইকে ফারাক বইটি পড়তে অনুরোধ করেন।
কানাডা প্রবাসী লেখক সুব্রত নন্দী বলেন, মোস্তফা আকন্দ খুবই ভালো লেখেন। টরন্টোতে বাঙালীদের মধ্যে যে কয়জন ভালো লেখেন, মোস্তফা আকন্দ তাদের অন্যতম।
সমাজকর্মী মোস্তফা কামাল বলেন, বাবা-মা হিসেবে আমাদের চিন্তার জায়গায় পরিবর্তন আনতে হবে। তারা যেভাবে চায় সে মোতাবেক সহায়তা করতে হবে। তাহলেই দূরত্ব কমবে।
টরন্টোভিত্তিক দাতব্য সংস্থা বেঙ্গলি ইনফরমশেন অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসের (বিআইইএস) নির্বাহী পরিচালক ইমাম উদ্দিন বলেন, ফারাক বইটিতে যে বিষয়গুলো তুলে আনা হয়েছে তার গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা যত টাকা পয়সার মালিকই হই না কেন, বাচ্চারা যদি ঠিকমতো বেড়ে না ওঠে তাহলে সব সম্পদ অর্জন বৃথা হয়ে যাবে।
সমাজকর্মী বদিউজ্জামান মুকুল বলেন, সন্তানরা বাবা-মাকে হত্যা করছে। কেন? একটু ভাবুন। যে স্টাইলে সন্তান লালন-পালন করছেন ঠিক আছে তো? আপনি বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সমস্যায় থাকলে ‘ফারাক’ বইটি আপনাকে সহায়তা করতে পারে।
লেখিকা ও টরন্টোর নারী উদ্যোক্তা সাবিনা শারমিন বলেন, ফারাক হতে পারে কারো কারো জন্য জীবন রক্ষাকারী হাতিয়ার। আপনি আপনার ঘরের মধ্যে কোন দানবকে বড় করে তুলছেন নাতো? ঢাকার ঐশী মেয়েটি কেন তার বাবা-মাকে হত্যা করল? মূল কারণ প্যারেন্টিং।
শিক্ষক ড. ফখরুদ্দীন কবি ও দার্শনিক কাহলিল জিবরানের একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের নয়। তারা সময়ের সন্তান। তারা তোমাদের মাধ্যমে পৃথিবীতে এসেছে। তোমরা তোমাদের সন্তানদের নিজের সম্পত্তি মনে করিও না। অর্থাৎ সন্তান হলেই যে সবকিছু তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে হবে, তাদের মতামতের কোনো দাম দেওয়া যাবে না– এটা ঠিক নয়।
সমাজকল্যান কর্মী ও উপন্যাসিক জাকারিয়া মুইনুদ্দিন বলেন, আমাদের বাঁচতে হলে জানতে হবে, অনুশীলন করতে হবে। মেন্টাল হেল্থ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্যারেন্টিং আমাদের শিখতে হবে।
লেখক নেসার আহমেদ উপস্থিত অতিথিদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ফারাক বইটি সময়োপযোগী বই। বইটি গল্প সমৃদ্ধ হলেও সবগুলো গল্পই সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে লেখা। সময়ের সাথে সাথে আমাদের নিজেদের প্যারেন্টিং স্টাইলে পরিবর্তন আনতেই হবে। বইটি আমাদের সেই পরিবর্তন আনতে সহায়কের ভূমিকা পালন করবে।
মোস্তফা আকন্দ বইটির ওপর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, আমরা সবাই আমাদের বাচ্চাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত চাই। কিন্তু নতুন দেশ নতুন সময়ের চাহিদারে সাথে তাল মিলিয়ে আমরা নিজেরা নিজেদের পরিবর্তন করতে ইতস্তত বোধ করি। ফলে আমাদের সাথে আমাদের সন্তানদের ফারাক তৈরি হয়। নতুন দেশের রীতিনীতি ও সংস্কৃতির সাথে নিজেদের খাপ খাওয়াতে না পারলে আমরা পিছিয়ে পড়ব। আমাদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কি করব। কারণ বাচ্চাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। বইটি বাবা-মায়েদের প্যারেন্টিং চ্যালেন্জ মোকাবেলায় সহায়ক হবে সন্দেহ নেই।
আলোচনা অনুষ্ঠানে আরও মতামত ব্যক্ত করেন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ও কানাডা প্রবাসী আক্তার মোসাম্মাৎ, ক্যানবাংলা টেলিভিশনের কর্ণধার ড. হুমায়ন কবির চৌধুরী, পিল ডিষ্ট্রিক্ট স্কুল বোর্ডের সিনিয়র শিক্ষক এমডি হাসান তারিক, বিশিষ্ট নারী উদ্যোক্তা সেলিমা আহমেদ, বিশিষ্ট আবাসন ব্যবসায়ী নাসিমা পারভীন ও মেফিল্ড হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী মেহরীন মুস্তারী প্রমুখ।