বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

বাহারি নামের দলগুলোর ‘আনকমন’ পার্টি অফিস!

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ০২ নভেম্বর ২০২২, ১১:৫১ এএম

শেয়ার করুন:

বাহারি নামের দলগুলোর ‘আনকমন’ পার্টি অফিস!

ভোটের আগে সুযোগ পেয়ে নিবন্ধন পেতে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে ‘বৈরাবৈরী পার্টি’ নামের একটি রাজনৈতিক দল। আবেদনে নিজেদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় উল্লেখ করা হয়েছে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার আজগানা ইউনিয়নের কুঁড়িপাড়া গ্রামের কথা। কিন্তু কার্যালয় তো দূরে থাক ওই গ্রামের কেউই এই নামে কোনো দল আছে তা কখনো শোনেননি। 

গেল ঢাকার বাইরে ঠিকানা দেওয়া ‘বৈরাবৈরী পার্টি’র কথা। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা ঢাকা থেকে পরিচালিত হওয়া দলগুলোর অবস্থা জানায় মন দেওয়া যাক। 


বিজ্ঞাপন


ইসির আবেদনের তালিকায় প্রথম থাকা দল নৈতিক সমাজের অফিসের ঠিকানা নিয়ে পুরানা পল্টনে গেলে ওইভবনের নিরাপত্তারক্ষী বললেন, ‘এই নামের কিছু তো চিনি না।’ পাশের আরেকজনকে ডেকে বললেন, দেখতো এই নামে কোনো অফিস আছে কি না? অবশ্য ডেকে আনা লোকটি চিনতে পেরে বললেন, লিফটের ৯তলায় গিয়ে দেখেন কেউ আছে কি না।

তার কথা ধরে বাইতুল আবেদ টাওয়ারের ৯তলায় গিয়ে দেখা গেল, একটি রুমের সামনে নৈতিক সমাজের ছোট্ট একটি নামফলক। গেট তালাবদ্ধ। পরে দলটির সভাপতি মে. জেনারেল (অব.) আ ম সা আ আমিনকে একাধিক ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এই দলটির নির্ধারিত রুমের পাশে একটি কনসালটেন্সি অফিস। আরেক পাশে ট্রাভেল এজেন্সির অফিস। দুই অফিসের লোকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, বেশিরভাগ সময় রুমটা বন্ধ থাকে। মাঝেমধ্যে কয়েকজন লোক আসা যাওয়া করেন। এরবাইরে কোনো কার্যক্রম তাদের চোখে পড়েনি।

এমন অবস্থা শুধু নৈতিক সমাজ কিংবা বৈরাবৈরী পার্টির নয়, নির্বাচন কমিশনে এবার নিবন্ধনপ্রত্যাশী ৯৮টি দলের মধ্যে হাতেগোনা দুই চারটি ছাড়া বাকিদের অবস্থা এমন। নিবন্ধনপ্রত্যাশীদের কেউ আবার বন্ধুর অফিসে, কেউ আবার নিজের বাসায় দেখিয়েছেন দলের কার্যালয়। কারও দলের কার্যালয়ের ঠিকানা নিজের দোকান। এমন চিত্র উঠে এসেছে ঢাকা মেইলের অনুসন্ধানে। 


বিজ্ঞাপন


নামসর্বস্ব এমন দলগুলোকে নিবন্ধন দেওয়ার আগে ইসি যেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করে নেয় সেই পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

দেশে বর্তমানে ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে। নতুন করে নিবন্ধন নিতে গত ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত নিবন্ধন চাওয়ার জন্য ইসির পক্ষ থেকে সময় দেওয়া হয়েছিল। শেষদিন পর্যন্ত ৯৮টি দল আবেদন করেছে।

নিবন্ধন চাওয়া দলগুলোর কেউ ৫০ হাজার পাতার তথ্যও কমিশনে জমা দিয়েছেন। কেউ আবার নামকাওয়াস্তে কাগজপত্র দিয়ে নিবন্ধনের আশায় বুক বেঁধে বসে আছেন।

এদেরই একজন আবু আহমেদ ভুঁইয়া। যিনি ৮৫/১, নয়াপল্টন, মসজিদ রোডে অবস্থিত বাংলাদেশ বিদেশ প্রত্যাগত প্রবাসী ও ননপ্রবাসী কল্যাণ দলের সভাপতি। 

মঙ্গলবার (১ নভেম্বর) দুপুরে উল্লেখিত ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, সামনে দলের লিফলেট লাগানো থাকলেও রুম তালা দেওয়া। পাশের একজনের কাছে জানতে চাইলে নামপ্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘এরা কখন আসে কখন যায় কেউ জানে না। এদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগও আছে। বিদেশ ফেরতদের টাকা পয়সা নিয়ে ঝামেলার কথাও শুনেছি। এটা যেকোনো দলের অফিস আপনার কাছ থেকে জানলাম।’

অবশ্য দলটির সভাপতি মোবাইলে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের ঢাকাসহ ছয়টি কার্যালয় আছে। ইসির চাহিদা মতো ষোলআনা কাগজ দিতে পারিনি। যতদূর পেরেছি দিয়েছি। আশা করি নিবন্ধন পাবো।’

কীভাবে নিবন্ধনের আশা করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৩৯টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে অনেকেরই অফিস নেই। আমাদের তো ৬টা অফিস আছে। আরও কাজকর্ম করি। তাহলে নিবন্ধন দেবে না কেন?’

একই ভবনের চারতলায় রয়েছে বাংলাদেশ লেবার পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের নেতৃত্বাধীন দলটি এবার নিবন্ধন চেয়েছে। গিয়ে দেখা যায়, রাজনৈতিক কর্মসূচির নানা ফেস্টুন ও বড় বড় বাঁধাই করা ছবি টানানো একটি রুম। যেটি তাদের কেন্দ্রীয়, ঢাকা জেলা ও মহানগরের অফিস হিসেবে ব্যবহার হয়। পাশে আরও একটি রুম এই দলটির।

ঢাকা মেইলকে ইরান বলেন, ‘আমাদের ২৪টি জেলা ও ১০৩টি থানা অফিস ও কমিটি দেখিয়েছি। প্রতিকূল অবস্থায় নিবন্ধন চাইলেও সদস্যদের নামের তালিকাও দিয়েছি। আবার লেবার পার্টি কোনো আঞ্চলিক সংগঠনও নয়, এটা প্রাচীন দল। তাই আশা করি আমরা নিবন্ধন পাবো।’

এদিকে আলোচনায় থাকা এবি পার্টির প্রধান কার্যালয় রাজধানীর ৪৫ বিজয়নগরের পঞ্চম তলায়। বড় জায়গাজুড়ে সেখানে দলের কার্যালয়। অন্যদলগুলোর চেয়ে তুলনামূলক বেশ বড় কার্যালয় তাদের।

দলটির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের ২২০ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি। এছাড়া ৪৫টি জেলা ও ১২৫টি উপজেলায় কমিটি রয়েছে। নিবন্ধন পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়েছি। নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে আশা করি নির্বাচন কমিশন সুবিবেচনা করবে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ আমজনতা পার্টি আবেদনে তাদের ঠিকানা দিয়েছে ঢাকার ২০৫, বিজয় নগর। মঙ্গলবার এ ঠিকানায় গেলে এমন কোনো দলের কার্যালয় পাওয়া যায়নি। আশপাশের লোকজনও এমন কোনো দলের কথা জানেন না। 

ভবনের একজন জানান, এখানে এমন কোনো দলের অফিস নেই।

বাংলাদেশ জনমত পার্টিরও একই অবস্থা। পরিচিত লোকের ভবন দলের ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করলেও এমন কোনো দলের কার্যালয় নেই রাজধানীর তোপখানা রোডের ২৭/৮-এ তৃতীয় তলায়। নেই কোনো সাইনবোর্ডও।

অবশ্য দলটির আহ্বায়ক দাবি করা সুলতান জিসান উদ্দিন জানিয়েছেন, এসি লাগানোর জন্য সাইবোর্ড খোলা হয়েছে। 

তোপখানা রোডের মেহেরবা প্লাজায় দুটি দলের কার্যালয় দেখানো হয়েছে। একটি মোমিন মেহেদীর 
নতুনধারা বাংলাদেশ (এনডিবি), আরেকটি মো. আশরাফ হাওলাদারের বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক মুক্তি আন্দোলন (বিজিএমএ)।

মোমিন মেহেদী রুম নিয়ে থাকলেও অর্থনৈতিক সংকটে কার্যালয়ের রুম ছেড়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন বিজিএমএর লোকজন। 

মোমিন মেহেদীর দাবি, তাদের ২৪টি জেলায় কমিটি আছে। এটি হিসাব করেই নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করেছি। এছাড়া ১০৪টি উপজেলায় কমিটি রয়েছে। গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রও আছে। তারও প্রত্যাশা ইসির নিবন্ধন পাবেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদরা রাজনীতিকে খেলায় পরিণত করেছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে কৌতুক, বিনোদনের জায়গায় নিয়ে গেছে। অথচ রাজনীতি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই নির্বাচন কমিশন যেন অবশ্যই চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এদের নিবন্ধন দেয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

কোন প্রক্রিয়ায় নিবন্ধন দেবে ইসি
ইসি বলছে— দলগুলোর জমা দেওয়া তথ্যাদি পর্যালোচনা করা হবে। তদন্তও করা হবে। পরবর্তীতে সংবিধান ও আরপিও-সহ যে শর্ত আছে তার আলোকেই নিবন্ধন দেওয়া হবে। শর্ত পূরণ না হলে নিবন্ধন দেওয়া হবে না।

নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, ‘আমরা কর্মকর্তাদের দিয়ে কয়েকটা কমিটি করে দেবো। সেখানে আমাদের সংবিধান ও আরপিও-সহ যে সব বিষয় আছে, তার আলোকে দলগুলো যেসব তথ্য ও ডকুমেন্ট দিয়েছে, তা কমিটি পরীক্ষা করে দেখা হবে। আইনি যেসব শর্ত আছে, সেসব শর্ত পূরণ করলো কি না, সেগুলো দেখতে হবে।’

কোনো শর্ত অপূর্ণ থাকলে নিবন্ধন দেওয়া হবে না জানিয়ে এই কমিশনার বলেন, ‘নিবন্ধন পেতে হলে সব শর্তই পূরণ করতে হবে। সব দলের ক্ষেত্রে একই নিয়ম।’

বিইউ/এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর