২০০৯ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয় আওয়ামী লীগ। এরপর কেটেছে ১৩ বছর। এক যুগেরও বেশি সময়ে ক্ষমতা হারাতে হয়নি দলটিকে। নিজেদের জায়গা শক্ত করার পাশাপাশি বিরোধী দলগুলোর রাজনীতিও সাবলীলভাবে মোকাবিলা করেছে আওয়ামী লীগ। ১৩ বছরের দীর্ঘ এই সময়ে নিজ দলের মধ্যেই গজিয়ে উঠেছিল অনেক ‘গডফাদার’। কিন্তু টিকে থাকতে পারেনি কেউই। দফায় দফায় ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালিয়ে তাদের দমিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটি বলছে, শুদ্ধি অভিযানের মধ্য দিয়ে তারা বার্তা দিয়েছেন, দলকে ব্যবহার করে যারা নিজেদের আখের গোছাতে চায়, দলে তাদের কোনো আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না।
২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ফকিরাপুলে ইয়ং মেন্স ক্লাব থেকে এই অভিযান শুরু করে পুলিশের এলিট ফোর্স- র্যাব। একে একে অভিযান চলে ওয়ান্ডার্স ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা চিত্তবিনোদন ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র ও গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ ক্লাবে। অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনোর সন্ধান পাওয়া যায়।
বিজ্ঞাপন
অভিযানের প্রথমদিনেই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (বহিষ্কৃত) খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গুলশানের বাসা থেকে অস্ত্র ও মাদকসহ গ্রেফতার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব)।
২০ সেপ্টেম্বর যুবলীগ নেতা জি কে শামীমকে গ্রেফতার করা হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর দুপুরে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সময় থাইল্যান্ডগামী এক বিমান থেকে নামিয়ে আনা হয় অনলাইন ক্যাসিনোর জনক হিসেবে পরিচিত সেলিম প্রধানকে।
২০২০ সালের ৬ অক্টোবর গ্রেফতার হন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাবেক সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। সেদিন ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের আলকরা ইউনিয়নের কুঞ্জুশ্রীপুর গ্রাম থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশের এলিট ফোর্স- র্যাব। পরদিন কাররাইলে সম্রাটের অফিসে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় অস্ত্র, মাদকসহ বিভিন্ন অবৈধ জিনিসপত্র উদ্ধার হয়। প্রমাণ মেনে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগসহ বিভিন্ন পর্যায়ে তার একক আধিপত্যের বিষয়টি।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি’র তথ্যমতে, ২০১১ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ৯ আগস্ট পর্যন্ত সম্রাট সিঙ্গাপুরে ৩৫ বার, মালয়েশিয়ায় তিনবার, দুবাইতে দুবার এবং হংকংয়ে একবার ভ্রমণ করেছেন। এছাড়া তার সহযোগী এনামুল হক আরমান ২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ১৮ মে পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে ২৩ বার ভ্রমণ করেছেন। সম্রাট ও আরমান অবৈধ অর্থ দিয়ে যৌথভাবে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
বিজ্ঞাপন
রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের কর্মী হলেও তাকে দমিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুই বছর ধরে সম্রাট রয়েছেন কারাগারে। সম্রাটের মতো আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় নিজেদেরকে স্থানীয় ‘গডফাদার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা অনেকেই এখন শ্রী ঘরে।
অভিযানে গ্রেফতার হন রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় রাজনৈতিক পরিচয় ও অস্ত্র-ক্ষমতার বলে নিজেদেরকে সর্বেসর্বা ভাবা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মিজানুর রহমান ও ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব।
আওয়ামী লীগের উপ-কমিটির সদস্য হয়ে প্রতারণায় এক প্রশস্ত জাল বিছিয়েছিলেন শাহেদ করিম। রিজেন্ট হাসপাতালের এই মালিক আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে স্বাস্থ্যখাতে নানা দুর্নীতি করেন। পরে সব কিছু প্রকাশ্যে এলে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। এ সময় শাহেদকে গ্রেফতার করে র্যাব।
এই অভিযানে গ্রেফতার হয়ে এখনও কারাগারে আছেন যুব মহিলা লীগের নরসিংদীর নেতা পাপিয়া আক্তার। সামনে আসে রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে তার নানা অপরাধের চিত্র।
এই অভিযানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগে উঠতি ‘গডফাদার’রা চুপসে গেছেন। আবার কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ, মাদক বা কোনো অপরাধে জড়িত থাকলে তাদেরকে আওয়ামী লীগের কোনো সংগঠনেই জায়গা দেওয়া যাবে না। আবার কমিটির আসার পরেও যদি কাউকে মাদক বা কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়, তাহলে তাদেরকে দলকে ছেটে ফেলার নির্দেশ দেওয়া রয়েছে।
এই নির্দেশ অনুযায়ী, গত দুই বছরে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংগঠন থেকে পদ হারিয়েছেন অনেক নেতা।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, মাদক ও সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত এমন কাউকে দলে জায়গা দেওয়া হচ্ছে না। ভাতৃপ্রতীম ও সহযোগী সংগঠনের নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
পদ দেওয়ার আগে ওই পদের সাবেক নেতা, স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং সংসদ সদস্যদের থেকে পদপ্রত্যাশীদের বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। সব কিছু ঠিক থাকলে তবেই পদ দেওয়া হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘আমাদের নেত্রীর নির্দেশনা আছে, যাদের কারণে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে, যারা মাদক-সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত, যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদেরকে আমরা তৃণমূলের কোনো পর্যায়ে জায়গা দিচ্ছি না। আমরা মনে করি, যাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে, যারা মানুষের প্রতি বিনয়ী, মানুষের আস্থা-ভালোবাসা যারা অর্জন করতে পারবে, তারাই দলের নেতৃত্বে আসবে।’
আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘আমাদের নেত্রীর যে মহাসাফল্য, সেই সাফল্যকে ধরে রেখে আমরা যদি তৃণমূলকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারি, জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারি বিনয়ী হয়ে। তাহলে কোনো ষড়যন্ত্রই শেখ হাসিনার অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারবে না।’
শুদ্ধি অভিযানের বিষয়ে কামাল হোসেন বলেন, ‘এটি একটি দৃষ্টান্ত। সকলের জন্য একটা ম্যাসেজ। দলকে ব্যবহার করে যারা নিজেদের আখের গোছাতে চায়, তারা দলে কোনো আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না।’
আওয়ামী লীগের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সন্ত্রাস, মাদক, দুর্নীতি এই প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্স। এক্ষেত্রে কোনো মাফ নেই।’
আহমেদ হোসেন বলেন, ‘কাজেই সন্ত্রাসমুক্ত, মাদকমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। এ বিষয়ে আমাদের কার্যক্রম আছে, চলছে, চলমান।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জানান, বিএনপি বাংলাদেশকে মাদক এবং সন্ত্রাসের রাজত্ব বানিয়ে দিয়েছিল। তারা এখনও দেশকে আবার ওই সেদিকে নেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে।
আহমদ হোসেন বলেন, ‘আমরা সেই সকল ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করে যে বাংলাদেশে গড়ে তুলেছি, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশকে আমরা রাখবো, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে রাখবো। দুর্নীতিমুক্ত, মাদকমুক্ত ও সন্ত্রাসমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’
কারই/এইউ

