আমি দেশ স্বাধীনের চেতনায় গড়ে ওঠা ১৯৭১-এর এক শিশু মুক্তিযোদ্ধা। বাবা ও বড় তিন ভাইয়ের অবর্তমানে মায়ের দিকনির্দেশনায় ছোট পাঁচ ভাইবোন নিয়ে দীর্ঘ নয় মাস নিজ দেশে শরণার্থী হয়ে জীবন-মরণের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে স্বাধীনতার ফেরিওয়ালা হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করেছি। চোখের সামনে দেশ স্বাধীন হতে দেখেছি, বহু আত্মীয়-স্বজনের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ পেয়েছি, সাথে হারিয়েছিও অনেক কিছু। আমরা বর্তমান ৯ ভাইবোন, সবাই দেশের বাইরে, শুধু একজন ছাড়া। অল্প বয়সেই দেশ ছেড়েছি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে, পরিবারকে গড়ে তুলতে এবং দেশকে সোনার বাংলা করে গড়ে তুলবো বলে। বাবা-মায়ের নির্দেশনা এবং অনুপ্রেরণায় দেশের জন্য সব করতে প্রস্তুত— এমন মন-মানসিকতায় এখনও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। চল্লিশ বছর দূর পরবাসে বসবাস হলেও দেশের উন্নয়নে বদ্ধপরিকর হয়ে কাজ করে চলছি।
আমার গ্রামের বাড়ি মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার নহাটা গ্রামে। কিছুদিন আগে আমি পারিবারিক দুর্নীতি দমনে সরাসরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে একটি খোলা চিঠি লিখি। দুর্নীতি আজ আমার নিজের পরিবারে বাসা বেঁধেছে। আমার নিজের ভাই লে. কর্নেল (অব.) হান্নান মৃধা, যাকে আমরা বিশ্বাস করেছি শুধু পরিবারের জন্য নয়, পুরো দেশের জন্য। যার ওপর পুরো জাতি বিশ্বাস করেছে এই ভেবে— যদি কোনোদিন দেশে সংকট আসে তবে যেকোনো সমস্যায় জাতির পাশে থাকবে, থাকবে তার পরিবারের পাশে। অথচ সেই আপন ভাই তার পুরো পরিবারকে ধোকা দিয়ে বোকা সাজিয়ে সমস্ত সম্পদ আত্মসাৎ করেছে! জোর-জুলুমের মধ্যদিয়ে ভোগদখল করে দিব্যি নিজ পরিবার নিয়ে বিলাসি জীবনযাপনে মগ্ন হয়ে আছে। যাকে নিয়ে গর্ব করেছি, আজ তাকে নিয়ে লজ্জাবোধ করছি—এটাই আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আমার গত লেখাটি প্রকাশ হওয়ার পর সারাবিশ্বে বসবাসরত দূরপরবাসী বাংলাদেশিরা আমাকে নানাভাবে তাদের সমস্যার কথাও জানিয়েছেন। অনেকের লেখা পড়ে মনে হয়েছে আমি যেন তাদের প্রাণের কথা তুলে ধরেছি। যদি রাষ্ট্র আমাদের জীবনের, সম্পদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় তবে বিদেশে বসতরত কোটি মানুষের রেমিট্যান্স থেকে দেশ আগামীতে বঞ্চিত হবে। একই সাথে দেশ দুর্নীতিবাজদের সিন্ডিকেটের ছোবলে গ্রাস হয়ে যাবে, সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন শুধু দুঃস্বপ্নই হয়ে থেকে যাবে।
বিজ্ঞাপন
আমার পরিবার শিক্ষা ও অর্থে দেশে-বিদেশে সুনামের সঙ্গে চললেও আমার পরিবারে রয়েছে ভাই-বোনদের বঞ্চনাকারী এক বা একাধিক সদস্য। আমার পারিবারিক সমস্যা আমি দুঃখের সঙ্গে তুলে ধরছি শুধুমাত্র পরিবর্তনের জন্য। কারণ যদি এমনভাবে চলতে থাকে তবে পুরো দেশ এক সময় অচল হয়ে যাবে এসব কুৎসিত চরিত্রের দুর্নীতিবাজদের জন্য।
আর এ ধরনের কুৎসিত চরিত্রের মানুষ বর্তমানে বাংলাদেশে দ্রুতবর্ধনশীল। দেশের আইন ব্যবস্থাকে মজবুত করতে হবে। আমরা যেন দূরপরবাসে থেকেও সুশাসন পাই, রাষ্ট্রের সেদিকে নজর দিতে হবে।
বাংলাদেশের যৌথ পরিবারের সংখ্যা দিন দিন কমতে শুরু করেছে। পরিবারে বড় ভাই-বোনদের সচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও বাবা-মা এবং ছোটদের ছেড়ে আলাদা হয়ে যাওয়া, খোঁজখবর না রাখা— এখন এসব ঘটনা সর্বত্র দেখা যাচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশের কোটি কোটি পরিবারে প্রতিনিয়ত এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এর একটা বিহিত করা আশু প্রয়োজন। তবে পাছে লোকে কিছু বলে— এই ভয়ে কেউ কিছু করছে না। সরাসরি কিছু করতে বা বলতে গেলে পরিবারের গুডউইল নষ্ট হবে— এটাই সবাইকে বাধাগ্রস্ত করে চলছে। কিন্তু দেয়ালে এখন পিঠ ঠেকেছে। প্রতিবাদ করার সময় এখনই।
আমরা সবাই দানবের নয়, মানবের সমাজ ফিরে পেতে চাই। কিন্তু এই দানবদের আলোর পথে না আনতে পারলে সমাজ এবং দেশে এদের সংখ্যা এত বাড়তে থাকবে যে, শেষ পর্যন্ত সৎ মানুষ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে।
বিজ্ঞাপন
আমি গত চল্লিশ বছর ধরে চেষ্টা করেছি একটি সুন্দর পরিবার তৈরি করতে। আমি চল্লিশ বছর প্র্যাক্টিস করেছি সৎ পথে চলতে, সত্য কথা বলতে, অন্যায় না করতে এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে।
আমি পরিবারের ভালো-মন্দ সব কিছু জানি, জেনেশুনেও অনেক সময় চেষ্টা করেছি চুপ থাকতে, অনেক সময় সমাধানে ঢুকেছি, সমাধান করেছি। অনেকবার আমি চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি পারিবারিক সমস্যাগুলোর পুরো সমাধান করতে। এবার সবার সাথে কথা বলে ভেবেছিলাম বাবা-মা মারা গেছেন, হয়তো আমরা পারব সব মেটাতে। কথা ছিল সবাই দরকারে একটু ছাড় দেবে/স্বার্থত্যাগ করবে। আমরা সব ভাই-বোন যা কিছু করেছি দেশে তার সমস্ত দায়ভার আমাদের একমাত্র ভাই লে. কর্নেল (অব.) হান্নান মৃধার ওপর ন্যস্ত করি। কারণ সেই শুধু দেশে থাকে। আমরা তার ছেলেকে পর্যন্ত বিদেশে এনে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছি। তাকে দীর্ঘ ছয় বছর কোটি টাকা খরচ করে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছি, দুঃখের বিষয় মানুষ করতে পারিনি। কারণ সে তার বাবাকে পারিবারিক অপকর্ম থেকে বাধা দিতে আমাদের সাহায্য করেনি। লে কর্নেল (অব.) হান্নান মৃধা আমাদের বিশ্বস্ততাকে ভঙ্গ করে আমাদের দেশের প্রায় সব সম্পদ ভোগদখল করে চলছে। সময়ের সাথে যখন আমরা সবাই দেশে ফিরে নিজেদের সম্পদের অংশবিশেষ ফেরত পেতে তাকে অনুরোধ করি ঠিক তখনই সে তার ক্ষমতার অপব্যবহার এবং প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে আমাদের ভাই-বোনদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং ভয় দেখিয়ে সবকিছু ভোগদখল করে চলছে। আমরা নানাভাবে বোঝাতে এবং তার পাওনার চেয়ে বহুগুণ বেশি দিয়েও তাকে সৎপথে আনতে ব্যর্থ হয়েছি। শেষে তাকে এও বলেছি— দরকারে দেশবাসীর সাহায্য নেব তবুও দুর্নীতিকে পরিবার থেকে আজীবনের জন্য দূর করবো ইনশাআল্লাহ।
লে. কর্নেল (অব.) হান্নান মৃধা আমাদের কথা দিয়েও শেষে অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে, এটাই আমাকে কষ্ট দিয়েছে। সে তার চাকরি জীবনে ডিজিএফআই, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ নানা দায়িত্বে কাজ করেছে। সে নিজেই যখন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, আমার প্রশ্ন, আমরা সাধারণ মানুষ কোথায় যাব? শেষে অন্য কোনো উপায় না পেয়ে দেশবাসীর কাছে আমার এই বার্তা তুলে ধরা। আশা করি, পুরো দেশবাসী এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাবেন। একই সাথে ন্যায্যবিচার প্রতিষ্ঠা এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে দুর্নীতিমুক্ত পরিবার দরকার। আশা করি আমরা সবাই মিলে সেটা করতে পারব ইনশাআল্লাহ।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]

